ফয়সাল আহমেদ
উৎসর্গের পাঁচ বই
একটি বই প্রথমবারের মতো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার সময় বইটির উৎসর্গ পাতায় একটু হলেও চোখ বুলাই। দেখি বইটির রচয়িতা কাকে উৎসর্গ করেছেন, কী লিখেছেন। এ বিষয়ে আমার কৌতূহল নতুন নয়। নিজের প্রথম বই প্রকাশের বহু আগে থেকেই একজন পাঠক হিসেবে বইয়ের উৎসর্গ পাতায় আমার নজর থাকত। কোনো কোনো সময় অল্প কয়েক শব্দে লেখা উৎসর্গনামা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। সেই আমিই যখন লেখক হিসেবে নিজের বই একজনকে উৎসর্গ করেছি, তখন কিন্তু নিজেকে মুগ্ধ করার মতো করে ‘উৎসর্গনামা’ লিখতে পারিনি। কেন জানি খুব তাড়াহুড়ো করে এ পর্ব সারতে হয়েছে।
আমার লেখা প্রথম বই ‘স্বপ্ন ও একটি গ্রাম’ বাবার হাতে তুলে দেওয়ার পর, পৃষ্ঠা উল্টে নিজের নাম দেখে ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলেন প্রিয়তম পিতা। আম্মাও তার বাইরে নন। তারপর পরবর্তী বইগুলো একে একে আপনজনদের উৎসর্গ করেছি। পরে প্রাসঙ্গিক কারণে পরিবারের বাইরের মানুষজনও শ্রদ্ধার সঙ্গে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছেন।
কোনো বইয়ের উৎসর্গ পাতায় নিজের নাম দেখে বিস্মিত হননি, আপ্লুত হননি কিংবা আনন্দিত- এমন লোকের সংখ্যা নেহাতই বিরল। আমি সেই বিরলতমদের মধ্যে নই। উৎসর্গ পাতায় নিজের নাম দেখে বিস্মিত হই, আপ্লুত হই এবং আনন্দিত তো বটেই। খুবই অবাক করার মতো বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক আমাকে তাদের বই উৎসর্গ করেছেন। বইগুলো হলো- মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সত্যজিৎ রায় মজুমদারের ‘বিম্বিত কালের বয়ান’, গল্পকার সাইফ বরকতুল্লাহর ‘উপদ্রুত ঘাসের ভেতর’, কবি ও প্রাবন্ধিক কাজী আলিমণ্ডউজ-জামানের ‘হে প্রেমময়ী নিষ্ঠুর হেমন্ত’, ঔপন্যাসিক শামস সাইদের চার গোয়েন্দা সিরিজ-৩-এর বই ‘কিডন্যাপ হলো চার গোয়েন্দা’ এবং ভারতীয় গল্পকার রাজেশ ধরের ‘চুপিকথা’।
মহামারি করোনার প্রবল প্রাদুর্ভাবের সময়ে ২০২১ সালের অক্টোবরে ‘বিম্বিত কালের বয়ান’ বইটি প্রকাশিত হয় ঢাকার অনন্যা প্রকাশনী থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। বইটির লেখক প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সত্যজিৎ রায় মজুমদার পেশাগত সম্পর্কে বহুদিন ধরে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত। তার লেখার প্রধান বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু এ বই তার ব্যতিক্রম। ১৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইতে লেখকতার বিগত সময়ে কাছ থেকে দেখা অতিবাহিত সময়, সমাজ-সংস্কৃতি এবং সেই সময়কে ছাড়িয়ে যাওয়া মানুষের গল্প তুলে ধরেছেন। লেখকের সূত্র ধরে আমরা পাঠ করি কবিয়াল গৌরপদ সরকার, ফাদার মারিনো রিগন, বিনয় মজুমদার, সত্যনারায়ণ রেড্ডিকে। গুরুত্বপূর্ণ বইটি লেখক আমাকে উৎসর্গ করেছেন। জীবনের প্রথম কেউ আমাকে তার বই উৎসর্গ করলেন। বিষয়টি জানার পর তখন ঠিক কী ধরনের অনুভূতি হয়েছিল, লিখে তা প্রকাশ করা কতটুকু সম্ভব আমি জানি না।
গল্পকার ও সাংবাদিক সাইফ বরকতুল্লাহর বই ‘উপদ্রুত ঘাসের ভেতর’। এটি লেখকের তৃতীয় গল্প গ্রন্থ। বইটি প্রকাশ করেছে অর্জন প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন কাব্য কারিম। তিনি এর আগে লিখেছেন ‘তেত্রিশ নম্বর জীবন ও ‘তিন নম্বর লোকাল’ নামের দুটো গল্প গ্রন্থ এবং সর্বশেষ প্রকাশিত বই ‘১০টি প্রেমের গল্প’। লেখক পেশায় সাংবাদিক। ডেস্কে কাজ করেন। নিত্যদিন দেশ-বিদেশের নানা গল্প তার হাত দিয়ে সম্পাদিত হয়। নিত্যদিন গল্পে মজে থাকা এ সাংবাদিক নিজেকে প্রতিনিয়ত গল্পকার হিসেবে প্রস্তুত করেন। ‘উপদ্রুত ঘাসের ভেতর’ বইতে রয়েছে তার পরিশ্রমের প্রতিচ্ছবি। এতে রয়েছে- দুঃখ প্রাইভেট লিমিটেড, কতদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে, লকডাউনের সন্ধ্যাগুলো, কোয়ারেন্টাইন, বিমর্ষ সন্ধ্যা, তবে কী তোমার প্রেমেতে পড়েছি, রাণী, মানুষের মধ্যে, নেই কেউ নেই ও উপদ্রুত ঘাসের ভেতর নামের ১০টি গল্প। ২০২২ সালের একুশে বইমেলার শেষদিকে বইটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর একদিন বইমেলায় চা খেতে খেতে লেখক আমার হাতে বইটি তুলে দেন। দু-তিন পৃষ্ঠা উল্টাতেই আমার চোখ আটকে যায় উৎসর্গনামায়।
ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বইমেলায় প্রকাশিত হয় কবি কাজী আলিমণ্ডউজ-জামানের কাব্যগ্রন্থ ‘হে প্রেমময়ী নিষ্ঠুর হেমন্ত’। জাগতিক প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদ করেছেন অশোক কর্মকার। কাজী আলিমণ্ডউজ-জামান প্রাবন্ধিক এবং সাংবাদিক হিসেবে সমধিক পরিচিত। তিনি দৈনিক প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক। লেখালেখির বাইরে পাঠাগার নিয়ে কাজ করেন। ‘ঢাকার গণপাঠাগার : আলোয় ভরা ভুবন’ নামে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে। বহুদিন ধরে তিনি কবিতা লিখছেন। ‘হে প্রেমময়ী নিষ্ঠুর হেমন্ত’ তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থভুক্ত হওয়ার আগে বইটির প্রথম কবিতা ‘আমার বামপন্থী বন্ধুরা’ পড়ে তার কবিতার অনুরাগী হয়েছিলাম। অতঃপর তার ‘নদীর বস্ত্রহরণ’সহ অন্য অনেক কবিতা আমাকে আকৃষ্ট করে। কবি বইটি আমাকে উৎসর্গ করে লেখেন- ‘এই শহরে একজন মানুষ ছুটে বেড়ান কলম হাতে, একাকী। কখনো সাহিত্যের ছোটকাগজ রক্ষার আন্দোলনে, কখনো প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাওয়া নদী বাঁচাতে। ফয়সাল আহমেদ, বন্ধুবরেষু।’
ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক শামস সাইদের চার গোয়েন্দা সিরিজের তৃতীয় বই ‘কিডন্যাপ হলো চার গোয়েন্দা’। ২০২৪-এর বইমেলায় এ কিশোর উপন্যাস প্রকাশ করে দ্যু প্রকাশন। শামস সাইদ প্রধানত ঔপন্যাসিক। তার লেখা আলোচিত অন্যতম উপন্যাস হলো- ধানমন্ডি ৩২, ১৪ই ডিসেম্বর, ক্রুশবিদ্ধ কলম ও দুঃখগুলো হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও। এর মধ্যে ‘ধানমন্ডি ৩২’ উপন্যাসটি দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে অল্প যে কয়েকজন লেখক শুধু লিখেই জীবিকা নির্বাহ করার অদম্য লড়াই জারি রেখেছেন, শামস সাইদ তার মধ্যে অন্যতম। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত তার লেখা ২৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার কিশোর উপন্যাস ‘কিডন্যাপ হলো চার গোয়েন্দা’ বইটির ভাষা সাবলীল হওয়ায় খুব সহজেই কিশোর পাঠকরা ঢুকে যায় এর কাহিনিতে। অতঃপর অপহরণ, হত্যা, লাশ চুরি, কিডন্যাপসহ নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে যায় তারাও। চমৎকার এ বই প্রকাশের পর লেখকের উপস্থিতিতে প্রকাশক আমাকেও এক কপি উপহার দেন। তারপর পৃষ্ঠা উল্টে দেখি বইটি আমাকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
ভারতীয় গল্পকার রাজেশ ধরের গল্পগ্রন্থ ‘চুপিকথা’। লেখক পেশায় শিক্ষক। তিনি গল্প অন্তঃপ্রাণ মানুষ। গল্পই যাবতীয় যন্ত্রণামুক্তির একমাত্র পথ বলে তিনি মনে করেন। এ পর্যন্ত তার দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে, দুটোই গল্পের। তার দ্বিতীয় বই ‘চুপিকথা’ প্রকাশ করেছে ঢাকার দ্যু প্রকাশন। এ বছরের বইমেলা উপলক্ষে বইটি প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। এতে রয়েছে ১১টি গল্প। বইটির নামগল্প ‘চুপিকথা’। যে গল্পে নদীর কান্না শুনতে পাওয়া যায়। তথাকথিত উন্নয়ন একটি নদীকে ঠিক কীভাবে গ্রাস করে, তারই গল্প ‘চুপিকথা’। কতিপয় না-মানুষের লালসা চুপির চূড়ান্ত মৃত্যু নিশ্চিত করে। গল্পটি পড়লে কান্না আসে বুক ভেঙে। চুপি বাংলার ক্ষতবিক্ষত হাজারো নদীর প্রতীক। ঠিক চুপির মতোই বাংলাদেশের অসংখ্য নদী উন্নয়নের কোপে মরছে ধুঁকে ধুঁকে। আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি...। আমাদের কিছুই করার নেই। সত্যিই কি নেই?
গল্পকার রাজেশ ধরের বেশির ভাগ গল্পই আমার পছন্দের। সে কথা তাকে বলেছি বহুবার। কেন তার গল্প আমার এত পছন্দ, এর উত্তর খুঁজতে হলে ‘চুপিকথা’ পড়তে হবে। প্রিয় গল্পকার যখন তার বইয়ের উৎসর্গনামায় আমার নাম বসিয়ে দেন, তখন খুশি না হয়ে উপায় আছে?
আমি কৃতজ্ঞ, ভীষণ কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি- স্নেহ আর ভালোবাসায় তাদের প্রিয়বই আমাকে উৎসর্গ করায়। এ ভালোবাসা মাথায় তুলে রাখলাম।
"