আলমগীর খোরশেদ
ঐতিহ্যের খেলা লাটিম
যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রামের ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, নারিকেল-বাঁশবনের শীতলতায়, লাটিম খেলা কী, তা তাদের বলে দিতে হবে না। বিশেষ করে ছেলেরা এমন কেউ নেই, যারা ছোটবেলায় বাবা-মার চোখ ফাঁকি দিয়ে ভরদুপুরে বাড়ির পেছনের রাস্তায় বা বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে লাটিম খেলেনি। গাঁয়ের পুরোনো খালি ভিটায়, বাঁশঝাড়ের নিচে কিংবা রাস্তায় ছেলেদের ভিড় থাকত। শৈশবের অনেক খেলার মধ্যে জনপ্রিয় ছিল লাটিম খেলা। আমাদের গ্রামের বাড়িতে বড় উঠান ছিল। বিকেলে স্কুল থেকে এসে পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুদের নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত নানা ধরনের গ্রামীণ খেলা, লাটিম ছিল তার মধ্যে একটি। ছেলেবেলায় শারীরিকভাবে বেশ মোটা থাকায় দৌড়াদৌড়ি করাটা আমার পছন্দের ছিল না। ফলে লাটিম আর মার্বেল খেলাকেই পছন্দ করতাম। জ্যৈষ্ঠ মাসে কাঁঠাল, লিচু খাওয়ার পর এসবের বিচি দিয়ে দাদু আমাদের লাটিম বানিয়ে দিতেন। শলার ঝাড়ু থেকে কাঠি ভেঙে তার অগ্রপ্রান্ত বিচিতে ঢুকিয়ে ছিদ্র করে বাকি কাঠি লম্বা রেখে দিতেন। কাঁঠাল বা লিচুর যে বিচিটা সুন্দর গোলাকার, মোটা, তা দিয়েই লাটিম বানিয়ে দিতেন দাদু। লাটিমকে গ্রামের ভাষায় ‘লাডুম’ বলে। এটা বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক প্রচলিত একটি খেলা। প্রাচীন রোমে লাটিমের ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়, তাদের পুরোনো চিত্রলিপি থেকে। কাঠিতে কাঁঠাল-লিচুর বিচি গেঁথে কাঠির অন্যপ্রান্ত দুই হাতে পিষে মাটিতে ছেড়ে দিলেই ঘুরতে শুরু করে লাটিম। বই বা খাতা থেকে কাগজের টুকরা ছিঁড়ে তা লাটিমের শলাকায় ঢুকিয়ে বিচির কাছে নিয়ে ঘোরানো হতো লাটিম। যখন একটু বড় হই, স্কুলে যাওয়া শুরু হয়, আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে সুতার বা মেস্তরিপাড়ায় শশীদা কাঠ দিয়ে বানিয়ে দিতেন লাটিম। পেয়ারা বা গাবগাছের কাঠ দিয়ে মেশিনের সঙ্গে আটকে কাঠ ঘুরিয়ে বাটালি বা রেত দিয়ে ঘষে বানানো হতো লাটিম। সব শেষে শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে লাটিম তৈরির কাজ শেষ হতো। নিচ দিয়ে পেরেক বা লৌহশলাকা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যা কেন্দ্র করে ঘুরে লাটিম। ধারালো ছাঁচ দিয়ে লাটিমের শেইফ বা আকার দিয়ে আলাদা করা হতো। জাম কাঠ দিয়েও লাটিম ভালো হয়। মেহগিনি কাঠের তৈরি লাটিমের দাম ছিল বেশি। কাঠের লাটিম ঘোরাতে সুতলি, সুতা বা গেঞ্জির কাপড়ের ফিতা তৈরি করতে হতো। মেশিনে কাঠ আটকে তা ঘুরায়ে বাটালি দিয়ে লাটিমের শেইপ বা আকারে টুকরা করে দেওয়া হতো। এভাবে একসঙ্গে অনেক লাটিম তৈরি হয়ে যেত। লাটিমের কাঠের অংশের নিচে লোহার পেরেক ঢুকিয়ে তা অক্ষ বানিয়ে খেলোয়াড় দু-তিন হাত লম্বা এক টুকরো পাটের সুতলি বা দড়ি দিয়ে বেঁধে আগা থেকে ক্রমেই গোলাকার কাঠের নিচে সমানভাবে পেঁচাতে হয়। তারপর হাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে হ্যাঁচকা টান দিয়ে উঁচু থেকে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দিতে হয়। মাটিতে পড়ে লাটিমটি ঘুরতে থাকে। দুপুর নেই, বিকেল নেই, লাটিম খেলতে গিয়ে অভিভাবকদের বকুনি খেয়েছি অনেক। শুকনো নারিকেলের আঁচি দিয়ে বড় লাটিম তৈরি করত গ্রামের মাদবর বা অবস্থাসম্পন্ন লোকরা, যা দুজন লাগত ঘোরাতে। সুতলি পেঁচিয়ে দুজনে লাটিমকে মাটিতে ছুড়ে মারলে জোরে শাঁ শাঁ শব্দে ঘুরতে থাকত লাটিম। শব্দে লোকজন দৌড়ে আসত। তবে গ্রামে থাকা গরিব ছেলেমেয়েদের কাঁঠাল ও লিচুর বিচি দিয়ে তৈরি করা লাটিম ছেলেবেলার সবচেয়ে বড় স্মৃতি।
বিভিন্ন ধরনের লাটিম খেলা
বেল্লাপর : এই খেলায় মাটিতে নির্দিষ্ট একটি দাগ কাটা হয়। তারপর সীমানা নির্ধারণ করতে হয়। একজন খেলোয়াড় তার লাটিম দিয়ে অন্য খেলোয়াড়ের লাটিমকে আঘাত করে। যদি লাটিমটি গণ্ডির ভেতর ঘুরতে থাকে আর বেরোতে না পারে, তাহলে লাটিমটি আটকে থাকবে।
ঘরকোপ খেলা : মাটিতে বৃত্তাকারে ঘর এঁকে সেই সীমানার মধ্যে লাটিম রাখতে হয়। নিজের ছুড়ে দেওয়া লাটিম যদি অন্যের লাটিমকে বের করে দিতে পারে, তাহলে সেই লাটিমগুলো তার হয়ে যাবে।
ঘুরতি : প্রতিযোগীদের মধ্যে একজন লাটিম ঘুরিয়ে দেয় আর অন্যরা তাদের লাটিম দিয়ে ওটাকে আঘাত করে। এভাবে সবাই ক্রমান্বয়ে লাটিম ঘুরিয়ে খেলা চলমান রাখে। অনেক সময় আঘাতে লাটিম ভেঙে যেত, যার টুকরো ঘূর্ণন গতিতে থাকায় খেলোয়াড়দের শরীরে জোরে আঘাত লাগত। এ নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি অভিভাবক পর্যন্ত গড়াত।
মনে পড়ে, পাঁচ টাকা দিয়ে লাটিম কিনে সারাক্ষণ খেলতাম। প্রথমেই ঘোরাতে পারতাম না। শিখে নিতে হতো বড়দের কাছ থেকে। বিশটা সুপারি দিয়ে একটা লাটিম কেনা যেত। তা না পাওয়া গেলে গোলাঘরের মটকি থেকে লুঙ্গিতে বেঁধে চাল সরিয়ে এনে দোকানে বিক্রি করে লাটিম কিনতাম। আর আম্মার বকা খেতাম।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামের পুরোনো ঐতিহ্য লাটিম খেলা হারিয়ে গেছে। মাঝে ইয়ো ইয়ো নামের প্লাস্টিকের তৈরি খেলনা চলত, যা সুতোয় বাঁধা লারে লাপ্পা করে খেলত বাচ্চারা, তা-ও হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সাড়ে ৪ হাজার বছর পুরোনো লাটিম খেলা আজকের প্রজন্ম চেনে না। ওরা এখন ইন্টারনেটের বদৌলতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুঁদ হয়ে থাকে। এভাবে হারিয়ে গেছে গ্রামীণ কত ঐতিহ্য।
"