শেলী সেনগুপ্তা
জসীম উদ্দীন
একা এক অনাড়ম্বর বৃক্ষ
বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের কবিদের নাম বলতে গেলে প্রথমেই যে কয়েকজনের নাম মনে আসে, জসীম উদ্দীন তাদের একজন।
বাংলা সাহিত্যে কবির অভাব নেই। অনেকেই অনেকের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছে। নির্দোষ অনুসরণও কম হয়নি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাবাদর্শে অনেকেই কবিতা লিখেছেন। কিন্তু পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, তার পূর্বসূরি কোথায়? উত্তরসূরিই বা কই!
তিনি নাগরিক মানসের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও জসীম উদ্দীন প্রধানত গ্রামীণ মানুষের জীবনের রূপকে কবিতা করে তুলে পরিবেশন করেছেন। যদিও তার এ পরিবেশনার লক্ষ্য নগরের মানুষই।
যাদের পাতে তুলে দিয়েছেন গ্রামের অপার সম্ভার, সে তারাই ‘পল্লীকবি’ ছাপমারা ছিল বলে তাকে আধুনিকদের দলে রাখতে চাইতেন না। অথচ নগরেই তার পাঠকপ্রিয়তা ছিল বিপুল।
তার সমসাময়িকদের মধ্যে যারা কবি হিসেবে ‘আধুনিক’, তাদের চেয়ে অধিকসংখ্যক নগরবাসী মানুষ তার কবিতা ভালোবাসেন। এ অর্থে ধরলেও আমাদের সাহিত্যে এমন পল্লী গাঁয়ের কাদা-মাটি দিয়ে গড়া গেঁয়ো কবি একজনই, যিনি নগরের মানুষকেও মুগ্ধ করেছেন।
তার মতো করে প্রাণখুলে আমন্ত্রণ কজন দিতে পারে ভালোবাসার গাঁয়ে। কজনই-বা এমন করে ভালোবাসায় জড়াতে পারে?- ‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,/গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;/মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি/মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,/মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,/তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়।’
যে সময় কবি-সাহিত্যিকের মনে বাসা বেঁধেছিল নাগরিক জীবন, যে সময় কবি-সাহিত্যিকদের চোখ সরেনি রাজনীতি-সমাজনীতি-শহর-সভ্যতা থেকে, সে সময়ে তিনি উপস্থিত হয়েছেন সহজ-সরল একটি গ্রামীণ জীবন নিয়ে।
সহজ কিন্তু গভীর অনুভূতিগুলো ভাগ করে নিয়েছেন পাঠকের সঙ্গে। এভাবেই সৃষ্টি হলো তার অনেক কবিতা।
যখন তিনি একেবারেই যুবক, তখন একটা কবিতা লিখেছেন, ‘কবর’। দোলা দিয়েছেন মানুষের মনে, আর নড়েচড়ে বসেছে গোটা সাহিত্যাঙ্গন। কি চমৎকার ভাষার গাঁথুনি, কি তার আবেদন, কি নিখুঁত মর্মবেদনা।
মানুষের বুকের ভেতর বসে তিনিই লিখেছেন- ‘এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,/তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।/এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,/পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।’
যখন তিনি কলকাতা বিশ্ববদ্যালয়ের বিএ ক্লাসের ছাত্র, তখনই এ কবিতা মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচিতে চলে এসেছে! এ ঘটনা বিশ্বের আর কোনো সাহিত্যিকের আছে কি না, জানা নেই। এভাবেই তিনি মানুষের ছোট ছোট স্বপ্ন, চিন্তা, চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অনেকের মাঝে।
জসীম উদ্দীন যেন গ্রামবাংলার প্রত্যেকটা মানুষের নাড়ি বুঝতে পারতেন। গ্রামের কৃষক, বধূ, মা, রাখাল, শিশু, খেত, বন, নদী, অনাহার, দারিদ্র্য, সুখ, হাসি, কান্না- সবকিছু দিয়ে তার একটা অনবদ্য রূপকথা লিখতে সময় লাগত না। গ্রামকে ভালোবেসে নকশিকাঁথার মাঠের ‘রূপাই’য়ের কালো রঙে তিনি মহিমান্বিত করেছেন এভাবে-
‘কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি,/কালো দাঁতের কালি দিয়েই কেতাব কোরান লেখি/জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়;/চাষিদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।/সোনায় যে-জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার/রং পেলে ভাই গড়তে পারি রামধনুকের হার।/কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন,/তারির পদণ্ডরজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন।’ এ শুধু জসীম উদ্দীন বলেই সম্ভব।
তার কবিতায় পল্লীর মায়া জড়িয়ে থাকত বলে তাকে ‘পল্লীকবি’ বলা হতো। কিন্তু অন্য অর্থে বলতে গেলে, সমগ্র বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। এখানেই কাজ করেছে তার দূরদৃষ্টি। এটিই তাকে অনেকের মাঝে স্বাতন্ত্র্য মর্যাদা দিয়েছে।
তারপর মনেপ্রাণে আধুনিক কিন্তু লিখেছেন গ্রামীণ পটভূমিতে তেমন একজন কবি পেতে আমাদের এই শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কারণ, এই নবীন শতকের তরুণ কবিদের মধ্যেই হয়তো আমরা পাব আত্মবিশ্বাসী আধুনিক কবিসত্তাকে, যারা নিজেদের বিকশিত করবেন, তার দেখানো আধুনিকতার পথে, লিখবেন আমাদের অসীম সম্পদ নিয়ে, লিখবেন গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে।
"