ইলিয়াস ফারুকী

  ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ভ্রমণ (পর্ব ১)

ভুটাননামা

দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো ছোটবেলার শখ। ছয় বা সাত বছর বয়সে আমার ভারত দেখা। এরপর যখনই সুযোগ আসে দেশে হোক কিংবা বিদেশে, ঘুরে বেড়াই। নাজরানা ইয়াসমিন হীরা আমার স্ত্রী, তিনিও আমার মতো। ছোট ছেলে নাসিফের এসএসসি শেষ। স্ত্রী প্রস্তাব করলেন চলো ভুটান ঘুরে আসি। আমি পতা এককথায় রাজি। সঙ্গে জুটে গেল স্ত্রীর দুজন সহকর্মী ও দুজন বন্ধুর সঙ্গে সহকর্মীর ছেলে। দলে আমাদের সদস্য আটজন। আমি, স্ত্রী, ছোট ছেলে নাসিফ, তার সহকর্মী এভেলিনা এবং মহুয়া, মহুয়ার ছেলে ঐশিক, মিরপুর বাংলা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক সান্ত¡না এবং মতিন। সাফারি ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক মো. রেজাউল করিম চন্দনের ব্যবস্থাপনায় ১৭ মে ২০১৭ সালে সকাল সাড়ে ৭টায় রয়েল ভুটান এয়ারলাইনসের এয়ারবাস ড্রুক এয়ারলাইনসে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। বিমানটি ছোট এয়ারবাসজাতীয় বিমান। ভেতরে দুই সারি আসন। যাত্রী খুব একটা বেশি ছিলেন না। আমাদের বিমান উড়াল দিতে দিতে ৮টা বেজে গেল। মুক্ত আকাশ, ঝলমলে রোদ। বিমানের জানালা দিয়ে ছোট করিডরসম্পন্ন বিমানে রোদ পড়ে আরো ঝলমলে উজ্জ্বল করে তুলেছিল। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়াল দেওয়ার পর প্রায় ঘণ্টাখানেক মুক্ত আকাশে উড়লাম। হঠাৎ আমার ছেলে দেখাল, বাবা দেখো দেখো- আমরা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছি। আমার এমনিতেই উচ্চতা ভীতি রয়েছে, তাই আমি কখনো বিমানের জানালার পাশে বসি না। বিমানের মাঝের কর্নারের আসনে বসি। ছেলের আহ্বানে তাকিয়ে দেখলাম আমরা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে উড়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝেই শ্বেতশুভ্র মেঘের গুচ্ছ বিমানকে স্পর্শ করে পেছন দিকে চলে যাচ্ছে, যেন কোনো লজ্জাবতি বালিকার প্রথম স্পর্শে লজ্জা পেয়ে ছুটে পালানো। বিমান যখন মেঘের মাঝ দিয়ে উড়ছে তখন কিছুটা ঝাঁকি লাগছে। আমি তখন আসনের দুই হাতল শক্ত করে ধরি। আমার এই অবস্থা দেখে আমার ছেলে এবং তার মা হাসাহাসি শুরু করে। যা হোক, অবশেষে বাংলাদেশ সময় সোয়া ৯টায় এবং ভুটানের স্থানীয় সময় পৌনে ৯টায় আমরা পারো এয়ারপোর্টে অবতরণ করি। বিমান পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে উড়ে এসে অনেকটা সহজভাবেই অবতরণ করল। ছোট বিমান তাই আলাদা সিঁড়ির প্রয়োজন হয় না। বিমানের দরজা নিচের দিকে নামিয়ে দিলেই সিঁড়ি হয়ে যায়। বিমান থেকে নেমে আসতেই বিমানের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ‘হ্যালো ক্যাপ্টেন’ বলে হাত বাড়াতেই, ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে করমর্দন করলেন। তাকে বললাম, ‘ক্যাপ্টেন, থ্যাংক ইউ ফর ইউর নাইস ল্যান্ডিং, আই এনজয়েড ইট ভেরি মাচ।’ ক্যাপ্টেন মুচকি হেসে পাল্টা থ্যাংকিউ জানিয়ে চলে গেলেন। আমরা সবাই বিমানের কাছে দাঁড়ানো। আশ্চর্য হয়ে দেখছি চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় তার মাঝখানে এয়ার স্ট্রিপ। পারো এয়ারপোর্ট সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৩৫ মিটার উঁচু। অন্যদিকে এয়ারপোর্টটি ৪৯০০ মিটার উঁচু পর্বতমালা দ্বারা পরিবেষ্টিত। এ ধরনের এয়ারপোর্টে বিমান ওড়ানো এবং নামানোয় কতটা দক্ষতা প্রয়োজন! সম্ভবত সেই কারণে আন্তর্জাতিক অ্যাভিয়েশন থেকে এই এয়ারপোর্টে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য মাত্র ২৪ জন পাইলটকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমরা বিমানের কাছে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে পাহাড় দেখতে এতটাই তন্ময়তায় বিভোর ছিলাম, এয়ারপোর্টের কর্মীরা আমাদের টারমার্ক ছাড়তে তাগাদা দিচ্ছিলেন, সেদিকে কারো খেয়াল ছিল না। হঠাৎ তাদের উচ্চ স্বরে চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেয়ে দ্রুত ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে পা বাড়াই। ইমিগ্রেশন অফিসারের দিকে পাসপোর্ট বাড়াতেই তিনি ফিরে যাওয়ার তারিখ জানতে চাইলেন। তারিখটা জানাতেই তিনি ওই তারিখ পর্যন্ত পোর্ট এন্ট্রি ভিসা ইস্যু করে দিলেন। (আমরা যে সময় ভুটান ভ্রমণ করি তখন ভুটানে কোনো ট্রাভেল টেক্স দিতে হতো না) আমাদের ভ্রমণ ব্যবস্থাপনা সংস্থা আমাদের দলের জন্য একটি মাইক্রো ঠিক করে রেখেছিল। আমরা ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে বাইরে এসে দেখি কোনো মাইক্রোবাস নেই। বেশ কয়েকজন টেক্সিচালক আমাদের আহ্বান জানালেন। আমরা তাদের জানালাম, আমাদের গাড়ির এবং গাইডের ব্যবস্থা করা আছে। আমরা আমাদের গাইড-কাম-ড্রাইভারকে না পেয়ে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। একজন সহৃদয় ভুটানি ভদ্রলোক আমাদের সাহায্য করলেন। আমাদের কাছ থেকে ড্রাইভারের ফোন নম্বর নিয়ে ভদ্রলোক ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে জানালেন ড্রাইভার কাছেই আছেন। ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষায় থাকা আমরা জটলা করে নিজেদের মাঝে কথা বলছিলাম, হঠাৎ এক বাঙালি ভদ্রলোক আমাদের কাছে এলেন। উপযাজক হয়েই বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, আপনারা ভুটানে এই প্রথম। থিম্পুতে থাকাকালে মনে রাখবেন- রাতে কখনো একা কিংবা খালি হাতে হোটেলের বাইরে যাবেন না। থিম্পুর কুকুরগুলো খুবই বিপজ্জনক, একা পেলে সমস্যা হবে। তবে দিনের বেলা কোনো সমস্যা নেই।’ পরে ভদ্রলোকের কথার সত্যতা পেয়েছিলাম। আমার মতে, থিম্পুতে রাতের শহরে কোনো পুলিশের প্রয়োজন নেই, পাহারার জন্য ওই কুকুরগুলোই যথেষ্ট। পরে এটাও জানতে পারি, প্রত্যেকটা কুকুরকে এন্টির‌্যাবিস ভ্যাকসিন দেওয়া আছে। এয়ারপোর্টে ড্রাইভার আসতে আরো প্রায় আধা ঘণ্টা লেগে গেল।

ভুটান নামটা এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ভূ-উত্থান’ থেকে যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’। এদের ভাষার নাম ‘জংখা’। জনসংখ্যা মাত্র আট লাখের মতো। আমরা মাইক্রোবাসে রাজধানী থিম্পুর দিকে রওনা হই। পথে যেতে যেতে রাস্তার একপাশে উঁচু পাহাড় এবং অন্য পাশে অনেক নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদী আমাদের বিমোহিত করে তুলল। একই সঙ্গে চমৎকার সব নকশা করা কাঠের বাড়ি। পথেই আমাদের ড্রাইভার-কাম-গাইড জানালেন, ভুটানে ধূমপান জাতীয়ভাবে নিষিদ্ধ। ঘণ্টাখানেক ড্রাইভ করার পর ড্রাইভার একটি খরস্রোতা নদীর তীরে গাড়ি দাঁড় করালেন। পারো শহরের নামেই নদীর নাম ‘পারো’। এখানে অনেক ভ্রমণবিলাসীদের দেখা পেলাম। এখানে ঝুলন্ত রোপওয়ে দোলনা দিয়ে পারো নদীর ওপর দিয়ে শৌখিন পর্যটকরা পারাপারের আনন্দ ভোগ করছিলেন। নদীটি পাথুরে খরস্রোতা কিন্তু খুবই সুন্দর। ভ্রমণজনিত ক্লান্তির কারণে আমরা রোপওয়ের আনন্দ আহরণ থেকে বঞ্চিত হই। স্রোতসিনি পাথুরে নদীর ঠান্ডা পানিতে কিছুক্ষণ পা ডুবিয়ে আমরা আবার মাইক্রোয় উঠে পড়ি। মে মাসে যখন বাংলাদেশে প্রচুর গরম, তখন ভুটানে বেশ ঠান্ডা। খুবই চমৎকার আবহাওয়া। থিম্পুয় পৌঁছাতে আমাদের দুপুর ১২টা বেজে গেল। আমাদের ট্রাভেল এজেন্ট আমাদের জন্য থ্রি স্টার হোটেল, হোটেল মিগমার ঠিক করে রেখেছিলেন। আমরা রিসিপশনে পৌঁছাতেই অল্পবয়সি এক মেয়ে আমাদের স্বাগত পানীয় দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল।

আমরা স্বাগত পানীয় পান এবং হোটেলে রেজিস্ট্রি করতে করতেই আমাদের কক্ষগুলো তৈরি করে আমাদের ডাক পড়ল। দোতলায় পাশাপাশি তিনটা রুমে আমাদের দেওয়া হলো। আমরা আমাদের লাগেজপত্র রেখে সামান্য একটু বিশ্রাম নিয়ে আবারও বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই আমরা একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। আমাদের নির্দেশক কাম গাড়িচালক আমাদের প্রথমেই নিয়ে গেল ভুটান ন্যাশনরাল মেমোরিয়াল কর্টেন দেখাতে। মূলত ন্যাশনাল মেমোরিয়াল কর্টেন একটি স্তূপ। বৌদ্ধরা মৃত্যুর পর মৃতদেহের পোড়া ছাই এই স্তূপে রাখে এবং প্রার্থনা করে। তারা বিশ্বাস করে, এই স্তূপে মৃতের আত্মা থাকে। ন্যাশনাল মেমোরিয়াল কর্টেনে যদিও কোনো দেহভস্ব রাখা নেই, কিন্তু ভুটানিরা একে পবিত্র স্থান বলে গণ্য করেন। অনেক ভুটানিকে দেখলাম আভূমি নত হয়ে প্রণাম করতে। আবার অনেককে পুণ্যের আশায় এর চারপাশে চক্কর দিতে দেখলাম। বিভিন্ন পাহাড়ের খাঁজে ছোট ছোট স্তূপ দেখেছি। ড্রাইভারের কাছেই জানতে পারলাম এগুলো মৃতের আত্মীয়স্বজনরা মৃতের আত্মার প্রশান্তির জন্য রাখে। এখান থেকে আমরা সরাসরি চলে গেলাম বৌদ্ধ পয়েন্ট। এখানকার আরেক নাম ‘বুদ্ধ দর্দেনমা স্ট্যাচু’ এটা পাহাড় চূড়ায় ১৬৯ ফুট উঁচু বুদ্ধের ব্রোঞ্চের ভাস্কর্য। এই বৃদ্ধমূর্তি দেখতে হলে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠতে হয়। পাহাড়ের ওপর থেকে মূল শহর দেখলে মনে হয়, পাহাড়ের ঘেরের মাঝখানে ছোট ছোট খেলনাঘর যেন একটি উঁচু বালির তলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কী পোকা পড়ে আছে। অপূর্ব সে দৃশ্য। আমরা বৌদ্ধ পয়েন্ট ঘুরে দেখতেই সন্ধ্যার চাদর আমাদের ঢাকতে শুরু করলে আমরা হোটেলে ফিরে আসি। রাতের খাবার ব্যবস্থা আমাদের ট্রাভেল এজেন্ট হোটেলেই করেছিলেন।

আমাদের গাইড পরের দিনের প্রোগ্রাম জানিয়ে দেন। পরের দিন আমাদের প্রোগ্রামকে র্ঠিক করা ছিল ভুটান ন্যাশনাল পার্ক এবং থিম্পুর কয়েকটি মনেস্ট্রি বা গুম্ফ পরিদর্শন। রাতে আমরা মিগমার ডাইনিংয়ে আমাদের খাওয়া দাওয়া সেরে নিই। আমাদের দলে চার ধর্মেরই অনুসারী ছিলেন অর্থাৎ বৌদ্ধ, সনাতন, খ্রিস্টান এবং মুসলমান। হোটেলের ডাইনিংয়ে প্রচুর এবং নানা পদের খাবার ছিল। সুতরাং আমরা যে যার রুচিমতো রাতের আহার সারলাম। রাতে আমরা যার যার কক্ষে চলে গেলাম। পরে জেনেছিলাম মহুয়া আপা কাউকে কিছু না জানিয়ে একটু হাঁটার জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন। রাস্তায় নামতেই কুকুরের দল তাকে ঘিরে ধরে। যেহেতু হোটেল থেকে বেশিদূর যাননি বিধায় কোনো রকমে নিজেকে উদ্ধার করে হোটেলে ফিরে আসেন।

পরের দিন সকাল ১০টায় আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড এসে হাজির। হোটেলের পক্ষ থেকেই আমাদের নাশতার আয়োজন ছিল। বেশ জমজমাট আয়োজন। আমরা সবাই একসঙ্গে ভূরিভোজ সেরে নিলাম। প্রথমেই আমাদের একটি বৌদ্ধ মনেস্ট্রিতে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একটি শিশুর নামকরণ অনুষ্ঠান চলছিল। শিশুটির বাবা-মাসহ নানা, নানি এবং দাদা-দাদি সবাই উপস্থিত ছিলেন। ভাষা বুঝতে না পারার কারণে সবটা না বুঝলেও অনুষ্ঠানটা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। দুই পক্ষের সম্মতিতেই শিশুর নাম রাখা হয়। তারপর নারীরা ঘুরে ঘুরে প্রার্থনা চাকা ঘোরাচ্ছিলেন আর তাদের ধর্মীয় মতে মন্ত্র বলে যাচ্ছিলেন। (মন্দিরের বাইরের চার দেয়ালে কাঠের গোল চাকার মতো লাগানো থাকে, যাকে বৌদ্ধ প্রার্থনা চাকা বলে। এটাকে হাত দিয়ে ঘোরানো যায় এবং প্রার্থনা মন্ত্র পড়া হয়।) শিশুর অভিভাবকরা ছাড়াও এখানে অনেকেই তাদের ভাষায় মন্ত্র পড়ছেন এবং পুরো মন্দিরের চারদিকে ঘুরে সেই প্রার্থনা চাকা ঘোরাচ্ছেন। এটা তাদের এক ধরনের প্রার্থনা। এই জায়গায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে আমরা চলে যাই ভুটানের ন্যাশনাল পার্ক বা জিগমে দর্জি ন্যাশনাল পার্কে।

এই পার্কে প্রবেশ করতে প্রত্যেককে মাথাপ্রতি ১০০ নুলট্রাম গুনতে হয়। পার্কের ভেতরে প্রবেশ করে আমরা একদম হতাশ। পার্কের বাইরে বিশাল বিলবোর্ডে লেখা এই পার্কের আয়তন ৪৩১৬ বর্গমাইল। গেটের কাছে লাগানো বড় বিলবোর্ডে বাঘ, মেঘলা চিতা, মাস্ক ডিয়ার ও বন্য কুকুরের ছবি। কিছু কথা লেখাও আছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close