আলমগীর খোরশেদ

  ০২ জুন, ২০২৩

হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ ঐতিহ্য

চিঠি : আমরা যারা ষাটের দশকে গ্রামে জন্ম, তখন কারো সঙ্গে যোগাযোগ, ভাবের আদান-প্রদান হতো চিঠির মাধ্যমে। তখন শিক্ষিত পরিবারের ছেলেমেয়ে পত্রমিতালি করত, যা পোস্ট অফিসে ডাকযোগে চিঠি দেওয়া-নেওয়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেত।

চিঠির বিষয়টা আবেগীয়। আত্মার বন্ধনের একটা সুতো যেন চিঠি। যেদিন থেকে মানুষ অক্ষর বা লিপি আবিষ্কার করতে শিখেছে, সেদিন থেকে তার প্রিয় মানুষকে মনের কথা মুখে বলার লাজুকতা ও ভয় থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছে চিঠির। রামায়ণ, মহাভারত ও গ্রিক পুরাণে চিঠির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। চিঠিতেই থাকে না-বলা কথা, যা মনের সত্যিকার নির্যাস।

চিঠিপত্র : ইন্টারনেট, মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার আগে মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ গাছের পাতায়, গাছের ছাল-বাকলে, পশুর চামড়ায়, ধাতব পাতে চিঠি লিখে মনের ভাব প্রকাশ করত। চিঠি লেখায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে গাছের পাতা, তাই এর আরেক নাম হয় পত্র।

চিঠির গুরুত্ব : চিঠি হলো আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যা বাঙালির জীবনে জড়িয়ে আছে জড়িতা লতার মতো। চিঠির আবেদন, আবেগ অন্য কিছুতে মেলে না, মিলবেও না কোনো দিন।

চিঠির রকমফের : আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা পারিবারিক কারণে একে অপরকে লেখা চিঠি ব্যক্তিগত পত্রের অন্তর্ভুক্ত। বাবা তার ছেলেকে, দূরে থাকা ছেলেকে মায়ের, পরিবারের সদস্যদের মাঝে বিনিময় করা পত্রাবলি।

প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবসা-সংক্রান্ত, অভিনন্দন, নিমন্ত্রণ ইত্যাদি চিঠি ব্যবসায়িক বা ব্যবহারিক পত্র।

জাতীয় ও সামাজিক পত্র : পত্র-পত্রিকায় বর্তমান ও জাতীয় ইস্যুতে লেখালেখির জন্য সামাজিকভাবে খোলা চিঠির কলাম রাখা হয়।

চিঠি লেখার উদ্দেশ্য : মনের ভেতরে উসকুস করা কথাটি কাউকে সরাসরি বলতে না পারলে তা চিঠিতে লিখে প্রকাশ করা হতো। অদ্ভুত একটা টান ছিল কালি ও কাগজে লেখা কালো অক্ষরে সাদা কাগজকে সাজিয়ে মনের কথা লেখা চিঠিতে।

ভালোবাসার প্রথম চিঠি : মানুষ কোনো না কোনো সময় জীবনে প্রেমে পড়ে। প্রেমের ফাঁদ পড়া ভুবনে কখন কাকে ভালো লেগে যায়, কার মনকে সবার অজান্তেই ছুঁয়ে দেয় মন, বলতে পারে না কেউ। ষাটের দশকে যাদের জন্ম, তারা ইন্টারনেট মোবাইল দেখেনি। ভালোলাগা মানুষকে প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দিতে চিঠির বিকল্প ছিল না। নীল রঙের চিঠির প্যাড, ওপরে ডান কোণে দুটি উড়ন্ত পাখির ছবি, পাখির ঠোঁটে চিঠি। চিঠির প্যাডের মাঝখানে লাভ চিহ্নের জলছাপ। নিচে লেখা- ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভুলে না মোরে।’

ভালোলাগা মানুষের চিঠি স্পর্শ করা মানে প্রেরক মানুষের অনুভূতিকে ছোঁয়া। তখন চিঠি কেবল কাগজ নয়, কলম, অক্ষর, আবেগ মিলেমিশে থাকতো, অপেক্ষা নামের আকুতি নিয়ে।

মনের মানুষের চিঠি কখন আসবে, ডাকযোগে আসলে পিয়নকে বকশিস দিয়ে আগেই বলে রাখা, পারিবারিক ঠিকানা না দিয়ে কোনো দোকানের বড়ভাইয়ের ঠিকানা, বড়ভাইকে ম্যানেজ করা। চিঠিতে কি লিখেছে ও, থাকবে তো সারা জীবন আমার হয়ে? চিন্তার ঘুরপাকে নির্ঘুম রাত সকাল হতো। চিঠির অপেক্ষা যেন শেষ হয় না। সময়ের একক যেন ষাট সেকেন্ডে নয়, ঘণ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চিঠি পেয়েই এক দৌড়ে নিরাপদ জায়গা টয়লেটে। বদনা নিচে রেখে চিঠি পড়া। একবার নয় সাত আটবার চিঠি পড়েও যেন শেষ হতো না। তখনকার আমলের চার নম্বর প্রভাতী খাতা পুরোটাই একটা চিঠি। দীর্ঘ সময় টয়লেটে থাকায় ডাক পড়তো- ‘টাটকির (টয়লেটের) ভিত্তে (ভেতরে) কেলা (কে) রে অতক্ষণ (এতক্ষণ)?’

কত আবেগ ভরা চিঠি : অনেক রাত জাগা নীল জোছনায়, অঝোর বৃষ্টিতে, ফুল ফোটা বসন্তে, বাংলা বা ইংরেজি নববর্ষে একটা চিঠি সঙ্গে সুন্দর জোড়া কপোত-কপোতী বা স্কেচ করা যুগলের ভিউকার্ড, অনেক আবেগে, আবেশে, ঘেমে যাওয়া কাঁপা কাঁপা হাতের লেখা, ঘামে লেপটে যাওয়া কালিতে মুছে যাওয়া অক্ষর, ভয়ে কোমরের খোঁচড়ে রাখা দুমড়ানো মুচড়ানো কাগজ খুলে পড়া, মিশে থাকা ওর ঘামের গন্ধ, চিঠির সম্বোধনে লিপস্টিক লাগানো কড়া লাল ঠোঁটের চিকন মাংসের ভাঁজ, চিঠি খুলতেই ঝড় ঝড় করে নিচে পড়ে যাওয়া পাউডারের গুঁড়ো, সঙ্গে অনেক লাল গোলাপের পাপড়ি। তাড়াতাড়ি নিচ থেকে উঠিয়ে লুকিয়ে রাখা। নীল কাগজ, নীল খাম, লাইনে লাইনে ‘চিরসাথী’ হয়ে থাকার এত প্রতিশ্রুতি, আহা! কি অকৃত্রিম ভালোবাসা।

চিঠি পাঠানো ও বৈরিতা : কি লিখতে হবে, কি লিখলে ও খুশি হবে? কোনো বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করতে ফিসফিস কথা, হঠাৎ হেসে লুটোপুটি, পরক্ষণই রাগ- ‘শালা ও আমার, তোর না।’

মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়া সময়ে চিঠি লেখা শেষ হয়। লেখা চিঠি লুকিয়ে রাখাও বিপদ, কার হাতে পড়ে। জুতোর ভেতর, শার্টের কলারের পকেটে রেখে টেনশনে রাত পার। সকালে ভাতের আঁটা দিয়ে খামের মুখ বন্ধ করার পর বাড়ির বিশ্বস্ত কাজের লোক, বন্ধু বা বান্ধবী, ছোট ভাই, বোনকে চকলেট সঙ্গে নগদ টাকা দিয়ে তারপর হাতে হাতে চিঠি পৌঁছানো। তাতেও দুশ্চিন্তা। একটা দিয়ে আরেকটা আনা। বেশির ভাগ সময় বই বা প্রাইভেট খাতার ভেতর গুঁজে দিয়ে চিঠি আদান-প্রদান চলত। স্কুলজীবনে কয়েকজনকে ধরা পড়তে দেখেছি, স্যারের কাছে। হেড স্যার ছেলেমেয়ে উভয়পক্ষের অভিভাবক ডেকে এনে বিচার করেছেন, সবার সামনে বেত্রাঘাত দিয়ে।

যারা লিখতে জানত না : গ্রামে প্রায়ই অনেক ফরমায়েশি চিঠি লিখতে হতো। বৌ ঝিরা তাদের বর বিদেশে বা বাড়ি থেকে দূরে থাকায়, ওদের একটা চিঠি লিখে দিতে অনেক সমীহ, এটা সেটা খাওয়ানো ও মেনে চলত। বউরা গ্রামের অশিক্ষিত নারী। বলতেও পারেন না কি লিখবেন। নিজের ভাষায় লিখে পড়ে শোনাতাম। ওরা অনেক লজ্জা পেতেন বুঝতাম। খারাপ লাগতো, আহারে, ওদের কত কথা হয়তো মনে জমা, প্রকাশ করতে পারছেন না।

চিঠি নিয়ে শেষ কথা : কবুতরের পায়ে চিঠি বেঁধে বন্ধুকে পাঠানো সেকেলে হয়ে গেছে। একটা চিঠি নিয়ে গলির মোড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ওপাড়ার ছেলেদের হাতে পিটুনি খেয়েও থেমে থাকেনি ভালোবাসা। চিঠির মধ্যে যে তীব্র মায়া, আবেগ, ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে, তা মানুষ ভুলে গেছে। ডিজিটাল যুগের স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, প্রেমিক-প্রেমিকারা আর চিঠির জন্য অপেক্ষায় থাকেন না। মধ্যরাতে এসএমএস আসার রিংটোনে ওরা বিভোর হন, তাইতো আজকের সম্পর্কগুলোতে টান নেই, মায়া নেই, আবেগ নেই, কেবল লোক দেখানো। একত্রে দীর্ঘদিন সহাবস্থানের ফলে যতটুকু হয়, তা-ই বুকের ভেতর পুষে রেখে গেঁথে যায় যাপিত জীবনের পদাবলি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close