আলম মাহবুব

  ০২ জুন, ২০২৩

কবি ও কবিতা : সোহরাব পাশা

খণ্ডিত হওয়া তার কাম্য নয়, কবি চান পরিপূর্ণতা। ভেতরে একটুখানি নীল নয়- সমস্ত আকাশ। কবিতার ভেতরে কবি মূলত নিজেকেই আবিষ্কার করেন। তিনি তার নিজের জগৎ, সৌন্দর্য ও রূপ নিয়ে কথা বলতে চান। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘আমি রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি/ অরূপ রতন পাব বলে’। রূপের ভেতরে অরূপের- অপরূপের নিরন্তর অন্বেষণ করেন কবি। কবির অভিজ্ঞতা ভালো লাগা খারাপ লাগা, ভালোবাসা-ঘৃণা- সবই তার অন্তর্গত বিষয়- নিজের জিনিস। কবি অন্যদের মাঝে বেঁচে থাকতে চান- স্বপ্ন দেখেন নিজের মতো করে। নিজের আঁকা ছবি- রং যেন অন্যের সঙ্গে না মেলে।

যার কথা বলছি- বাংলা কাব্য জগতের একটি বিশিষ্ট নাম সোহরাব পাশা। কবি সোহরাব পাশা সত্তর দশকের মাঝামাঝি বাংলা কবিতায় নিরন্তর প্রবহমান ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এগিয়ে আসেন নিজস্ব পথ আবিষ্কারে আশির দশকের শুরুতে তিনি পরিপূর্ণতায় প্রস্ফুটিত হন।

সোহরাব পাশা তার সময়ের ফুল ও পোকাণ্ডমাকড় বারুদ ও বৃষ্টি হাতে ধরে নিজস্ব ভঙ্গিমায় দৃঢ় প্রত্যয়ে কবিতার আঙিনায় পা রাখেন। একদিকে তিনি প্রাচীন ঐতিহ্যকে পরম মমতায় ধারণ ও লালন করেছেন, অন্যদিকে সময়ের আনন্দ-বেদনার বোধ তাকে সাম্প্রতিক সময়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছে। তার কবিতার পঙক্তিতে উচ্চারিত- ‘মানুষ দেখার কোনো আয়না নেই ঘরে/ শিলাস্তরে নৃ-তত্ব খোদাই কাজে কেটে গেছে/ বহুকাল/ মেঘের লতাণ্ডপাতা ছিঁড়ে নক্ষত্রের শিল্পকলার- / ক্যানভাসে এঁকেছে ভুল মানুষের মুখ।’ (আয়না, ভুল মানুষের ভিড়ে)।

এ কবি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী পথ অবলম্বন করেছেন এবং তার সময়ের বিপরীতে তার নিজস্ব জগৎ তৈরি করতে পেরেছেন। তিনি অনুসরণ করেননি ঔপনিবেশিকতার সংকীর্ণ গলি-পথ। প্রকৃতি বিসর্জনের পূজায় তিনি নানা বর্ণিলভাবে পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন তার পঙক্তি- ‘নতজানু বৃক্ষগণ/ বাতাসের ঠোঁটে নেই নিবিড় ক্লাসিক/ মেঘশূন্য নিখাত গর্জন চারিদিকে/ পা থেকে অনেক দীর্ঘপথ/ এ অচেনা শহরে তুমি/ রচনা করেছো অন্য এক স্বপ্নবাড়ি/ আমি কার বাড়ি ডাক দেব।’ (ঘর, কেউ বলে না কিছুই)।

সোহরাব পাশার কবিতা মননশীল- আছে বিষয়বৈচিত্র্য ও প্রখর শিল্পবোধ। পার্থক্য বিশ্লেষণে তিনি ভাষা ব্যবহারে নিপুণ শব্দ চয়ন, প্রতীক, রূপক ও মিথের আশ্রয় নিয়েছেন। রূপক ব্যবহারে তিনি কৌশলী- জীবনানন্দ বা রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করেননি। এ কবি উপমা, রূপক ও চিত্রকল্প ব্যবহারে অনন্য, সাবলীল। তবে তার কবিতার চিত্রকল্প দৃশ্যত সহজ মনে হলেও ভেতরে নিহিত থাকে গভীর দর্শন, যা পাঠককে মুগ্ধ করে দীপ্র-দীপ্তির দ্যোতনায়। উদাহরণ দেওয়া যায়- ‘তৃতীয় ছায়ার নিচে ঘুমায় মানুষ/ মেঘ খেলে ঘুম খেলা ধুম বৃষ্টি জলে/ (স্বপ্ন বৃত্তান্ত,/আমার সমস্ত গন্তব্যে তোমার বাড়ি) অথবা ‘অমীমাংসিত সব নৈঃশব্দ্যের গল্প/ ছায়ার অসুখ- খুঁজে খুঁজে বেলা যায় বাউলের।’ (বাউল/ঐ)।

সত্যি কথা বলতে কি, কবিতা কবি লেখেন না, কেউ যেন কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। সোহরাব পাশা কবিতার মাধ্যমে এর অনন্ত জন্মরহস্য অনুসন্ধান করেছেন। আর এখানেই তার কবিতার নান্দনিক পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন- কাল-সমকাল-মহাকালে সূচিত হয়। কবিতাও ওই প্রেক্ষাপটে রচিত হয়। তার কবিতার ক্যানভাসে ফুটে ওঠে- মানুষ, প্রকৃতি, দেশ ও প্রেম। তার ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হয়- ‘মানুষ কী এখন নিজেকেই খুব ডাকছে একা/ তীব্র অন্ধকারে/ খুঁজে মরছে আলো ও ছায়ার শেকড়।’ (দূরত্ব, কোথাও কে নো বন্ধু নেই)।

সোহরাব পাশার কবিতায় নান্দনিকতার মূল বিষয়বস্তু প্রেম, সৌন্দর্য চেতনা, প্রকৃতি, সময়, বিচ্ছিন্নতা ও নগর চেতনা। গ্রাম ও শহর সমানভাবে চিত্রিত হয়েছে তার কবিতায়। তিনি বলেন, ‘কোথাও স্টেশন নেই, ধূসর মেঘের কিনারায়/ অচেনা শহর অনাত্মীয় লোকজন দূরের নিকটে যায়/কেউ কোথাও দাঁড়িয়ে নেই/ ব্যস্ততার বড় ভিড়।’ (কেউ কোথাও দাঁড়িয়ে নেই, চোখ ফেরালে মাধবী নেই)। তার কবিতার অন্তঃপুরে তুমুল কোলাহল করে নারী। বারবার ট্রেন ফেল করা সে নারী। দূরতমা সে নারী। বিকেলের হলুদ বাড়িতে মাঠের ওপারে জানালায় চোখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকা নারী। - ‘সে চোখের আগুনে বৃষ্টি পুড়ে যায়।’ (দুই জীবনের দাঁড়ি কমা, চোখ ফেরালেই মাধবী নেই )। এ কবির কাছে ‘নারী এক বিস্ময়কর কবিতা- যার কোনো বিরাম চিহ্ন নেই।’

মানুষ মহাবিশ্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও সভ্যতা ও প্রযুক্তি মানুষকে বিশ্বজগৎ থেকে দূরে রাখতে চায়, তাদের মনে অবচেতনে বাস্তবে এই মহাবিশ্বই তাদের আইডল- প্রাণ ভোমরা। এ কবি তার প্রায় প্রতিটি কবিতায় উপমা-চিত্রকল্পকে মহাবিশ্বে তার অস্তিত্বের উপস্থিতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বিগত জীবনের স্মৃতি নস্টালজিক মন, আগামীর পথে দূর ভ্রমণে যায়। স্বপ্নময় মুহূর্তগুলো মহাজাগতিকতার পোলিশের সঙ্গে জ্বলজ্বল করতে চায়- ক্রিয়াশীল পে-ুলামে। তার উচ্চারণ- ‘কোলাহল মুখর ছিল গতকাল দীর্ঘ দুপুর/ সারাটি দিন খুঁজে ফিরি যাপনের সেই অতীত/ ব্যবহৃত শব্দাবলি প্রতি মুহূর্তেই ইতিহাস।’ (কোথাও কোনো বন্ধু নেই, কোথাও কোনো বন্ধু নেই)।

প্রেম চিরন্তন। কবি তার কবিতায় প্রেম এনেছেন শাশ্বত জীবনের। প্রেমবিচ্ছেদের পানসিতে জীবনের নানা রং খুঁজেছেন তিনি। প্রাপ্তির বইটি অসম্পূর্ণ হলেও পরম ভালোবাসার বইটি সমৃদ্ধ করেছে কবি হৃদয়কে। ‘যদিও জীবন ছিল একটি আঁকাবাঁকা সময় তাতে মৃত্যুর কোনো দীর্ঘ গল্প ছিল না। পাথরের চোখে ছিল না নীরবতার আক্রোশ। তাতে ছিল স্পর্শহীন চুম্বনের দীপ্তি- ঘ্রাণের পাপড়ি- প্রফুল্ল কোলাহল।’ তার কবিতা অভিজ্ঞতার রঙে রাঙানো- কারণ সেগুলোর রং, সুর, স্বপ্ন, মহাজাগতিক জীবন থেকে নেওয়া।

পাশার কবিতার মূল ভূমি ভিত্তিও বিষয়বস্তুর সমন্বয় পাঠকের মনে গভীর সংবেদন ও অনুরণন সৃষ্টি করে- ফুল-পাতার সবুজ ঘ্রাণ আর নদী-পাখির সুমধুর শব্দ-কোলাহল। একজন প্রকৃত কবির মনন ও শেকড় তার প্রিয় জন্মভূমির মাটিতে প্রোথিত। পাশা প্রকৃত কবি বলেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন অনেক কবিতা- এর রক্তাক্ত ইতিহাস এবং বাঙালির সুমহান কীর্তির কথা। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের কবিতা।

সূক্ষ কারুকাজে জড়ানো তার কবিতা অন্ধকারের অনুভূতিতে ভরা। তিনি তার কবিতায় প্রকৃতি, বিশ্বজগৎ, মিথ, প্রেম, নারী এবং অতীত জীবনকে নানা অনুষঙ্গে অলংকৃত করেছেন। তাই তার কবিতা আত্মোপলব্ধির কবিতা- গভীর দর্শন নিহিত আত্ম আবিষ্কারের কবিতা।

সোহরাব পাশার কাব্যজগৎ নান্দনিক- সুন্দর, ঐশ্বর্যে-সৌন্দর্যে ভরপুর। এ পর্যন্ত কবির আঠারোটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যে কথা বলতে গেলে বাংলা কবিতার জগতে অন্যতম নাম কবি সোহরাব পাশা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close