দীপংকর গৌতম

  ১৭ নভেম্বর, ২০২৩

আহমদ ছফার সঙ্গের দিনগুলো

তখন আজিজ সুপার মার্কেট লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক, ফিল্মমেকার, লিটলম্যাগকর্মী, প্রকাশক, বইয়ের দোকানে গিজগিজ করে। কোনো রকম মার্কেটে ঢুকলেই দু-ঘণ্টা এমনিতেই চলে যেত। সারা দেশের সৃষ্টিশীল মানুষ মানেই আজিজ সুপার মার্কেট। ঢাকায় যেই যেখান থেকে আসুক, একবার আজিজ সুপার মার্কেটে যাবে না, তা কি হয়? আমি তখন টেলিভিশনে কবিতা পড়ি। আমাদের ঠিকানা ড. লেনিন আজাদের প্রাচ্যবিদ্যা, আর লেখক মুনীর মোরশেদের ঘাস, ফুল ও নদী। এখান থেকে প্রায়ই দেখতাম- চেয়ারে বসা একটি লোক সারাদিন বসে তরুণদের সঙ্গে আড্ডা দেন। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে শুনলাম- ওই ভদ্রলোকই আহমদ ছফা। তিনি যে ঘরটিতে বসেন, সে ঘরের নাম ‘উত্থানপর্ব’। এ নামে পত্রিকা বের হবে শুনেই এক দিন ঢুকে গেলাম আহমদ ছফার ‘উত্থানপর্ব’ দোকানটিতে। ছফা ভাই বসে আছেন, গায়ে গেঞ্জি, পাঞ্জাবিটা চেয়ারের একপাশে ঝুলছে, আঙুলের ফাঁকে জ্বলছে সিগারেট। সিগারেট দেখে মনে হলো, ওটা খাওয়ার থেকে জ্বালিয়ে মারতেই তার সুখ বেশি। তিনি সিগারেটে টান দিচ্ছিলেন মাঝেমধ্যে, সিগারেটে টান দেওয়ার পরে তার দম মনে হয় বন্ধ হয়ে আসছিল। সিগারেটের প্রতিটি টান তার কাছে সুখটান হয়ে ফিরত। একটার আগুন দিয়ে আরেকটা জ্বালছিলেন। আমি বসে বসে দেখছিলাম। আমি ঢোকার পর তার একটা ফোন এসেছিল। তিনি আমাকে ইশারায় বসতে বলে কথা বলছিলেন। কথা শেষ হতেই খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, স্যরি, একটা ফোন এসেছিল। এখন বলুন কোত্থেকে এসছেন? কেন এসছেন? আমি বললাম, এখন মধুর কেনটিন থেকে এসেছি। একটা লেখা দিতে এসেছি। তিনি বললেন, লেখাটি রেখে যান। আমি যথারীতি লেখাটি রেখে দু-কদম সামনে এগোলেই তিনি পুনরায় ডাক দিলেন- শুনুন, তারপর তার সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। আমি গ্রাম থেকে আসা ছেলে। গা থেকে সোঁদা মাটির গন্ধ তখনো যায়নি। লেখাটা দিতেই আমার বুকের ভেতর ঢেঁকির পাড়ের ঢিপ্ ঢিপ্ শব্দ শুনছিলাম। অতবড় মাপের একজন লেখকের মুখোমুখি তখনো আমি হইনি। কীসে কী বলেন, সংশয়ে ছিলাম। লেখাটি দিয়ে ঝামেলা ঝেড়ে ফেললেও তার পুনর্বার ডাকে মনে হলো, কী অপরাধ যেন করে ফেলেছি। তার সামনের চেয়ারে বসব কী বসব না, এ নিয়ে ইতস্তত করতে লাগলাম। ছফা ভাই ব্যাপারটি অনুভব করলেন এবং বললেন, দেখুন, আমাকে সম্মান করলে আপনি স্বাভাবিকভাবেই করতে পারেন। তার জন্য চেয়ারে বসা বা সিগারেট খাওয়া কোনো অন্তরায় নয়। এ অন্তরায়গুলো সামাজিক সৃষ্টি। তাই এগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো। ছফা ভাই চায়ের অর্ডার দিলেন। আমি চা খেলাম, তার মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হলো। তিনি এর মধ্যেই জেনে নিলেন, আমার বাড়িসহ কুষ্টি-ঠিকুজিসহ সবকিছুর খবর। ছফা ভাই এত চমৎকারভাবে কথা বলতেন, একজন মানুষ কত দ্রুত মোহাবিষ্ট হতে পারে, তা না দেখলে বোঝা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, একজন তরুণ ঢাকায় আসার পর তার যে অবস্থা থাকে, তার প্রথমটা হলো, কোনো অবলম্বন না থাকা। ছফা ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার পরই মনে হলো, এ শহরে যার কেউ নেই, তার জন্য আহমদ ছফা আছেন। ছফা ভাইয়ের প্রথম দিনের ব্যবহারে আমি যেন একটা ঘোরে পড়ে গেলাম। চিন্তার প্রাগ্রসরতা এবং তার স্বভাবের প্রত্যুৎপন্নমতি বিষয়টা খুবই টানার মতো। ভন-ভণিতাহীন একজন মানুষ। প্রথম দিনের পর থেকেই ‘উত্থানপর্বে’ আমার যাওয়া-আসা কিছুটা নিয়মিত হলো। বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে ছফা ভাই বোঝাতেন, দেশের মূল অবস্থা। তিনি বলতেন, আমাদের মস্তিষ্কের উপনিবেশ না ভাঙা পর্যন্ত আপনি যতই সমাজ বিপ্লব করেন, তাতে কোনো লাভ হবে না। সময় নষ্ট হবে। ওর চেয়ে পড়াশোনা করেন।

ছফা ভাই যেকোনো বিষয়ে এত দ্রুত সমাধান টানতে পারতেন, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। তখন আমি অধুনালুপ্ত ‘আজকের কাগজ’-এ কাজ করি। অফিস ধানমন্ডির জিগাতলার মোড়ে। থাকি গোপীবাগে। অফিস শেষে যাওয়ার পথে ছফা ভাইয়ের অফিস হয়ে যাই। বেশ সময় কথা বলে বেশির ভাগ দিনই ছফা ভাইয়ের বইয়ের ভাণ্ডার থেকে এক-দুটো বই নিয়ে যাই। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ এক দিন আজকের কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান কথাসাহিত্যিক সালাম সালেহ উদ্দিন আমাকে বললেন, আপনি কি আহমদ ছফা সাহেবকে চেনেন? আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লে তিনি বললেন, এখন থেকে তিনি যে আমাদের পত্রিকায় লেখেন, ওটা আপনাকেই লিখে আনতে হবে (যাকে বলে ডিক্টেশন নেওয়া)। আমি কোনো কথা না বললেও মনে মনে খুশি হলাম। তখন বেতন পাই ২৫০০ টাকা। উদীচীতে একদম যেতে না পারলে পাগল হওয়ার দশা থাকে। সেখানে চায়ের আড্ডা, টিএসসির আড্ডা, বাসাভাড়া, খাওয়া, যাতায়াত, বই কেনা- সব মিলিয়ে খরচটা একটু টেনেটুনে করতে হতো। তাই ইচ্ছে করলেই সবকিছু সব সময় খেতে পারতাম না। ছফা ভাইয়ের লেখা লিখতে গেলে চা একটু পরপর। তার পরও কিছু খেতে চাইলে ছফা ভাইয়ের না নেই। বলা যায়, যা খেতে চাইতাম, ছফা ভাই তাই আনাতেন। আমার মনে হতো, ছফা ভাইয়ের ভেতরে এক ধরনের মাতৃত্ব লুকিয়ে আছে। তিনি দেখা মাত্রই বুঝতে পারতেন- খেয়ে এসেছি, না গিয়ে খাব। কিছু খাওয়ার পরে চা খেয়ে গল্প করে, তারপর লেখা শুরু হতো। জায়গা হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাশের বাসাটি অথবা উত্থানপর্ব। লেখা শেষে ছফা ভাই ১০০ টাকা হাতে গুঁজে দিতেন। বলতেন, এটা পারিশ্রমিক নয়, আমার অক্ষমতার দণ্ড। এই টানাটানির মধ্যে এক দিন ছফা ভাইয়ের জন্য বড় বড় দুটো আম কিনে নিলাম। বললাম, ছফা ভাই, আপনার জন্য আম দুটো এনেছি। বাসায় নিয়ে খাবেন। ছফা ভাই আমাকে কাটতে বললেন। আমি বললাম, আমি আম খাব না। ছফা ভাই খুব উত্তেজিত হলেন। বললেন, তুমি যা খাবে না, তা কারো জন্য নেবে না। তোমার এ আম আমি খাব না। আমি খুব বিব্রত হলাম। ছফা ভাই আমার দিকে কত সময় তাকিয়ে থেকে তারপর অন্যদিক ফিরে গান শুরু করলেন- ‘ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম না...।’ আমি কোনো মতেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। কারণ ছফা ভাইয়ের এই রুদ্রমূর্তি দেখতে তখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। ওই দিন চলে এলাম। পরের দিন আবার যেতে হলো ছফা ভাইয়ের লেখার বিল নিয়ে। সেদিন গেলাম ভয়ে ভয়ে। কারণ আগের দিনের আম্ররাগের কথা মনে করে। এখানে একটি কথা বলে রাখি, লেখার বিল দেওয়ার সময় কোনো কথা না বলে, না শুনে তিনি ১০০ টাকা পকেটে গুঁজে দিতেন। বলতেন, যা খেতে ইচ্ছে করে খেয়ে নেবেন। এ ছাড়া ছফা ভাই লেখার আগেই বলে নিতেন, তার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, তাই টাকাটা নগদ দিতে হবে। যারা লেখা নিতেন, এ কথা মেনেই নিতেন। পরের দিন গিয়ে দেখলাম, ছফা ভাই সেই আম্ররাগ ধরে রাখেননি। তিনি একটার পর একটা গান হারমোনিয়াম বাজিয়ে শোনাতে লাগলেন। একসময় ক্ষান্ত হয়ে বললেন, তোমার কেমন লাগল? সত্যি করে বলবে কিন্তু? আমি বললাম, ভালোই, তবে সব গানের সুর তো এক। ছফা ভাই রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, সুর সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। তুমি ছায়ানটে যাও। একটা ক্লাসে ভর্তি হও গিয়ে। কত টাকা লাগে জেনে এসো। টাকা আমি দেব। তখন ছায়ানটে ভর্তি হইনি। হয়েছি অনেক পরে। তত দিনে ছফা ভাই আর বেঁচে নেই। এরপরের কথাটা বলা খুব জরুরি, ছফা ভাইয়ের কাছে যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে ছফা ভাইকে ঘিরে একটা বড় রকমের শ্রদ্ধাবোধ আমার গড়ে উঠেছে। এ সময় অনেকেই বলতেন, এ ডানপন্থি বুদ্ধিজীবীর কাছে যাও কেন? তার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে লাইন। আমি বলতাম- আমার সঙ্গে এবং আমার গোচরে এমন কোনো কাজ তাকে করতে দেখিনি, যাতে তাকে ডানপন্থি বলা যায়। একবার একজনে বলেই বসলেন- তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। আমি কোনো কথা বললাম না। আজকের কাগজে লেখা আনার সূত্রে তখন নীলিমা ইব্রাহিমের বাসায় যেতাম। নীলিমা ইব্রাহিমের বাবা ডা. ইব্রাহিম সাহেবের কথা কোনো দিন ভোলার নয়। নীলিমা আপাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- আহমদ ছফা স্বাধীনতাবিরোধী কি না। তিনি বলেছিলেন, কে বলে এসব? ২৫ মার্চ ঢাকার রাস্তায় আর্মি নামার পর এ ছেলেটা শিক্ষকদের কোয়ার্টারে দৌড়ে দৌড়ে বলেছেন, যে যেখানে পারেন পালিয়ে যান, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমেছে। নীলিমা আপা বলেছিলেন, আসলে ও ক্ষ্যাপাটে লোক এবং সবার সামনে কথা বলে ফেলে। এসব স্বভাব সবাই পছন্দ করে না। আর দূরে রাখতে এসব কথা প্রচার করে। ছফা ভাই সম্পর্কে তখন একটা ধারণা পেলাম। বিচিত্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন ছফা ভাই। আমি হয়তো লেখার বিল ৫ হাজার টাকা দিলাম, তিনি বললেন, সবটা তোমার কাছে রেখে দাও। খরচ করো। আমি প্রথমে বিপদে পড়তাম। পরে বুঝে ফেলেছিলাম ছফা ভাইকে। তাই টাকা আমাকে দিলে রেখে দিতাম। দুদিন পরই দেখতাম, মন খারাপ করে বসে আছেন? জিজ্ঞেস করলে বলতেন- বাসায় চাল-ডাল কিছু নেই। কী হবে ভাবছি। আমি তার ফোন থেকে বাসায় কথা বলতাম। বাসায় দুজন থাকতেন- ডেভিড আর একজনের নাম মনে নেই। তাদের কাছে টাকা দিতাম চাল, ডাল, ডিম ও আলুর। ছফা বাই জিজ্ঞেস করতেন, টাকা কে দিল? আমি ধার-টার করব না কিন্তু! বলতাম, সব টাকা আপনার, আমি খরচ করি। ছফা ভাই চুপ করে থাকতেন। এমনও হয়েছে, ছফা ভাইয়ের সঙ্গে জাসদের গণবাহিনী নিয়ে কথা বলার কারণে ছফা ভাই আমাকে তার রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছেন। আমি বেরিয়ে দরজার পাশেই রয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ছফা ভাই বলেছেন- দুটো চায়ের অর্ডার দিলে কী হয়? আমি চায়ের অর্ডার দিয়ে আবার ছফা ভাইয়ের সামনের চেয়ারে বসেছি। তবে লেখার ব্যাপারে তিনি খুব মনোযোগী ছিলেন। লিখতে বসলে কোনো সাউন্ড পছন্দ করতেন না। ১০০ ভাগ মনোযোগ দিয়ে লিখতেন। লেখার পরে পাঠ করে বলতেন- ছেড়ে দাও। তার বিষয়, ভাবনা সব ছিল আলাদা। কিছু পাগলামি ছিল; লেখকের পাগলামি থাকেই। ছফা ভাইয়ের টেবিলে গৌতমবুদ্ধের একটা মূর্তি ছিল। তাতে চেইনওয়ালা একটা ঘুড়ি প্যাঁচানো থাকত। ছফা ভাই বলতেন- আমার সময় গৌতমবুদ্ধ পাহারা দেয়। সবচেয়ে অবাক ছিল, ছফা ভাই তার ছাদে খুদ হাতে নিয়ে বাবু বাবু বলে ডাকতেন, মুহূর্তেই আসত অজস্র পাখি। আমি বা কেউ ডাকলে কখনো আসত না। ছফা ভাইয়ের মৃত্যুর কয়েক দিন আগের ঘটনা। ছফা ভাইকে লেখার বিল দিতে গিয়েছি। গিয়ে দেখি ছফা ভাই স্নান করে সাদা পাঞ্জাবি পরে বসেছেন কেবল। চুল ভেজা। আমি ব্যাগ থেকে জেনিথ ক্যামেরা বের করে ছফা ভাইয়ের কটা ছবি তুললাম। তুলে বসতেই দেখলাম ছফা ভাই কাঁদছেন। আমি কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ছফা ভাই? বললেন, তুমিও বুঝে গেছো যে, আমি মারা যাব? নতুবা আমার ছবি তুললে কেন? আমি কোনো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ছফা ভাইকে তারপরে যেদিন দেখলাম, সেদিন ছফা ভাই নিরন্তরের পথে যাত্রা করেছেন। কমিউনিটি হাসপাতালে ছফা ভাই ঘুমুচ্ছিলেন। আহমদ ছফাকে আসলে ভোলার নয়। আহমদ ছফা যে মাপের মানুষ, সেদিকে তাকালে তাকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য লেখালেখির পরিমাণ খুবই কম। এটা না বাড়ালে, তা রীতিমতো অপরাধ হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close