আলমগীর খোরশেদ

  ২৬ মে, ২০২৩

হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ ঐতিহ্য

গ্রামদেশে অসুখ-বিসুখ ও চিকিৎসা : বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রাম শিল্পীর তুলির আঁচড়ে ক্যানভাস হয়ে উঠলেও চিকিৎসাব্যবস্থা তেমন ভালো ছিল না। আমরা যারা মধ্য বয়সে, জন্ম হয়েছিল গ্রামে, তখন চিকিৎসা বলতে কবিরাজ গাছগাছড়া, লতাপাতা চেঁছে তার রস ব্যবহার করেছেন ওষুধ হিসেবে।

কবিরাজ (সাধারণ রোগ) : আমাদের গ্রামে একজন নামকরা কবিরাজ ছিলেন। তিনি রোগীর কবজির নিচে শিরায় ধরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে রোগীর শরীরে কোথায় কি সমস্যা, তা বলে দিতে পারতেন। তার বাড়িতে গেলে দেখতাম- নারীরা পাটায় বিভিন্ন গাছ, মূল, পাতা বাটছেন, যা দিয়ে কবিরাজি ওষুধ বানানো হবে।

মা-শিশুরোগের চিকিৎসক : আমাশয় হলে থানকুনি পাতার রস, কাশি হলে তুলসীপাতা ও আদার রস এবং মধু; বাচ্চাদের ঠাণ্ডাজনিত কারণে আকন্দ পাতার সেঁক, কৃমি হলে আনারস পাতার রস চুনের পানি, পুরাতন আমাশয়ে বেলের কড়ি পানিতে ভিজিয়ে খাওয়া, হাত-পা কেটে গেলে গেন্দাফুলের পাতা হাতে ঘষে রস বের করে ক্ষতস্থানে লাগানো, শরীরের কোথাও পুড়ে গেলে ডিম ভেঙে পোড়া জায়গায় লাগানো, বল্লা কামড় দিলে চুন লাগানো, কুকুর কামড়ালে বেগুনের ফুল লবণ দিয়ে খেতে হবে- এসব চিকিৎসা যেন আম্মার মুখস্থ ছিল। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টিতে কাদায় হাঁটা যেত না। পায়ের আঙুলের চিপায় ঘা হয়ে যেত। পাটশোলা দিয়ে ঘষে দুই আঙুলের চিপা চুলকাতাম। সাদা চামড়া সরে গিয়ে পায়ের লাল মাংস দেখা যেত। আম্মা রাতে শোয়ার সময় আঙুলের চিপায় কেরোসিন তেল লাগিয়ে দিতেন। শীতকালে আমার প্রায়ই গাল ফোলে যেত। আম্মা আমাকে গলায় খাওয়ার চুন এবং উইপোকার মাটি এনে পানিতে গুলে ফোলা গালে পেস্টের মতো লাগিয়ে দিতেন।

কবিরাজ (জিন-ভূতের জন্য) : আমাদের গ্রামের পাশেই সনমানিয়া গ্রামে একজন কবিরাজ ছিলেন, যিনি গাছগাছড়া নয়, তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, তেলপড়া, পানিপড়া, তাবিজ-কবজ দিতেন। সাদা ধবধবে দাড়ি, পাজামা-পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে প্রায়ই আসতেন বাড়িতে। আমাদের কাজের মেয়েকে ভূতে ধরত, তার জন্য তাবিজ দিতেন। বাড়ির প্রবেশ দ্বারে মাটির নতুন ঢাকনায় সুরার আয়াত লিখে টানিয়ে রাখা হতো। নবজাতক রাতে কান্না করলেই এটা নজর, ভূতের দৃষ্টি বলে ধরা হতো এবং সে অনুযায়ী তাবিজ, তেলপড়া দিতেন কবিরাজ। তিনি বাড়িতে আসলে ভয় পেতাম, জিন-ভূতের কথা মনে করে। তার সঙ্গে থাকা পুঁটলায় জিন আছে, এমন একটা ভয় কাজ করত।

হাড়ভাঙা কবিরাজ : আমাদের পাশের গ্রাম পাটুয়াভাঙ্গায় হাড়ভাঙা চিকিৎসক ছিলেন একজন। সবসময় লোকের ভিড় থাকত তার বাড়িতে। বাঁশের শলা দিয়ে ভাঙা হাত-পা জড়িয়ে রেখে গাছগাছড়ার ওষুধ লাগিয়ে রাখতেন। লতানো গাছ পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা হতো ভাঙা অঙ্গে।

এলএমএফ পাস ডাক্তার : পাশের গ্রামে একজন বয়স্ক এলএমএফ পাস ডাক্তার ছিলেন। যেকোনো ফোঁড়া কাটা, সেলাই, স্যালাইন পুশ, ইনজেকশন ও সাধারণ রোগে ওষুধ দিতেন। হাতে কপাল স্পর্শ করেই বলে দিতে পারতেন- শরীরে জ্বর কত ডিগ্রি। আমি বাড়িতে বড়শি দিয়ে পুকুরে প্রায়ই মাছ ধরতাম। বড়শির সুতায় বাঁধা শলাকা যা মাছ ডুবিয়ে দিলে ছিপ দিতে হয়, সেখানে বড়শি গেঁথে রাখতে গিয়ে শলাকা ভেঙে বড়শি আমার আঙুলে ঢুকে যায়। যতই টান দিই, বড়শি ততই কলে আটকে যায়। ব্যথা পাই তীব্র। অবশেষে এলএমএফ ডাক্তারের বাড়িতে গিয়ে আঙুল কেটে বড়শি বের করা হয়।

হোমিও ডাক্তার : আমাদের বাড়ির সামনেই হোমিও চিকিৎসা দিতেন ক্ষিতিষ ডাক্তার। হোমিও চিকিৎসায় একটা কাঠের বক্সে অসংখ্য ছিদ্র, তাতে থাকে হোমিও ওষুধের শিশি। শিশির মুখে কর্কে নাম লেখা কোনটা কোন ওষুধ। ঘরের বেড়ায় হোমিও চিকিৎসার প্রবর্তক ডাক্তার হ্যানিমেনের ছবি টানানো থাকত। বাড়িতে কারোর জ্বর আসলেই যেতাম ক্ষিতিষ কাকার কাছে। বোতলে পানি নিয়ে তাতে দুই ফোটা ওষুধ ঢেলে ঝাঁকি দিয়ে হাতে ধরিয়ে দিতেন। নিয়ম করে খেতে হবে। বোতলের গায়ে ষড়ভূজ আকৃতির কাগজের টেরিকাটা ব্যাজ লাগিয়ে বলতেন- ‘এইযে দাগ দেওয়া, এক দাগ করে খাইবাইন। ওষুধ খাওয়ার পর বিড়ি চুরুট খাওন যাইতো না, নিষেধ কইলাম।’

মেয়েলি রোগের কবিরাজ : ক্ষিতিষ ডাক্তারের মা মেয়েলি চিকিৎসা করতেন। গাছগাছালি দিয়ে। সারাদিন রোগী দেখে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। সাদা সুতি কাপড়, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ, টিনের কৌটায় নানা পদের কবিরাজি ওষুধ থাকত।

ভূত-পেত্নীর নারী কবিরাজ : জাদুটোনা, ভূত, জিনের আছর ছাড়ানোর চিকিৎসা করতেন পাশের গ্রামের জাদ্দোয়ানি বুড়ি কবিরাজ। বয়সের ভারে পিঠ কুঁজো হয়ে যাওয়ায় কষ্ট করে হাঁটতেন। বুড়ি জিন পোষতেন। নারীদের সর্বরোগের চিকিৎসা, ভূত তাড়ানো, ঝাড়ফুঁকের কাজে জাদ্দোয়ানির ডাক পড়ত।

জাদ্দোয়ানির জঁটা ধরা মাথার চুল, গায়ের রং কালো, বড়বড় চোখ, ভূত তাড়াতে মরিচ বাটার পাটার ওপর সীল রেখে তাতে বসতেন। কেউ একজন বুড়িকে সীলে বসিয়ে ঘুরান আর জিজ্ঞেস করেন-

- কি লাগবো কও মাসি?

- ভোগ লাগবো, ভোগ, বাতাসা।

- এক সের বাতাসায় অইবো?

- অইতো নাগো অইতোনা। সুর করে বলে যান জাদ্দোয়ানি।

- পাঁচ সেরে অইবো?

- ‘অইবো, অইবো’ বলে থামতন বুড়ি। আবার জিজ্ঞেস করা হতো,

- আর কি মাসি?

- বাতাসা, গজার মাছ, আল্লোয়ার চাউলের (আতপ চাল) ভাত দেওন লাগবো।

পরদিন বাজার থেকে দামাদামি না করে একদামে গজার মাছ, আতপ চাল এনে সিতাসাল মানে শ্বশানে গাবগাছের নিচে ভূতের জন্য ভোগ দিয়ে আসতেন।

আমাদের বাড়ির লজিং মাস্টার জালাল স্যার আমাকে নিয়ে গেলেন শ্বশানে। গিয়ে দেখি, মাছভাত সব দুইটা কুকুর মহানন্দে খেয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে এসে আম্মাকে জানালে বকা দিলেন- ‘তাইনেরা রাগ অইবাইন, কেরে গেছোস?’ তাইন মানে ভূত। তাদের সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে হয়।

পক্ষাঘাত রোগের কবিরাজ : পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস রোগীকে বাজনা বাজিয়ে ‘দোহাই আল্লাহ, দোহাই নবী (সা.)’ বলে চিকিৎসা দেওয়া হতো। কবিরাজ অশ্লীল ভাষায় বকাবকি করে রোগীকে পেটাতেন ঝাড়ু দিয়ে। ভালো হতেন কিনা জানা নেই।

গলায় কাঁটা ফোটা : গ্রামে অনেকের খাওয়ার সময় গলায় কাঁটা ফোটে যেত। এটা আমারও হতো। তখন আম্মা বলতেন ‘বিলাইয়ের পায়ো ধর’।

যতই কাছে গিয়ে বিড়ালের পায়ে ধরতে চেষ্টা করেছি, বিড়াল মিয়াও বলে চলে গেছে। অনেক প্রবীণ নারী মাছের কাঁটা দূর করতে পারতেন, তাদের মাছের নামটা বললেই হতো।

বসন্তকালে গ্রামে প্রায় বাড়িতেই বসন্ত হতো। শীতের শুরুতে কলেরা হতো, সন্ধ্যায় বমি, ডায়রিয়া শুরু হয়ে ভোরেই মারা যেতেন রোগী। এলএমএফ ডাক্তার বাড়ি গিয়ে স্যালাইন পুশ করতেন। আর কোনো ডাক্তার না থাকায় কাহিল অবস্থা হয়ে যেত তার। লোকজন গিয়ে ডাক্তারকে আগেই বলতেন- ‘তিনডা বোতুল খাইছি, শইল্লো জোর পাই না, রক্তের বোতুল দেইন চাহাজি।’

কলেরা বসন্তের মহামারি : স্কুলে যাওয়ার সময় আম্মা ডেকে নিয়ে আমার মাথায় ফুঁক দিয়ে বলতেন- ‘কোথাও কিচ্ছু খাইবি না। চারিবুগ দিয়া কলেরা বসন্ত, রাস্তায় অন্য মানুষের লগে কথা কইবি না। অতো অসুহের বিত্তে ইস্কুল বন্ধ দে-না কেরে মাস্টররা?’ কলেরা শুরু হলে লোকজন লাঠিসোটা, কাঁসার বাসন বাজিয়ে রাতে পাহারা দিতেন। মানুষ মনে করত- গভীর রাতে ‘তিন ট্যাংওয়ালা’ ঘোড়া দৌড়ে যায়। ঘোড়াটা যে-দিক দিয়ে যায়, ওই জায়গায় শুরু হয় কলেরা। লোকজন দলবদ্ধ হয়ে রাতে বলতেন- ‘আলির হাতো জুলফিকার মায়ের হাতো তীর, যেই দিগেত্তে আইছোস বালা সেই দিগেতে ফির’। বাকিরা একসঙ্গে ‘সেই দিগেতে ফির’ বলে চিৎকার করে উঠতেন।

গরুর চিকিৎসায় গোয়াল : গরুর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সে সময় গোয়াল ছিল। বগলের নিচে ব্যাগ, হাতে খঞ্জনি (চক্রাকার ক্ষুদ্র বাদ্যযন্ত্র বিশেষ) দিয়ে শব্দ করে হেঁটে যেতেন ‘গোয়াল বেটা’। লোকজন ভাবতেন- তিনি ওষুধের বদলে ইচ্ছে করে বিষ দিয়ে গরু মেরে চামড়া বাজারে বিক্রি করবেন।

চিকিৎসক বাইদানি : বেদে বহর আসত গ্রামে। বাজার, বটতলা, নদীর পাড় এমন জায়গায়। ওরা থাকত বস্তির মতো খুপরি ঘর বানিয়ে। মাথায় সাপের ঝাঁপি, হাতে নাগবাঁশি, বগলে বড় কাপড়ের পুঁটলা, মহিষের বড় বাঁকা শিং থাকত বাইদানির কাছে। গৃহস্থ বাড়িতে এসে হাঁক দিত- ‘শিংগা লাগাইবান, শিংগা, বাত ব্যথা, পোলাপান, সোয়ামি বাধ্যের তাবিজ, বশীকরণের তাবিজ, ভূতপেত্নীর আছর, বিছনায় পোলাপানের প্রশ্রাব, বেবাক চিকিৎসা করুইন।’ শুকনা কাঁকিয়া মাছের ঠোঁটের কাঁটা দিয়ে আঙুলে ঠুকে রক্ত বের করত, তাতেই নাকি সব দোষ কাটবে।

সাপে কাটার চিকিৎসা : বর্ষাকালে গ্রামে সাপের উপদ্রব বেড়ে যেত। আমি ছিলাম ভীতুর ডিম। রাতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে উঠানে পাটশোলার খোঁচা খেলেও তুলকালামকাণ্ড। বলা হতো, সাপে কামড় দিলে মরিচ খেলে যদি সত্যিই কামড় দিয়ে থাকে তাহলে মরিচের জ্বাল লাগবে না। চিমটি দিলে ব্যথা পাবে না। আমি রান্না ঘরে গিয়ে কাঁচা মরিচ খেয়ে জ্বালের চোটে উ, আহ করতাম। চিমটি দিয়ে ব্যথা পেতাম।

একবার সাপের ওঝার কাছেও গিয়েছি বিষ নামাতে। গিয়ে দেখি, ওঝা লোকটি পক্ষাঘাতের এক রোগীকে ঝাড়ু দিয়ে পেটাচ্ছেন। ঢাক-ঢোল ও ‘জশোরী’ বাজিয়ে রোগীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছেন। দোহাই মা কালি, দোহাই দুর্গা, দোহাই আলি, মা মনসা, দেবী পদ্মাবতীকে গালি দিয়ে চিকিৎসা চলছে। আমাকে গাঁইলের ওপর বসিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল টাইট করে বেঁধে দিয়ে মন্ত্র পড়লেন ওঝা। আরেকজন আঙুলকে টিপতে থাকেন নিচের দিকে। কিছুক্ষণ পর ব্লেডের মাথা দিয়ে খুঁচাতেই কালো রক্ত বেরিয়ে এলো। এটাই নাকি সাপের বিষ। বাড়িতে এসে নিরামিষ খেতে হলো তিন দিন।

সংস্কার, কুসংস্কার যা-ই বলি না কেন, গ্রামদেশে এ সংস্কৃতি চলে এসেছে যুগ থেকে কাল অবধি। আধুনিকতার অজুহাত দিয়ে সেই বিশ্বাসকে খাটো করা যাবে না। জন্মভূমির মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি।

হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ চিকিৎসা, পেশা সর্বোপরী মানুষ ও মানুষের জ্ঞান-বিশ্বাস আজ আর নেই। তবু স্মৃতিজাগানিয়া হয়ে থাকুক অন্তরের মণিকোঠায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close