আরিফ মঈনুদ্দীন

  ৩০ আগস্ট, ২০২৪

উপন্যাস (পর্ব ৩০)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

আমার দেশে স্থায়ী হওয়াটা ফাইনাল। এই পয়েন্টে কোনো ছাড় হবে না। তুই তাহলে দলিলপত্র প্রস্তুত কর। দামের বিষয়ে আমি কিছু বলব না। বাজারদর অনুযায়ী তুই যা বলবি তা-ই হবে। আবারও বলছি ব্যাপারটা কিন্তু টপ সিক্রেট। ভাবিকেও বলবি না।

তা বলব না। তুই মেইলে ফ্ল্যাটের ডিটেলস পাঠিয়ে দিস। আমি ব্যবস্থা নেব।

রাত ১২টা বেজে ৩০ মিনিট। শিউলি বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। ঘুম আসছে না। মনের চঞ্চলতা চিত্তচাঞ্চল্যে পৌঁছে গেছে। এখন মাইকেলের সঙ্গে কথা বলা দরকার। সে মাইকেলকে ফোন দিল। ওপাশ থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাইকেল বলল, বলো মিস ইভানকা আমার ইভা, তুমি কেমন আছ?

আমি খুব খারাপ ছিলাম। এখন পুরোপুরি ভালো আছি। আমি কিন্তু বাসায় পুলিশও ডেকেছি। শেষে মাম্মির অনুরোধে সরি বলে পুলিশদের বিদায় করেছি। মাম্মি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আর কোনো সমস্যা তৈরি হবে না। আব্বুর সঙ্গে কথা বলেছি। মিথ্যা করে বলেছি, আর এসব করব না।

মাইকেল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, ভেরিগুড বেবি।

অবশ্যই ভেরিগুড হতে হবে। আমি আমার টার্গেট থেকে পিছ পা হব না। তোমাকে আমাদের বাসায় আর সময় দেব না। আমরা বাইরে ডেট করব।

কোনো সমস্যা নেই। তুমি যা বলবে তা-ই হবে। তোমাদের সাবকন্টিনেন্টের মেয়েদের লাবণ্য আমাকে সাংঘাতিকভাবে আকর্ষণ করে। আমি এটা হারাতে চাই না। তুমি দিনে দিনে আরো বেশি সুন্দর স্বাস্থ্যবতী ও লাবণ্যময়ী হয়ে উঠছ। তোমাকে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে দরকার। তোমার মুক্ত স্বাধীন উদার মনোভাব আমি খুব উপভোগ করি।

শিউলি কণ্ঠে অনুরাগ ঢেলে বলল, আচ্ছা ব্যাপারটাতে তুমি কি খুব অপমানিতবোধ করেছ?

মাইকেল সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দেওয়া কণ্ঠে বলল, আরে পাগল বলে কী? ভাব-ভালোবাসা করতে গেলে এসবকে গায়ে মাখলে চলবে কেন? আমি কিচ্ছু মনে করিনি। আচ্ছা তোমার মাম্মি মানে আন্টি কী বলেন?

আম্মি ঠিক আছেন। তবে বলেছেন হুটহাট করে নয়। ধীরে ধীরে এগোতে হবে।

মাইকেল সংশয়-জড়িত কণ্ঠে বলল, কোনটা হুটহাট করে নয়? এসব সম্পর্কের নিজস্ব একটি গতি আছে। গতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে। ওটা চলবে তার আপন গতিতে। এখানে বোঝাপড়ার কিছু নেই। ট্রিপিকেল বাঙালি ভাবধারা পরিত্যাগ করতে হবে। মনে রাখবে- তোমার টার্গেট কিন্তু সুপার মডেল।

শিউলি মুক্তকণ্ঠে বলল, তুমি ভাববে না-উনার বলাও ঠিক। আমাদের করাও ঠিক। ওই যে তুমি বললে না- আপন গতি। সবকিছু তার নিজস্ব গতিতেই চলবে।

মাইকেল প্রসন্ন ভাব প্রকাশ করে বলল, বিলকুল ঠিক বলেছ। তোমার দিকে তাকালেই আমি কেমন যেন হয়ে যাই। কী জাদুকরী বাঙালি মেয়ে তুমি! আমি অবাক হয়ে তোমাকে দেখি। এটা তোমার বিশাল এক সম্পদ। এই লাবণ্য এই সুশ্রী তনুসমগ্র রক্ষা করতে হবে। তুমি কোনো স্ট্রেস নেবে না। তাহলে কিন্তু অতি অল্প সময়ে এসব হারিয়ে যাবে। মনে রাখবে ওটাই তোমার সম্পদ, কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না।

শিউলি একটি বিষয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করছে। মাইকেল তার শরীরের খবরই রাখছে বেশি। মন বলে একটা জিনিস যে আছে, ওদিকটায় তার বিচরণ কম দেখা যাচ্ছে। সেও কম যাবে না। প্রতিষ্ঠা পেতে পারলে ল্যাংমারা শিখতে কতক্ষণ। আগে নিজের ধ্যানজ্ঞানের শীর্ষচূড়া স্পর্শ করা যাক। তারপরে পরের বিবেচনা। সে খুশিখুশি কণ্ঠে বলল, তুমি শুধু আমাকে সাহস দেবে। বাকিটা আমার করণীয়।

ওকে বেবি, কোনো সমস্যা নেই এখন রাখি। বা-আ-ই।

টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে শিউলি টেবিলে রাখা বইয়ের তাকে হাত রাখল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ বইটি হাতে নিল। বইটি তার পড়া হয়েছে। শেষবার আম্মি যখন দেশ থেকে এসেছিলেন তখন অনেক বাংলা গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে এই বইটিও ছিল। অরণ্যের এমন জীবন্ত সুন্দর বর্ণনা আর কোনো বইয়ে সে পায়নি। নাড়া লবটুলিয়া বইহার থেকে শুরু করে মোহনপুর রিজার্ভ ফরেস্ট এবং আর যে বনাঞ্চলের কথা তিনি বলেছেন- পড়লে মনে হবে অরণ্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে কিন্নর কণ্ঠে কথা বলছে। কণ্ঠে শুধু মধু আর মধু। এই মুহূর্তে বইটি হাতে নেওয়ার একটি মুখ্য কারণ হলো, এই উপন্যাসের শেষের দিকে অরণ্যচারী যৌবনবতী অরণ্যবালাদের নিটোল সুন্দর দেহ-লাবণ্যের যে মোহময়ী বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, শিউলির কেবল তেমনই হতে ইচ্ছে করে। সে এই মেয়েদের মতো ‘পরিপূর্ণ যৌবনা, প্রাণময়ী তেজস্বিনী’ হতে চায়। তবে ‘আনন্দ, স্বাস্থ্য ও সারল্যের প্রতিমূর্তি’ হতে চাইলে এক জায়গায় বেশ খটকা লাগে। সারল্য বিষয়টা এই মুহূর্তে তার বৈশিষ্ট্যে অনুপস্থিত হয়ে আছে। এটাকে সম্মানিত করতে গেলে তার যে আজ চলছে না। বিষয়টা মাথা থেকে দূরে রাখাই শ্রেয়। রাজকুমারী ভানুমতির মতো ‘সংকোচহীন, সরল, বাধাহীন’ উচ্চারণে ‘মুক্ত দৃঢ় উদার’ ভালোবাসার চর্চা এখানে থেকে যাবে অনুপস্থিত। ‘আরণ্যক’ বইটি পড়ে কেবল ওইসব বনাঞ্চল দেখার তীব্র বাসনাই মনে জাগেনি- ওইসব বনবালাদের দর্শনতৃষ্ণাও মনের মধ্যে ওতপেতে বসেছিল অনেক দিন। অরণ্যের এমন প্রাণবান সরব উপস্থিতি নৈঃশব্দ্যের তারে যে খইফোটা শব্দের সৃষ্টি করেছে, তা কেবল তাদেরই উজ্জীবিত করে, যারা নিজের দৃশ্যমান দুটি কান ছাড়াও আরেকটি শ্রবণেন্দ্রীয় লালন করে। তৃতীয় কর্ণ বলে যাকে। শিউলি মায়ের সুবাদে এত বেশি বাংলা সাহিত্য অধ্যয়ন করেছে যে, তার তৃতীয় একটি কর্ণ এরই মধ্যে খুলে গিয়েছে। তার বাংলা ভাষার গভীরতা দেখে বাবাকে এক দিন আফসোস করতে শুনেছে। বাবার কথায় সে যদি বাংলাদেশে থাকত তাহলে লেখক-সাহিত্যিক একটা-কিছু হয়ে উঠতে পারত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close