রুখসানা কাজল
ধারাবাহিক উপন্যাস- ১১
বায়োস্কোপ
নাইম তো একবার প্রায় ধরাই পড়ে যাচ্ছিল। ওপার থেকে যে নৌকা এপারে আসছিল তারাই হাস্যরসের সঙ্গে চেঁচিয়ে জানিয়ে দিচ্ছিল, পুলিশ আসিছে। নকশাল ডাকাত ধরতি। পানির মদ্যি নাকি নকশাল ঢুকে গেছে। নাইমের নৌকা তখন নদীর মাঝ বরাবর। স্রোতের টান মারমুখী। নদী ফুঁসছে আগাম বন্যার খবর নিয়ে।
ভাগ্যিস সাঁতার জানত নাইম। পড়ে যাওয়ার ভান করে টুপ করে ঝরে পড়েছিল। দম বন্ধ করে ডুবে ছিল অনেকক্ষণ। ততোক্ষণে নৌকা চলে গেছে অনেক দূর। নাইমকে স্রোতে ভেসে যেতে দেখে নৌকার আরোহীরা আহা উহু করছিল গভীর দুঃখে। কিন্তু যখন তীরে নেমে জানতে পারে আর দেখে সত্যিই পুলিশ অপেক্ষা করছে, তখন একজন বলে উঠেছিল, কি ব্যাটা নকশাল ছিল! আগে জানলে তো জাপটে ধরে রাখতাম নাস্তিকটারে। দেশটারে রাশিয়া বানাই ফেলাতিসে হারামজাদারা।
লোকটার পরনের শার্টে রিফু করা ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ভাতের বদলে তখন আটার রুটি খেয়ে ঘুমাতে যায় বাঙালি। তবু ইনুদের জন্য কি সাংঘাতিক ঘৃণা আর ভয় সাধারণ মানুষদের মনে।
ওদের সাময়িক আশ্রয়দাতা কৃষি অফিসের ব্লক সুপারভাইজার সুতায় বোনা টুপি পরে মাগরিবের নামাজ আদায় করার আগে ঘটনাটা ওদের বর্ণনা করে বলছিল, ভাইজান আসেন নামাজ পড়তে যাই। মানুষের মুখ একটা কিন্তু মন যে কত!
সেদিন স্রোতের বেগ দেখে পুলিশ আর কেরদানি দেখানোর রিস্ক নেয়নি। তাছাড়া নদীটা দুদিকে বেঁকে চলে গেছিল দু’জেলার ভেতরে। নাইম মাঝনদী বরাবর ভাসতে ভাসতে একটি জেলে নৌকায় আশ্রয় পেয়েছিল। সেখান থেকে দুদিন পর ঘাঁটিতে ফিরে এসেছিল জেলেদের দেওয়া একটি পুরোনো লুঙ্গি, জীর্ণ গামছা ও গেঞ্জি পরে একেবারে নাংগা পায়ে। আসার সময় কাঁধে করে এনেছিল এক কান কাঁচাপাকা সবরি কলা। পরে পূরবীর কাছে স্বীকার করেছিল, কলার কান সে চুরি করেছিল। পয়সা নাই হাতে। এত ক্ষুধা পেয়েছিল... কি আর করা বুবু। বিপ্লব সফল হলে সুদ আসলে পূরণ করে দেব, প্রমিস।
পূরবী ওর কান ধরে বলেছিল, মনে থাকে যেন। সুযোগ পেলে শোধ করে দিবি বিচ্ছু। কান ছাড়িয়ে হাসতে হাসতে নাইম বলেছিল, দেব। তার আগে আমাদের বিপ্লব সফল হোক।
ঢাকা কলেজের ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র শিক্ষিত বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান নাইম বিপ্লব সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও ইনুর মনে দুলে যাচ্ছিল অন্য আশঙ্কা। এই বিপ্লবের রাস্তা কতদূর বা কত বছর ধরে বয়ে যাবে? জেলেরা কি নাইমের পরিচয় পেলে ওকে দুটো দিন ওদের সঙ্গে থাকতে দিত? শিবচরের কাছে এলোপাতাড়ি বইঠার বাড়ি মেরে কয়েকজন জেলে ওদের একজন কমরেডকে প্রায় মেরেই ফেলছিল ডাকাত বলে। হাতে-পায়ে ধরে কোনোরকমে বেঁচেছিল শিবু। দলে আর ফিরতে পারেনি। সেন্ট্রাল কমিটি গোপনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও, ইন্ডিয়া যেতে হবে শুনে শিবুর বাবা-মা আর সাহস পায়নি। শিবু এখন এক পা লেংচে হেঁটে বাপের হোমিওপ্যাথি দোকানে এসে বসে। রোগী দেখে আর মাঝে মাঝে ওদের গোপনে সাহায্য করে।
আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনে ওমরের লেখার ধরন পাল্টে যাচ্ছিল। ওর কবিতাগুলো নিয়মিত ছাপা হচ্ছিল প্রচ্ছন্নভাবে ওদের সমর্থিত ঢাকার একটি পত্রিকায়।
"