সৈয়দ নূরুল আলম
একটি সাধারণ মেয়ের গল্প

রিমা যখন বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় তখন রাত ১টা। সারা দিন বাস জার্নি করে এসেছে, শরীর ক্লান্ত থাকায় ঘুম আসতে দেরি হয় না। শোবার কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। আজ যে ওর বাসর রাত, সে কথা ও ভুলে যায়। ভুলবেই-বা না কেন। বাসর রাতের যে সাজসজ্জা, আমোদ ফুর্তি, বন্ধুদের হাসি-তামাসা, ভাবিদের মুখটিপে হাসা, এসবের ছিটেফোঁটা এ বাসায় নেই। আসলে এটা বাসা না, চাকরিজীবী ম্যাচ। মহিউদ্দিন বিয়ে করে ওকে এনে এই ম্যাচে উঠিয়েছে। আসার সময় মহিউদ্দিন রিমাকে ম্যাচের কথা বলেনি, বলেছিল- তিনতলা ছাদের ওপর ছোট্ট একটা রুম, ওখানে আমি থাকি। অ্যাটাচ বাথরুম আছে, পাকঘর আছে, আপনার কোনো অসুবিধা হবে না। মহিউদ্দিন রিমাকে সত্যও বলেনি, আবার মিথ্যাও বলেনি। আসলে বাড়ির একতলা, দোতলা মিলে ম্যাচ। তিনতলায় বাড়িওয়ালা থাকে। তিনতলা ছাদে একটা রুম করে বাড়িওয়ালা ওটাকেও ম্যাচ হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন। ওখানে মহিউদ্দিন আর ওর এক অফিস কলিগ মিলে ভাড়া নিয়েছিল, কয়েক মাস আগে কলিগ বিয়ে করে অন্য জায়গায় বাসাভাড়া নিয়ে চলে গেছে, সেই থেকে মহিউদ্দিন এখানে একা থাকে।
রিমা যখন একতলা, দোতলার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছিল, সিঁড়ির দুপাশে লোকের কথাবার্তা, চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ও বুঝতে পেরেছিল এটা একটা ব্যাচেলর ম্যাচ। তবে তিনতলার ছাদে ওঠে রিমা ঠিকই দেখতে পায়, বারো বাই পনেরো ফুটের একটা রুম এবং মহিউদ্দিনের কথামতো রুমের সঙ্গে একটা বাথরুম ও রুমের দক্ষিণ দিকে একচিলতে বারান্দার মতো জায়গায় গ্যাসের চুলো বসিয়ে রান্নাঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রিমার মা, আকলিমা বেগম, রিমার বিয়ের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। কত ছেলে এলো আর গেল, রিমার ভাগ্যে বিয়ে আর জোটে না। তাই রিমাও বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। রিমার চেহারা ততটা খারাপ না। গায়ের রং শ্যামলা হলেও মুখে অন্যরকম একটা টানটান আদল আছে, চোখ দুটো বর্ষায় ডোবা পুকুরের মতো টলটলে, জোড়া ভুরু, নায়িকা সাবানার নাকের মতো নাক, সাদা চকচকে দাঁত, হাসার সময় সে দাঁত আরো উজ্জ্বল দেখায়। রিমা গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছে। এসএসসি পাস হলেও শহরের মেয়েরা যেভাবে কথা বলে, সেজেগুজে থাকে, রিমাও সেভাবে কথা বলে, সেজেগুজে থাকার চেষ্টা করে।
৩০ বছর পার হওয়ার পরও যখন রিমার বিয়ে হয় না, তখন মা আকলিমা বেগমের চিন্তা বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। রিমার বাবা বেঁচে থাকলে এ চিন্তা বাবা-মা ভাগাভাগি করে নিতে পারত। রিমার দাদা বেঁচে আছেন, তিনি ছেলের বউকে বোঝান, ‘রিমার মা, চিন্তা করো না, আল্লাহ যখন যার সঙ্গে বিয়ে লিখে রেখেছে, তখন তার সঙ্গে বিয়ে হবে। আলগা চিন্তা করে লাভ নেই।’ ঠিকই, হঠাৎ করে মহিউদ্দিনের সঙ্গে রিমার বিয়ে হয়ে যায়।
মায়ের শরীর খারাপের খবর শুনে মাত্র তিন দিনের ছুটি নিয়ে মহিউদ্দিন ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছিল, বিয়ের কোনো প্রস্তুতিই তার ছিল না, কিন্তু মায়ের কঠিন কথায় আর না করার উপায় ছিল না। মায়ের এক কথা, ‘বিয়ে করবি তো করবি, না করলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি। আমি আজ আছি, কাল নেই, যাওয়ার আগে তোর বউয়ের মুখ দেখে যেতে না পারলে, মরেও আমার শান্তি হবে না।’
মায়ের সঙ্গে যোগ দেয় বড় ভাইয়ের বউ, রত্না ভাবি। মহিউদ্দিনরা দুই ভাই। মহিউদ্দিন আর কামালউদ্দিন। কোনো বোন নেই। বাবা অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। কামালউদ্দিন সৌদি আরব থাকে। বিয়ে করার দুমাসের মাথায় সৌদি আরব চলে যায়। বাড়িতে বুড়ো মা আর রত্না ভাবি। মহিউদ্দিন, মায়ের কথা ফেলতে পারেনি। তাই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। মতি ঘটককে খবর দেওয়া মাত্রই ছবির অ্যালবাম নিয়ে হাজির হয়। অনেক ছবি দেখার পর রত্না ভাবি রিমার ছবিটাই পছন্দ করে। ছবিতে মেয়ের বয়স বোঝা যায় না। মেয়ে দেখা অনুষ্ঠানে, মেয়েকে যখন সামনাসামনি দেখে, তখন মহিউদ্দিনের মামা জহির মোল্লা নিচু গলায় বলেন, ‘মেয়ের তো বয়স একটু বেশি মনে হয়, মহিউদ্দিনের সঙ্গে মানাবে?’ প্রতি-উত্তরে রত্না ভাবি গলার স্বর আরেকটু খাদে নামিয়ে বলেছিল, ‘মামা, গায়ের রং, লেখাপড়া, উচ্চতা, বয়স, সবকিছু কি মেলে? একটু-আধটু ছাড় দিতে হয়, তা ছাড়া একটু বয়স্ক হলে, সংসার সামলাতে সহজ হবে।’ রত্নার কথার ওপর আর কেউ কোনো কথা বলেনি, তাই বয়সের কথাটা ওখানেই চাপা পড়ে যায়।
একফাঁকে রত্না ভাবি, মহিউদ্দিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘ছোট মিয়া, বয়স একটু বেশিই ভালো, কিছু আর শেখানো-পড়ানো লাগব না। সব শিখে আসবে। তুমি তো আবার অনেক কিছু বুঝো না। ডরাও।’ ভাবি কী ইঙ্গিত করছে, মহিউদ্দিন সেটা বুঝতে পারে। কিন্তু কোনো টু শব্দটি করে না। মনের কথা মনের মধ্যে রাখে।
যত দেরি করেই ঘুমাক না কেন, প্রতিদিন ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে রিমার ঘুম ভেঙে যায়। আজও ভেঙে গেছে, প্রথমে ও বুঝতে পারেনি, কোথায় ও শুয়ে আছে, কয়েক সেকেন্ড মাত্র, তারপরই গতকাল সন্ধ্যা থেকে রাতে এ বাড়ি আসা পর্যন্ত সব ঘটনা এক এক করে রিমার মনে পড়ে যায়। রাতে ও ঘুমিয়ে পড়েছে ভাবতেই লজ্জায় ও লাল হয়ে ওঠে, ভাবে কী একটা জঘন্য কাজ হলো! রিমা ধড়মড় করে উঠে বসে, দেখে লোকটি মেঝেতে একটা চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে আছে, মহিউদ্দিনকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে, রিমার বেশ মায়া হয়, এখন কী করবে বুঝতে পারে না। একবার ভাবে ডেকে তুলবে কি? পরক্ষণে ভাবে, ঘুমন্ত মানুষের ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না।
গতরাতে রুমটা ভালো করে দেখেনি রিমা। এখন ও তাকিয়ে দেখে রুমটা বেশ অগোছালো। রুমে মালপত্র বলতে একটা আলনা, আলনায় কয়েকটা শার্ট-প্যান্ট, একটা গেঞ্জি, দুটো আন্ডারওয়ার, একটা সস্তা কাঠের টেবিল, দুটো চেয়ার, একটা বহুদিনের পুরোনো, রং ওঠা ফ্রিজ, দেয়ালে টানানো একটা রবীন্দ্রনাথের ছবি, একটা বঙ্গবন্ধুর ছবি।
রিমা আস্তেÍ পা টিপে টিপে বাথরুমে যায়। কোনো শব্দে যাতে মহিউদ্দিনের ঘুম ভেঙে না যায়। হাত-মুখ ধুইয়ে, ফ্রেস হয়ে, নিজের সুটকেস খুলে, একসেট সালোয়ার-কামিজ বের করে, শাড়ি পাল্টে, সালোয়ার-কামিজ পরে। বাড়িতে থাকতে রিমা শাড়ি তেমন একটা পরে না। অভ্যাস নেই। গতকাল থেকে ভারী একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রাখতে অস্বস্তি লাগছিল। শাড়ি পাল্টে সালোয়ার-কামিজ পরাতে এখন নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। কিন্তু খিদেয় ওর পেট আলুথালু করছে। সারা দিনে, বাসে একটা সিদ্ধ ডিম আর এক ঠোঙা ঝালমুড়ি ছাড়া কিছু খায়নি। লজ্জায় এগুলোও রিমা খেতে চায়নি। মহিউদ্দিন জোর করেছে। বলেছে, বাসায় পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে, সারা দিন না খেয়ে থাকা যায়?
সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে বের হয়েছে। তখনো রিমা কিছু খেতে চায়নি। ঘুম ঘুম চোখে রিমা বলেছিল, ‘আম্মা কোথাও যাওয়ার সময় আমি কিছু খাই না। খেলে পথে বমি হয়।’
রিমার মুখে আম্মা ডাক শুনে আকলিমা বেগমের মনটা ভরে গিয়েছিল। এমন লক্ষ্মী বউ পাবে, আকলিমা বেগম স্বপ্নেও ভাবেনি।
রিমার কথা আকলিমা বেগম শোনেনি। নতুন বউ, একেবারে খালি মুখে বের হবে? শাশুড়ি জোর করে মুড়ি আর পায়েস খাইয়ে দিয়েছে।
গতরাতে একটুও ঘুমোতে পারেনি রিমা। দুপক্ষের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা চালাচালি করতেই অনেক রাত হয়ে যায়, তারপর বিয়ে পড়ায়ে, খেতে খেতে প্রায় সকাল হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর রত্না ভাবি বর-কনেকে একঘরে একটু কথাবার্তা বলার সুযোগ করে দিয়েছিল, কিন্তু দুজনের মধ্যে তেমন কোনো কথা হয়নি। ততক্ষণে মসজিদে ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে, জানালার ফাঁক দিয়ে মৃদু আলো ঘরে ঢুকেছে। কথার মধ্যে মহিউদ্দিন শুধু বলেছিল, তিনতলা ছাদের ওপর ছোট একটা রুম, ওখানে আমি থাকি। অ্যাটাচ বাথরুম আছে, পাকঘর আছে, আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।
‘আপনি’ কথা শুনে রিমার মুখে হাসি চলে এসেছিল, সে হাসি কোনো রকম চেপে রিমা বলেছিল, ‘আপনি আমাকে ‘আপনি’ বলছেন কেন?’
এ কথার কোনো উত্তর মহিউদ্দিন দেয়নি। পরক্ষণে রিমা ভেবেছিল, প্রথম প্রথম সবাই বোধহয় বউকে আপনি করে বলে। পরে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু রিমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল স্বামীকে তুমি করে বলতে। কত কথা রিমার বুকের মধ্যে জমে আছে, আর সেসব কথা ‘আপনি’ করে বললে ভালো শোনা যায় না। কানে বাধে। তুমি করে বলতে হয়। তাই রিমা কথাগুলো পরে বলবে ভেবে নিজের মনের মধ্যে রেখে দেয়। তারপর ভোরে তো ঢাকা আসার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।
মহিউদ্দিন একটা প্রাইভেট কোম্পানির অ্যাকাউন্টস অফিসার। অফিসে ভীষণ কাজ। এক দিনও বাড়তি ছুটি নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই বিয়ের পরের দিনই ছুটে আসতে হয়েছে।
রিমার হাতের কাচের চুড়ির রিমঝিম শব্দে মহিউদ্দিনের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলতেই সামনে রিমাকে দেখতে পায়। সালোয়ার-কামিজ পরা রিমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিমার বেশ লজ্জা লাগে, কী বলবে বুঝতে পারে না, আবার সামনে থেকে সরেও যেতে পারে না। আর সরে যাবেই-বা কোথায়, রুম তো একটা।
মহিউদ্দিনের দেখা শেষ হলে ফ্লোর থেকে চাদরটা তুলে ভাঁজ করতে করতে বলে, কালরাতে আমি বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখি আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, তাই আর ডাকিনি। ক্লান্ত ছিলেন, ঘুম আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু না খেয়ে ঘুমালেন, ঘুম ঠিকমতো হয়েছে?
খাওয়ার কথা বলাতে রিমার চোখ যায় টেবিলের ওপর। দুটো বিরানির প্যাকেট টেবিলের ওপর আস্ত পড়ে আছে। বাস থেকে নেমে বাসায় আসার পথে মহিউদ্দিন কিনেছিল। বাসায় এসে যাতে খাওয়ার ঝামেলা করতে না হয়। কিন্তু রিমা খায়নি দেখে মহিউদ্দিনও খায়নি। নতুন বউকে রেখে খাওয়া যায়?
নিজে খায়নি বলে মানুষটাও খায়নি, কথাটা ভাবতেই রিমার ভেতরে খুশির ঢেউ ওঠে। মানুষটা নিশ্চয় অনেক ভালো।
মহিউদ্দিন ফোন থেকে সময় দেখে তারপর ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘আমার অফিসের সময় হয়ে গেছে, আপনি বিরিয়ানিগুলো গরম করে আনেন, আমি তাড়াতাড়ি গোসলটা করে নিই।’ এই বলে আর দেরি করে না। মহিউদ্দিন বাথরুমে ঢুকে যায়। রিমা মহিউদ্দিনের চলে যাওয়ার দিকে কিছু সময় চেয়ে চেয়ে কী যেন ভাবে, তারপর বিরিয়ানির প্যাকেট দুটো নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে গরম করে এনে, একটা প্লেটে বেড়ে টেবলে রাখে, সঙ্গে একটা পেঁয়াজ কেটে দেয়।
মহিউদ্দিন নাকে-মুখে কিছু খেয়ে হাতব্যাগটা নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে যায়, যাওয়ার সময় রিমিকে বলে, ‘সালোয়ার-কামিজে আপনাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি স্যারকে বলে লাঞ্চের একটু পরই চলে আসার চেষ্টা করব। একা থাকতে ভয় পাবেন না তো? আর খারাপ লাগলে তিনতলায় আন্টি থাকেন, ওখানে গিয়ে পরিচিত হয়ে গল্প করতে পারেন। আমি পরিচয় কবিয়ে দিলে ভালো হতো, কিন্তু আমার তো সময় নেই।’
কিছু একটা বলার জন্য রিমার ঠোঁট নড়ে উঠেছিল, কিন্তু বলতে পারে না, যাকে বলবে সে ততক্ষণে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। তবে রিমা দুঃখ পায় না, ভাবে মানুষটা বউয়ের প্রতি বেশ কেয়ারিং। মেয়েরা তো এ ধরনের স্বামীই চায়।
রিমা তখন স্বামীকে বলতে চেয়েছিল, লাঞ্চের পর আসবেন কেন, আগে আসেন। আপনার জন্য আমি রান্না করব। কিন্তু বলতে আর পারল কই। তবু রিমা দুপুরে রান্না করে। ভাবে, যখনই আসুক না কেন, তখনই খেতে দেবে। এত দিন বাইরে বাইরে খেয়েছে, নিজে রান্না করে খেয়েছে, এখন আর সেটা সে করতে দেবে না। ফ্রিজে মাছ ছিল, আলু দিয়ে মাছ রান্না করে, কৌটায় মসুরের ডাল ছিল, ঘন করে ডাল রান্না করে। আর কাঁঠালের বিচি ছিল, সরিষার তেল আর মরিচণ্ডপেঁয়াজ দিয়ে কাঁঠালের বিচিভর্তা করে। রান্না শেষ করে গোসল সেরে, হালকা একটু সাজে। তারপর টেবিলে সব খাবার সাজিয়ে ঢেকে রাখে, ওকে ছাড়া কী করে খায়। এ সময় হঠাৎ দরজায় কলিংবেল বেজে ওঠে। রিমা ভয়ে কেঁপে ওঠে, এ অসময় কে এলো? ওর তো এত তাড়াতাড়ি আসার কথা না। দরজা খুলবে কী খুলবে না বুঝতে পারে না। আবার কলিংবেল বাজে এবং একই সঙ্গে দরজার ওপাশ থেকে কথা ভেসে আসে, ‘রিমা দরজা খোলেন, আমি এসেছি।’
রিমা, মহিউদ্দিনের কণ্ঠ চিনতে পারে, এক মুহূর্তও দেরি করে না। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয়। মহিউদ্দিনকে দেখে আনন্দে ওর চোখে জল চলে আসে। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল মহিউদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু কী মনে করে নিজেকে সামলে নেয়।
মহিউদ্দিন হাত-মুখ ধুইয়ে আসার পর দুজনে একত্রে খেতে বসে। খেতে খেতে মহিউদ্দিন বলে, ‘আপনার জন্য একটা মোবাইল কিনে আনছি। এখন অফিস থেকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব, আপনকে আর একলা মনে হবে না। সিম কিনেই রত্না ভাবিকে নম্বর দিয়েছি, ভাবিও মাঝেমধ্যে কথা বলবে, আপনি বলবেন।’
স্বামীর কথা শুনে রিমার ভেতরটা আনন্দে উতালপাতাল করে ওঠে। কীভাবে আনন্দ প্রকাশ করবে বুঝতে পারে না। খাওয়া বন্ধ করে, ড্যাবড্যাব করে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
বিকেলে ওরা গল্প করে, চা খায়। কথায় কথায় মহিউদ্দিন এ-ও বলে, ও বিয়ে করে, নতুন বউ সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসেছে, এ কথা শোনার পরে অফিসের বস ওকে হাফবেলা ছুটি দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
মহিউদ্দিনের মুখে এ কথা শোনার পর রিমার মুখ লজ্জায় জ্বলে ওঠে। মহিউদ্দিন সেটা দেখতে পায় না।
সন্ধ্যায় ওরা তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। রিমার মধ্যে একটু আড়ষ্টতা দেখে মহিউদ্দিন বলে, ‘আপনার কি একই খাটে দুজন শোয়াতে অসুবিধা হবে?’
রিমা দুদিকে মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে।
‘আজ বেশ গরম পড়েছে। ফ্যানের জোর কম। আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’ মহিউদ্দিন গায়ের গেঞ্জি খুলতে খুলতে বলে। মসজিদে ফজরের আজান দেয়। প্রতিদিনের মতো রিমার ঘুম ভেঙে যায়। সারা রাত মরার মতো ঘুমিয়েছে। রিমা চোখ মেলে দেখে মহিউদ্দিন গতরাতের মতো নিচে শুয়ে আছে। মহিউদ্দিনকে ওখানে দেখে রিমার শরীর পাথর হয়ে যায়। চট করে বিছানা থেকে উঠতে পারে না। বুক ভেঙে কান্না আসে।
মহিউদ্দিন ঘুম থেকে উঠে রিমাকে সকালের নাশতা করতে দেয় না। বলে, ‘আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। হোটেল থেকে এনে নাশতা করব।’ এই বলে মহিউদ্দিন হোটেল থেকে পরোটা, ডিম ভাজি, আর ডাল নিয়ে এসে, কিছুটা নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে বাকিটা রিমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, ‘আপনিও খেয়ে নিন।’
রিমা টেবলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। চেয়ারে বসেও না, খায়ও না। ওর মুখটা নিচের দিকে অবনমিত। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, আপনি কি আমাকে ইচ্ছের বিরুদ্রে, শুধু মায়ের কথায় বিয়ে করেছেন?’
মহিউদ্দিন খাওয়া বন্ধ করে রিমার দিকে চেয়ে থাকে। কোনো কথা বলে না। ওর আর খাওয়াও হয় না। কাঁধের ব্যাগ নিয়ে অফিসে রওনা হয়।
মহিউদ্দিন বের হয়ে যাওয়া মাত্র রিমা দরজা বন্ধ করে, বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। কত সময় ঘুমিয়েছে বুঝতে পারে না। টেলিফোনের শব্দে ওর ঘুম ভাঙে। টেবিলের ওপর ফোন ছিল, ও দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরে, ভেবেছিল, মহিউদ্দিন ফোন করেছে, সকালে করা ওর প্রশ্নের উত্তরটা দেবে।
মহিউদ্দিন না। ফোনের ওপাশে রত্না ভাবির গলা শুনতে পায়। ফোনে রত্না ভাবি খলখলিয়ে ওঠে, ‘ওরে আমার ভাগ্যবতি, নয়া জামাই, নয়া টেলিফোন। তা কেমন চলছে? বাড়িতে তো কিছু হলো না, হলে দেখতে পেতাম, জানতে পেতাম।’
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে রত্না ভাবি একটু থামে। তারপর আবার গলার স্বর একটু খাদে নামিয়ে বলে, ‘যদি এদিক-সেদিক কিছু দেখিস, তাহলে ওকে একটা তাবিজ এনে দিস। ছোট মিয়া ডরায়, তা তো আমি জানি।
রিমা ছোট করে আচ্ছা বলে, ফোনটা কেটে দেয়।
"