সিরিজ কবিতা
এনাম রাজুর মা-বিষয়ক নাকফুল
এক.
পাখি পোষেন মা, আপসও পোষেন। পোষা পাখির ডানা থাকে না। মা নিজেও তাই। সংসারে ডুকে গেছেন ওড়ার আগে। সংসার বলতে তিনি ছবি আঁকা বোঝেন। যাতে শুধু রঙের খেলা। একবার মাকে জিজ্ঞেস করেছি- মা সংসার বলতে কী বোঝো? উত্তরে বলেন- এটা অদৃশ্য একটা মায়াঘর। যে ঘরের ঢুকতে নানা হিসাব কষতে হয়, অসংখ্য দরজা দিয়ে প্রবেশের আমন্ত্রণ থাকলেও বেরোনোর দরজা নেই। বিষয়টি শুনে অরবিন্দ বলেছিল- মাজি, এটা গোরস্তান! মা তখন আমাদের ঈশ্বর চেনাতে তার আঁকা ছবি দেখতে বলেন।
দুই.
মা বুকের বামে ছবি আঁকেন। আঁকাআঁকির হাত ভালো জেনেই এক দিন, একদল বাঘ উঠানে উপস্থিত। তাদেরও ছবি আঁকেন। কী সুন্দর। মানচিত্রের মতো ডোরাকাটা। কোনো হিংস্রতা নেই। আমি মায়ের কাছে আবদার করি, আমার ছবি আঁকতে। একজোড়া ডানা আঁকতে। আকাশে উড়তে না পারলেও অন্তত একজোড়া ডানা থাকুক ছবিতে হলেও। মা বললেন, আমি সন্তানের ছবি আঁকি না, তার ডানা হোক চাই না। সে আমার বুকে থাকে।
তিন.
মা নাকি ঘনঘন স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন দেখেন। আমি ডুবে মরি হাঁটুসমান জলে, উঠানের পুকুরে। তাই মা পুকুরজলে দুধ দিচ্ছেন। বাড়িতে মিলাদ হচ্ছে। হুজুরের হাসিভরাট মুখ। কাঙালের পেটভরা সুখ। কেউ কেউ খাবারের অতৃপ্তি নিয়ে কটুবাক্য ছুড়ছে আড়ালে-আবডালে। এসব দেখে আমি ও আমার লাশ উঠানে বসে কাঁদি। মা জানেন না, আমার মতো কত সন্তানের জন্য বিদ্যাশ্রম তৈরি হয়েছে। অথচ মা ও বাবা প্রায়ই দুঃস্বপ্নের চেয়ে অনেক বেশি সুখের ছবি আঁকেন।
চার.
প্রেমের যে ছবি আপনার বুকে আঁকা। সেরকম আমার ও মায়ের একটা গোপন গল্প আছে। যেদিন গল্পটা বেঁধেছি, সেদিন ভরাট জোছনা আর ছিল তারার মেলা। বয়স কম হওয়ায় প্রজাপতি হই আর বোতলবন্দি করি একটা জোনাকিপোকার দলকে । সারারাত নিজের সাথে নিজের তুমুল আড্ডা হয়। যখন সকাল। প্রভাতি রোদের আলোয় পৃথিবী আলোকিত, ধ্যানজ বক, মকতবে যাচ্ছে ছোট শিশুরা। তখন দেখি- জোনাকির আলোর মতো আমার গল্পও অস্পষ্ট। যাকে নিয়ে গল্প, সে নিজেই গল্প বেঁধেছে। অপরিপক্ক গল্প। যে গল্প লিখেছে অন্য কেউ, যে গল্পের মূল চরিত্র নিজেই অচল ঘড়ির মতো। এ গল্প আমার মা নিজেও বলতেন আমাদের। তিনি বলতেন- অদৃশ্য কিছু বাক্য বিনিময়ে এ গল্পের চূড়ান্ত পরিণতি। কেউ বিসর্জনের ইতিহাস লেখে, কেউ পায় সমৃদ্ধি। মা তসবিহ হাতে বিবাহ-বিষয়ক একটি ফুলের ইতিহাস সেই রাতে আমাকে বলেছিলেন।
পাঁচ.
যে ফুলটি নাকফুলে দেবে বলে হাতে রেখেছ। সেটা নিশ্চয়ই কবর বাগানের। সেই বাগানে পাশাপাশি বসবাস করা গোলাপ ও ডালিমগাছ বাংলায় কথা বলে। একারণেই মা ডালিম পছন্দ করেন, গোলাপ চুলে বাঁধেন। বিষয়টি তিনি কখনো বুঝতে দেননি। গাছ দুটো আমার ভাইয়ের কবরে বসে আছে। প্রতিদিন কত পাখি আসে-যায়, কথা বলে, গান ধরে; ভাইয়া সেসব শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে থাকে। সে এক অনন্ত ঘুম।
ছয়.
নাকফুল, একজোড়া চুড়ি ও একজোড়া কানের দুলের পরিচিতি পর্বের মাধ্যমে আমার প্রাথমিক শিক্ষার পর্ব শেষ হয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে ছিল তা। যখন পাখি ও পশু, গাছ ও পানির পার্থক্য বুঝলাম। আরো পরে যখন তাদের প্রণয় ও পরিণয় এবং বর্ণমালা শিখলাম। মাকে আমার শিক্ষার ধরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন- নাকফুল, চুড়ি ও কানের দুল তোর প্রবাসী বাবার প্রতিনিধিত্ব করে।
"