রুখসানা কাজল
গল্প
মোতিমালা

ঘরের পেছনের বাগানে নুনিয়া শাক তুলছিল মোতি।
হুসসস, ভেজা হাতে মুখের পানি মুছে দাড়িতে আঙুল বুলিয়ে চোখ টেপে ঠান্ডু মিয়া, রাত্তিরে আসপানি বুঝিছিস!
ঢ্যামনা য্যান কোহানকার! অজুর সুমাও পিত্তিভরা শয়তানি। জাত শয়তানের স্বভাব যাবে কোহানে! মুখ খারাপ করে আড়াইমনি পাতিলের সাইজ পাছা দুলিয়ে থু ফেলে মোতি। তিক্ত হয়ে উঠে ওর মন। বিনা কারণে ঠান্ডুর দেওয়া অপমান ও আজও ভুলতে পারেনি। তবু শাক তুলতে তুলতে মোতি ভাবে, শুয়োরের বাচ্চাডা যখন আসতে চাচ্ছে তখন আসুক না হয়! ঘরে চাল-নুন-তেল বাড়ন্ত। বাড়তি শরীরের মেয়েটার যখন-তখন ক্ষুধা লাগে। এটা-সেটা খেতে চায়। মনপছন্দ জিনিসপত্র দেখলে বায়না ধরে। ইশকুলের বেতনও বাকি পড়েছে। স্থানীয় প্রাইভেট ক্লিনিকে ছুটা আয়ার কাজ করে যা পায়, তা দিয়ে আর একা পেরে উঠছে না। ঠান্ডুকে তাই আজকাল না বলে না। হালকা একটু মেজাজ দেখিয়ে ঘরে চলে আসে সে।
অনেক রাতে, নিশি প্যাঁচারা ঘুমিয়ে গেলে, কঞ্চিকাছনির পলকা গেট ঠেলে চোরা বিড়ালের মতো ঘরে এসে ঢুকে ঠান্ডু। কাবাব তন্দুরের প্যাকেট টেবিলে রেখে ঘরের এদিক-সেদিক খোঁজে ফেরে। হতাশায় থুবড়ে যায় ওর বুক। চোখের কোণে পানি আসে। মোতির হাত ধরে অনুনয়ে ভেঙে পড়ে, তাতিয়ানাকে একবার ডাকপি মোতি? খালি একবার দেখপো। একটু কথা বলব। তোর আল্লার কিরে, একবার ডেকে দে বউ।
ফুঁসে উঠে মোতি, রাত-দুপ্পুরে সোহাগ মারাইও নাতো তাতুর বাপ! কীসের বউ। তুমি কি বউ করে রাখিছ আমারে! তাতু নাই। তুমি আসপা শুনি বাদলের বাসায় চলি গেছে বই-খাতা নিয়ে।
বাদল মোতির ছোট ভাই। তিন রাস্তার মোড়ে পান-বিড়ির দোকান দিয়েছে। দিনকে দিন লাল হয়ে উঠছে ব্যবসা। সবাই বোঝে বাদল পানের আড়ালে হয়তো টানের ওষুধও রাখে। তরুণ ছেলে ছোকরারা তাই ভিড় করে ওই দোকান ঘিরে। মাঝে মাঝে তাতিয়ানা দোকানে বসে। সেদিন ভিড় বেড়ে ভিড়াক্কার। সিগ্রেট কোক সেভেনআপ নেওয়ার সময় তাতিয়ানার হাত ইচ্ছা করে ছুঁয়ে দেয় কেউ কেউ। তাতিয়ানা তখন বেহায়ার মতো হেসে ওঠে। কখনো চোখ রাঙিয়ে বকা দেয়। ঠান্ডু এসব খবর যতবার শোনে, ততবার রাগে-দুঃখে ক্ষেপে আগুন হয়ে যায়। ওর ইচ্ছে করে বাদলকে মেরে খুন করে ফেলতে। তসবিহ গোনে আর আঙুল মটকায়। প্রাণ পুড়ে উদ্বেগ বাড়ে। উপায় কি! মেয়ে যত বড় হচ্ছে, তত সুন্দরী হচ্ছে। একসময় রাগ মরে মায়ায় ভরে উঠে ওর মন। প্রাণের কোথায় যেন ছোট্ট মেয়েটার এলোমেলো হাতের আঁকশি আদরগুলো মনে পড়ে যায়! তার মেয়ে কি এতই ফ্যালনা যে, বাদলার টং দোকানে গিয়ে বসবে!
ঠান্ডুর মনে বাপ বাপ মার্কা টেনশন জেগে ওঠে, মেয়েটারে ইট্টু সামলি রাখিস বউ। যে দিনকাল পড়িছে! বুড়ো হাবড়ারাও কম যায় না রে।
মোতি ঝামড়ে ওঠে, এখন বাপ বাপ লাগতিসে তাই না? তালাক দিবার সুমায় কই ছিল এত বাপগিরি? শোনো, তুমার মেয়ে হয়িছে তুমার মতোই আগুনের গোল্লা। এই বাপগিরি সে কি আর শুনবে, না মানবে!
তাতিয়ানার জামা ঝুলছে আলনায়। লম্বা পাজামা। ফ্যানের বাতাসে সস্তা জর্জটের ওড়নার কোণগুলো উড়ে উড়ে দুলছে। যেন আলনার আড়াল থেকে ছোট্ট তাতিয়ানা উঁকি দিয়ে বলছে, আব্বু টুকিইইই! কও তো আমি কোহানে?
সত্যি বড় হয়ে গেছে মেয়েটা। মায়ের চাইতে সুন্দরী হয়েছে। বকাবাজিতে ঠান্ডুর মতোই ক্ষুরধার। রাস্তাঘাটে অপছন্দের লোক দেখলেই ঠাস করে অপমান করে দেয়। কিছুদিন আগেও ঠান্ডুকে দেখলে বান্ধবীদের বলত, অই দেখ আমার বাপ শালা মেয়ে চাটছে। মনে কয় আবার বিয়ে করবে। চল্? চল্? পলাইয়ে যাই।
মোতিকে তালাক দিয়ে তিন তিনবার বিয়ে করেছে ঠান্ডু। আরেকটি সন্তান তো দূরের কথা, একটি বিয়েও বছরখানেক টেকেনি। আত্মীয়স্বজন পাড়ার লোকরা আর বিয়ে করার কথা বলে না। একলা বাড়িতে একলাই থাকে সে। আজকাল নামাজ-রোজায় মন দিয়েছে। অনুতপ্ত ঠান্ডু মোতির কাছে শতবার ক্ষমা চেয়েছে। পা ধরেছে। কিন্তু ধুরধুর করে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে মোতি। শাকপাতা খেয়েছে তবু কখনো হাত পাতেনি। ঠান্ডুও দুই ঈদ ছাড়া কখনো কিছু দেয়নি। মোতির আবার গুমর বেশি। ঠান্ডু ওর সঙ্গে পারে না। তবে আজকাল কেন যেন মেয়ের জন্য ওর মন নরম হয়ে গেছে। মেয়েকে এক পলক দেখলেই ওর মন ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আগের মতো, কতশত কল্পনা জেগে ওঠে। ঠান্ডু বোঝে, কী যেন হয়েছে ওর। এক দিন না দেখলে বুকজুড়ে হাহাকার নেমে আসে। ওর বিশাল বড় খালি ঘরে মোতি আর তাতিয়ানার কথা মনে পড়ে যায়। মোতিমালা এখন পরনারী। দেখা করতে হয় লুকিয়ে-চুরিয়ে। অনেক সাধ্য সাধনার পর রাজি হয়েছে। ঠান্ডুকে মাঝেমধ্যে ঘরেও আসতে দিচ্ছে। তবে সে সবকিছু হয় রাতদুপুরে। অন্ধকারে। চোরের মতো। তালাক দেওয়া বউয়ের কাছে সে যে পরপুরুষ এখন!
তাতিয়ানা এবার ক্লাস নাইনে। আগে বাবাকে দেখলে খারাপ খারাপ গালি শুনিয়ে লজ্জা দিত। কখনো সামনাসামনি পড়ে গেলে ঘেন্নায় মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যেত। একেবারে ঠান্ডুর মতো পচাগলা গালি শিখেছে মেয়ে। স্বভাবেও বাপ কা বেটি, রগচটা আগুনেশ্বরী। আজকাল একটুখানি নরম হয়েছে। তাতিয়ানা এখন ঠান্ডুকে দেখলে নরম চোখে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি সরে যায়। স্নেহমায়ার যে অসীম ক্ষমতা, ঠান্ডু নিজেও এখন বোঝে।
তার মেয়েটা ছিল স্নেহের কাঙাল। সাত বছর পর্যন্ত ঠান্ডুর হাত ধরে ঘুরত। ঠান্ডুই রাগের মাথায় সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। পুরোনো দিনগুলো ভেবে ঠান্ডুর কান্না পায়। একা ঘরে সে কেঁদে ভাসায়। কোনো কোনো সময় ঘরে অথবা মসজিদে বসে রাত-দিন কেঁদে চলে। মোতির ভাই বাদলের কাছেও অনুনয় করেছে। যদিও আলগা টাকার গরমে আগের মতো সম্মান দেখায় না বাদল। ঠান্ডুর বড় ভয় হয়, টাকার লোভ সাংঘাতিক লোভ। লোভে পড়ে বাদল যদি তার মেয়েকে কোনো গুণ্ডাপাণ্ডার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়! ওর ইচ্ছা মেয়ে পড়াশোনা করুক। মোতিকে সে বলেছে, তোর সঙ্গে সম্পর্ক নাই তাতে কি! আমি তো ওর বাপ। যতদূর সম্ভব আমার মেয়ে পড়াশোনা করবে। ওর বিয়ের কথা মুখেও আনবি না তুই। আর যদি পারিস ঘেন্নাপিত্তি করে আমারে মাফ করে দিস।
ডান কাতে শুয়ে আছে ঠান্ডু। মোতি বোঝে ঠান্ডুর তেজ শেষ হয়ে গেছে। তার শরীর খোবলানোর আগেই ঝুলঝুলে ন্যাতা মেরে গেছে। এখন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। যেন কতকাল ঘুমায় না অমানুষটা।
ভোরের বাতাস এসে মোতির বুক ছুঁয়ে যায়। মায়া লাগে ওর। ছোট্ট তাতিয়ানাকে বুকের ওপর বসিয়ে রোজ ভোরে ঠান্ডু গান গাইত। মেয়েও ঠিক সুরে উউউউউ করে গাইতে চেষ্টা করলে দারুণ খুশি হয়ে বলত, মোতি রে মোতি, আমার মেয়েরে আমি গায়িকা বানাব। বিশাল গায়িকা।
আর গায়িকা! জানালার পাল্লা খুলে দিয়ে মোতি ভাবে, তাতিয়ানা এখন নটি হচ্ছে। ছেলেদের ভাঙিয়ে এটাসেটা খেতে, পেতে শিখে গেছে। কিছু বলতে গেলেই পনেরো বছরের মেয়ে এমন ঝাঁকি দেয় যে, চুপসে যায় মোতি। ভালোর ভালো এটুকুই, পড়াশোনায় দারুণ মাথা। সেই মেয়ের তিন মাসের বেতন বাকি পড়েছে। ঠান্ডু কি বোঝে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ালে, সমাজের লোকজন তাতিয়ানাকে ঠান্ডুর মেয়ে বলেই জানবে?
মায়ার সঙ্গে একরাশ অভিমান জমে যায় ওর বুকের ভেতর। ফজরের আজান পড়ছে। একটু পরেই মুসল্লিরা বেরিয়ে আসবেন। ঠান্ডুকে সে ডেকে দেয়, এইযে শুনতিছো, তাতুর বাপ। ওঠো। ওঠো দেখি। কেউ দ্যাখপার আগি তাড়াতাড়ি চলি যাও! নইলে আবার ঝামেলা ঘটে যাবে নে।
ঘুমের মাতালে জাগতে ইচ্ছে করে না ঠান্ডুর। মনে হয় শুয়েই থাকে। কি আর ঝামেলা হবে। ঠান্ডু যে মোতিকে আবার তার বউ করে ঘরে নিতে চায়, এ খবর তো সবাই জানে। মসজিদের ইমাম কতবার মোতিকে বুঝিয়েছে। মোতি কিছুতেই রাজি হয় না। আজকে একটা হেস্তনেস্ত হয় যদি হয়ে যাক।
কিন্তু শুয়ে থাকার সাহসও হয় না ঠান্ডুর। যদি নতুন করে মোতি আর তাতিয়ানা আবার হারিয়ে যায়! যা কিছু অন্যায় সে তো নিজেই করেছে। লোকে যে বলে, রাগ চণ্ডাল। লোকের কথা সত্যি প্রমাণ করে সে যে বেকুবের মতো ঘুরে মরছে!
ঘেয়ো কুকুরের মতো উঠে বসে ঠান্ডু। ঘুমচোখে জুতো পরে ধুঁকে ধুঁকে হাঁটে। হোঁচট খায়। হাঁটু চেপে ধরে। একটু দাঁড়ায়। পেছনে তাকায়। সুপারিগাছের পাশে মনে হলো যেন মোতি দাঁড়িয়ে আছে! মাথায় ঘোমটা! আহা, মোতির শরীরটা হাড়সর্বস্ব হয়ে গেছে। কেমন অসহায়ের মতো ওর বুকের কাছে নরম কাদার মতো ঘুমিয়েছিল। মেয়ের নাম করে সামনে মাস থেকে কিছু টাকা দেবে ঠান্ডু। নিয়মিত দেবে। ইশকুলের বেতন, প্রাইভেট আর কোচিং করাতে হবে তাতিয়ানাকে। দোকানে বসতে যদি ভালো লাগে তো বাপের গদিতেই বসবে তাতিয়ানা। মেয়ে তো তারও। ঠান্ডুর যাবতীয় সবকিছুর মালিক। হারুন মাস্টার সেদিন কত প্রশংসা করলেন তাতিয়ানার।
নিজের শূন্য বাড়ির বারান্দায় উঠে চোখে জল আসে ঠান্ডুর। সেদিন কি যে হয়েছিল! কেন যে সে রাগের মাথায় মোতিকে তালাক দিয়েছিল! শুদ্ধ বাইন তালাক!
"