আলমগীর খোরশেদ
মাটির ঘর
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের নিদর্শন মাটির ঘর। লাল মাটির এলাকাগুলোতে মাটির ঘর বেশি পাওয়া যায়। এমন এক দিন ছিল, সারা গ্রাম হেঁটে আসলেও কোনো টিনের ঘর দেখা যেত না। অঞ্চলভিত্তিক মাটির ঘর চোখে পড়ত। দৃষ্টিনন্দন এসব মাটির ঘর শহরের চার দেয়ালে থেকে দেখা যাবে না, দেখতে হলে যেতে হবে দূরের গ্রামে। যেখানে যান্ত্রিকতা এখনো শেষ করে দেয়নি মানুষের মন ও মানবতাকে। গ্রামে এখনো মানুষের ঘুম ভাঙে পাখির কলরবে। হাঁস-মুরগির ডাকাডাকি কিংবা সকালে গোয়ালঘরে বেঁধে রাখা বাছুরের চিৎকারে। সারা রাত কৃষক মাটির ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ভোরে পান্তা ভাত খেয়ে গরু জোয়াল নিয়ে মাঠে চলে যেতেন।
আগে গ্রামাঞ্চলে খুব ডাকাতি হতো। বিত্তবান গৃহস্থরা তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে মাটির দেয়াল দিয়ে দোতলা ঘর বানাতেন। নিজে দোতলায় থাকতেন। তৎকালীন বিত্তবানদের সৌখিন ও আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে তৈরি হতো মাটিরঘর। ভূমিকম্পে মাটির ঘরের খুব একটা ক্ষতি হয় না। যত্ন নিলে মাটির ঘর এক থেকে দেড় শ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে।
মাটি দ্বারা তৈরি এসব ঘরকে বলা হয় শান্তির নীড় বা বালাখানা। অনেক সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ মাটির ঘর যারা বানান, তাদের বলা হয় ‘দেলবারুই’। বসবাসের জন্য আরামদায়ক মাটির ঘর, এঁটেল বা আঁঠাল মাটিকে কাদায় পরিণত করে তিন থেকে চার ফুট চওড়া দেয়াল তৈরি করা হয়।
একতলা মাটির বাড়ির জন্য বারো থেকে চৌদ্দ ফুট উঁচু দেয়ালে বাঁশ, কাঠ বা লোহার এঙ্গেল দিয়ে সিলিং তৈরি করে তার ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া হয়। আর দোতলা বাড়ির জন্য তেরো থেকে পঁচিশ ফুট উঁচু দেয়াল তৈরি করে তেরো ফুটের মাঝে তালগাছের ফালি দিয়ে পাটাতন তৈরি করে দুই থেকে তিন ইঞ্চি মোটা কাঠের ছাউনি দেওয়া হয়। তারপর পঁচিশ ফুটের মাথায় একতলা বাড়ির মতো টিনের ছাউনি দেওয়া হয়। ময়মনসিংহের ভালুকা, ত্রিশাল, গাজীপুর ও সিলেট এলাকায় মাটির ঘর এখনো দেখা যায়।
ইদানীং মাটির ঘর তৈরির পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে মানুষ। কাদামাটির পরিবর্তে শুকনো ঝরঝরে মাটি, খড় ও ৫ শতাংশ সিমেন্ট মিশিয়ে ব্লক তৈরি করে দুরমুজ দিয়ে পিটিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই মাটির ঘর তৈরি করা হচ্ছে।
গোবরের সঙ্গে কালো ছাই ও জল মিশিয়ে মাটির ঘরের যত্ন করেন কৃষানিরা। ফুল, পাখি, বিভিন্ন আলপনা ও জীবজন্তুর ছবি মাটির ঘরের দেয়ালে আঁকার কাজটি ছিল পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সম্মানের ব্যাপার।
গরমে হালকা ঠাণ্ডা আমেজ ও শীতে হালকা গরম থাকত মাটির ঘরগুলোতে। ফলে মাটির ঘরকে বলা হতো ‘গরিবের এয়ার কন্ডিশন’। আধুনিকতা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, রুচিবোধ পরিবর্তনে মানুষ মাটির ঘর রেখে দালানঘর গড়ে তুলছে। মাটির বাড়িগুলো গ্রামের সহজ-সরল মানুষের জীবনযাত্রা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে আমরা আরো হারাচ্ছি গ্রামীণ জীবন ও গ্রামীণ সংস্কৃতি। সময়ের দাবি মানতে গেলে পরিবর্তন আসতেই পারে, তাই বলে নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাবে, সেটাও মানে না মন।
"