আমিনুল ইসলাম
কমলেশের কবিতা
আলোকিত অনুভবের শিল্প
প্রায় প্রতিটি বাঙালির মাঝে বাস করে কবিমন। যাদের কবিতা নিয়মিত মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়, তারা কবি, যারা কবিতা লিখে ডায়রি ভর্তি করে রেখে দেন নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বে, তারাও কবি। যারা প্রকাশ মাধ্যমে অনিয়মিত উপস্থিত থাকেন, তারাও কবি। কমলেশ কুমার দাসকে ছাত্রজীবন থেকেই চিনি। তিনি এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। আমি ইন্টারমেডিয়েটে রাজশাহী কলেজের ছাত্র ছিলাম। তিনিও তাই ছিলেন। অতঃপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিষয়ে লেখাপড়া করেন; আমিও তাই করি। কর্মজীবনেও আমরা একাধিকবার একসঙ্গে কাজ করেছি। এত কথা বলার পেছনে একটা প্রাসঙ্গিক কারণ আছে।
কমলেশ কুমার দাস অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি টেলিভিশনে সংগীত পরিবেশন করে থাকেন। প্রধানত নজরুলসংগীত। তবে সব ধরনের গানেই তার সচ্ছলতা আছে। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য-সংগীতের অনুরাগী। কর্মজীবনে মাঝে-মাঝে কবিতা লিখেছেন কিন্তু সেসবের খুব কমসংখ্যকই প্রকাশের আলোয় আসত। তিনি মূলত বিভিন্ন ম্যাগাজিন স্যুভেনির ইত্যাদিতে কবিতা দিতেন।
অধিকাংশ বাঙালি কবির মাঝে একই সঙ্গে দুটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তারা যুগপৎ প্রেম ও বিপ্লবের কবিতা লিখে থাকেন। বাঙালি প্রেমিক তার ভূগোল ও ষড়ঋতু-শাসিত আবহাওয়ার কারণে। আর বিপ্লবী সে ঐতিহাসিক কারণে। তাকে বারবার প্রকৃতির বিরূপতা ছাড়াও বহিঃশত্রুর আগ্রাসন মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু আরো দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে, তাকে তার স্বজাতির অর্থাচার, দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ বিপ্লব করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কমলেশ কুমার দাস জন্মগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক কিন্তু জ্ঞানে ও ভাবনায় বিশ্বনাগরিক। বাঙালির চিরায়ত প্রেমতাড়না তার মাঝে সৃষ্টি করেছে রোমান্টিক রাত; আবার পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নিজ দেশের তুলনামূলক চিত্র তার ভাবনাকে প্রশ্নবোধকতা ও অস্থিরতায় বিড়ম্বিত করেছে। কমলেশ প্রেমকে অস্বীকার করেননি। তার কবিতায় নর-নারীর প্রেম এসেছে স্মৃতিচারণার পথ বেয়ে। হয়তো বেশি বয়সে এসে লেখা প্রেমের কবিতা এগুলো। সে জন্য সেখানে যৌবনদিনের উত্তাল আবেগ নেই; আছে পরিণত মনের সংযত স্মৃতিরোমন্থন। ‘ভর দুপুরে বিজন ঘরে বসলে একা আমি/বুকের মাঝে হাহাকারের ঘুঘু হয়ে তুমি/ডেকেই চলো ঘুঘু রবে বিরাম নাহি জান।’(আলোকময়ী)।
কমলেশ কুমার দাস তার আপন সত্তার গভীরে জন্মভূমি বাংলাদেশের মাটির প্রতি প্রবল টান অনুভব করেন। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি তার প্রতিদিনের অনুশীলন ও ভালোবাসা। তবে তার কবিসত্তায় বিপ্লবী-বিদ্রোহী উপদান বেশি। তিনি আগাগোড়াই খুব মেধাবী একজন ব্যক্তি। দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বৈশ্বিক অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক বিবর্তন ইত্যাদি সম্পর্কে তার জ্ঞান বরাবরই নিবিড় ও হালনাগাদ। তিনি ভাবনায় চরম পুঁজিবাদের বিপক্ষে। পুঁজিবাদের মোড়লদের ধূর্ত ষড়যন্ত্রে সমাজতন্ত্রের পতনের পর সারা বিশ্বে সম্পদের মেরূকরণ তীব্র হয়ে উঠেছে। সাহিত্য সংগীত, মানুষের রূপ-যৌবন, সৌন্দর্যচর্চা, নাটক, সিনেমা সবকিছুই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে চরম পুঁজিবাদ। মানুষ হয়ে উঠেছে পণ্য। বিশ্বায়ন ও আকাশ মিডিয়া পণ্যসংস্কৃতির প্রচারে ও প্রসারে কাজ করে চলেছে দিন-রাত। অল্পসংখ্যক মানুষের মালিকানায় পৃথিবীর সিংহভাগ সম্পদ। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত হয়ে জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। কমলেশ কুমার এই মানবিকতাশূন্য পণ্যসর্বস্ব পুঁজিবাদী সংস্কৃতির ঘোরতরবিরোধী। একই সঙ্গে তিনি আশাবাদী মানুষও। তার অনেক কবিতায় এমন চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। ‘পুঁজির বিকাশ পুঁজির বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হলে/হায়েনারা হামলে পড়ে মানব মুখোশ খুলে।’ (পুঁজির রাক্ষসী আক্রমণে)।
পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্রের এখন দুর্দিন চলছে বলা যায়। পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বহু বছর বাম রাজনীতি শাসন করেছে অথচ এখন সেখানে বামদের অস্তিত্ব সংকট চলছে। বাংলাদেশেও বাম রাজনীতি গুরুত্বহীন পর্যায়ে নেমে গেছে। অথচ বামপন্থা ছাড়া পৃথিবীর বুকে যতটা সম্ভব শোষণমুক্ত সাম্যবাদী মানবসমাজ প্রতিষ্ঠা করার সম্ভব নয়। কমলেশ কুমার আজও শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেন। তার কবিতার মাঝে সেই আশাহীন আশার ধ্বনি শোনা যায়। ‘ঐ দূরে পশ্চিমে আবার উঠেছে শোরগোল/ভাঙনের, প্লাবনের, জড় বর্তমানকে না মানার/কাল পেঁচারার উৎকণ্ঠিত আলোর সংকেতে/
মানচিত্রে গোলার্ধ্ব সরে যাচ্ছে পায়ে পায়ে/ইথারে বিনিময় হচ্ছে শ্লোগান/শোষণের, শাসনের যন্ত্রগুলো করতে বিকল/ভাঙতে শৃঙ্খল মেকি বয়ানের।’ (আলোর সংকেত)।
কমলেশ কুমার দাসের কাব্যভাবনার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা শক্তি। তিনি শোষণহীন সমাজে বিশ্বাসে। তিনি বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে। তার আনন্দ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে সচ্ছল সমাজে। ব্রিটিশের হাত থেকে ১৯৪৭ সালে মুক্ত হয়েছিল এই উপমহাদেশ। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালে একবার এবং অতঃপর ১৯৭১ সালে আরেকবার স্বাধীন হয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের বসবাস মূলত গ্রামে এবং গ্রামঘেঁষা উপজেলা শহরগুলোয়। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। বহু আগে থেকেই নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ায়, তার পক্ষে ভোটের প্রচার করায় তাদের নিবিড় আনন্দের ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশের একশ্রেণির দেশপ্রেমহীন রাজনৈতিক নেতা ছলেবলে দেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে, দেশের সম্পদ লুণ্ঠন ও বিদেশে পাচার করেছে এবং জনগণের মুখ বন্ধ করার জন্য সীমাহীন নিপীড়ন ও অত্যাচারের পথ বেছে নিয়েছে। এসব ডাবল স্ট্যান্ডার্ড রাজনীতিক দেশ ও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ফলে দেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন থেকে এবং জনগণ একটি উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জাতিকে বিভাজিতকরণ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমাহীন অপব্যবহার ঘটিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে দেশের ইতিহাস ও গৌরবের পারিবারিককরণ, ইতিহাস বিকৃতি এসব রাজনৈতিক অপকর্ম ও ভণ্ডামিকে পরিহাসে ও প্রতিবাদে কবিতা করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। ‘এ দেশ তো আমার নয়/ভাত, ভোট অধিকার চাইলে/স্বাধীনতাবিরোধী হয়/এ দেশ তো আমার নয়/পিতার ছবি নিত্য বিক্রি হয়/অনন্ত ক্ষমতার ক্ষুধার নিবৃত্তিতে।’ (এ দেশ আমার নয়)।
কমলেশ কুমার দাসের কবিতায় নির্মোহ দেশপ্রেমের নির্ভীক প্রকাশ লক্ষ করা যায়। আয়তনে অপেক্ষাকৃত ছোট হলেও সামরিক ও বাণিজ্যিক কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এই সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে একটি উন্নত দেশে উন্নীত হওয়া কোনো কঠিন ব্যাপার নয় বাংলাদেশের পক্ষে। কিন্তু বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাম্রাজ্যবাদী ও প্রভুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও তৎপরতার কারণে বাংলাদেশ আজও সেই সম্ভাবনার যথার্থ ব্যবহার করতে পারেনি। অধিকন্তু আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনপূর্বক অভিন্ন নদীগুলোর উজানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র কর্তৃক বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মারাত্মক হস্তক্ষেপ করায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও প্রত্যাশিত উন্নয়ন সবই মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। তাদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি বাংলাদেশের মানুষকে বিভাজিত ও দুর্বল করে রাখছে। কমলেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর এহেন অন্যায় তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ হতে চেয়েছেন কবিতার ভাষায়। ‘মহাকালের কৃষ্ণপর্বে বিভ্রান্তির মুখোশ পরা দানবেরা/সূর্যটা নিভিয়ে দেবার আস্ফালন করছে এখন/স্বদেশ সঙ্গীন আজ অসুরের তাণ্ডবে/দৈত্যদের রামরাজত্ব যেন গাঙ্গেয় এই বদ্বীপে এখন/মুখোশের আড়ালে দানবেরই নিরলস চেষ্টা/দেবপুত্র সেজে প্রতারণার!’ (আঁধার সরিয়ে আলো ফুটবেই)।
কমলেশ কুমার দাসের কবিতা পৃথিবীর সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে যারা পুঁজিবাদ, বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরতন্ত্র প্রভৃতির কবলে পড়ে পিষ্ট হয়ে চলেছেন রাত-দিন। কমলেশ দাসের কবিতা বাংলাদেশের অটুট ও অক্ষুণ্ণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে। কমলেশ দাসের কবিতা ঘৃণা ও বিভাজনের বিপক্ষে। কমলেশ দাসের কবিতা খাঁটি দেশপ্রেম ও উদার মানবপ্রেমের পক্ষে। আজ পৃথিবী নতুন করে বহুমুখী সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের কবলে পড়েছে। অর্থলিপ্সা ও ক্ষমতালিপ্সা দেশীয় রাজনীতিকে করে তুলছে লোভী ও বিশ্বাসঘাতক। অথচ এমন প্রেক্ষাপটেও কবি-বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিত শ্রেণির বড় অংশ দলান্ধতা ও সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে রয়ে যাচ্ছে নীরব অথবা দেশ ও জাতির বিপক্ষ তৎপরতার পক্ষে বিবেকহীনভাবে সক্রিয়। এমন অবস্থায় কমলেশ কুমার দাসের আলোকিত মানসিকতা ও সোচ্চার কবিতা আমাদের আশান্বিত করে, আমরা বিশ্বাস করতে প্ররোচিত হই যে, আমরা দেশপ্রেমিক মন ও মানবপ্রেমিক মেধা নিয়ে সক্রিয়তার সোচ্চার হলে সুদিন ফিরে আসবে রোদেলা আলোয় সরিয়ে আগ্রাসী অন্ধকারের জঞ্জাল।
"