সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

প্রাণের উৎসব বইমেলা

জ্ঞানপিপাসু মানুষের নিত্যসঙ্গী বই। বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। সেই আলোর উৎসবই হচ্ছে বইমেলা। তাই অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের উৎসব। লেখক-প্রকাশক-পাঠকের আত্মার মহামিলন ঘটে এর মাধ্যমে। সেই উৎসবে কিছুটা ভাটা পড়েছিল বিগত দুই বছর। বইমেলার ওপর ভর করেছিল অশুভ শক্তি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন বইমেলার ঔজ্জ্বল্য ম্লান করে দিয়েছিল। তাই এবারের বইমেলা খুবই চ্যালেঞ্জের। কারণ এবার মেলার আগে থেকেই খুব নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। শোনা গিয়েছিল, আগের চেয়ে কম প্রস্তুতি নিচ্ছেন লেখক-প্রকাশকরা। প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট উপকরণের দাম বাড়ায় হতাশ হয়েছিলেন তারা। এ বছর বইয়ের দাম হয়েছে দ্বিগুণ। এতে শেষ পর্যন্ত কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। বইমেলা শেষ হলে হয়তো তারও একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে। এসব নিয়ে এখনো চলছে জল্পনা-কল্পনা।

প্রতি বছর যে সময়ে বইয়ের প্রচারের তোড়জোড় চলতে থাকে, এ বছর সে সময়ে তোড়জোড় একটু কম দেখা গেছে। বইমেলা যতই ঘনিয়ে এসেছে, এবারের চিত্র যেন ততটাই পরিচ্ছন্ন হতে শুরু করেছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে যাদের প্রচার-প্রচারণায় দেখা যায়নি, তাদের এখন বইয়ের প্রচারে সরবই মনে হচ্ছে। কেননা বই প্রকাশ নিয়ে লেখক-প্রকাশকদের অনীহা প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। সে আশঙ্কা অনেকটাই কেটে গেছে বলে মনে হয়। গত বছর নির্ধারিত সময়ের পর শুরু হয়েছিল বইমেলা। ওই বছরও প্রায় সাড়ে ৫২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। এর মধ্যে বাংলা একাডেমির বই বিক্রি হয়েছিল এক কোটি ২৭ লাখ টাকার। মোট বই প্রকাশ হয়েছিল ৩ হাজার ৪১৬টি। মেলার শেষদিনেও ২১৫টি নতুন বই এসেছিল। এর মধ্যে মানসম্পন্ন বই নির্বাচিত হয়েছিল ৯০৯টি, যা পুরো বইয়ের ২৬ শতাংশ। এ বছর তিন হাজার বই প্রকাশ না হলেও দুই হাজার বই প্রকাশ হতে পারে। সেটাই বা কম কীসের?

আমরা জানি, করোনা মহামারির কারণে ২০২১ এবং ২০২২ সালে আশানুরূপ বই বিক্রি হয়নি মেলায়। ২০২১ সালে বইমেলার আয়োজকরাও বিপাকে পড়েছিলেন। পাঠকবিহীন বইমেলা ছিল অনেকটা নিষ্প্রাণ। ২০২১ সালের মার্চের মাঝামাঝি বইমেলা শুরু হলেও করোনা আবহ এবং অর্থনৈতিক সংকটে অন্য বছরের চেয়ে বই কম বিক্রি হয়েছিল। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে ২০২১ সালের অমর একুশে বইমেলা ঘোষিত সময়ের দুদিন আগেই শেষ হয়েছিল। একদিকে করোনা অন্যদিকে লকডাউনে মানুষ ছিল ঘরবন্দি। যে কারণে বইপ্রেমীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেলায় আসেননি বলে বিক্রেতারা ছিলেন হতাশ। এমন প্রাণহীন বইমেলা আগে কখনো দেখেননি বলেও মন্তব্য করেছিলেন ক্রেতাণ্ডবিক্রেতারা। ২০২২ সালেও করোনা মহামারির কারণে দুই সপ্তাহ দেরি করে শুরু হয়েছিল বইমেলা। ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বইমেলার উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপরও আগের তুলনায় কম বিক্রি হয়েছিল বই। তাই টানা দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধŸগতি আবার দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

তবে এবার প্রাণহানির আশঙ্কা নেই। হয়তো বইয়ের দাম বেড়েছে। তবু পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দামই বেশি। দাম বেশি হলেও বইপাগল মানুষ বই কিনবেই। লেখক-প্রকাশক তো তাদের বিগত বছরের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাইবেন। পাঠকও প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করেছেন। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতির এমন মুহূর্তে বইমেলার সার্বিক বেচাকেনা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটি এখন দেখার বিষয়। মনে হয়, বইমেলা শেষে ভালো একটি পরিসংখ্যান আমরা পেয়ে যাব। নিজের টাকা লগ্নি করে লেখক-প্রকাশক অবশ্যই ক্ষতির সম্মুখীন হবেন না। কেননা মেলার শুরু থেকেই কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে।

এবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বসেছে বইমেলা। আশার কথা হচ্ছে, এবার ৬০৯ প্রতিষ্ঠানের ৮৫৮টি ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩৪টি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৩৮টি প্যাভিলিয়ন করা হয়েছে। একটি প্যাভিলিয়নে হয়েছে মুজিব কর্নার। মেলায় দর্শনার্থীর কেনাকাটা ও চলাচল সহজ করতে ডিজিটাল দিকনির্দেশনাসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিশু চত্বরের পরিধিও বাড়ানো হয়েছে। এভাবেই প্রতি বছর বাড়ছে মেলার পরিসর, বাড়ছে স্টলের সংখ্যা, বাড়ছে পাঠক ও দর্শকও। সে সঙ্গে বাড়ছে লেখকের সংখ্যা। এই বেড়ে যাওয়া অমূলক নয়। যেমন বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। সে যাই হোক, আমাদের মনে রাখতে হবে, বইমেলার জন্য নীতিমালা আছে। যেসব প্রতিষ্ঠান বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছে, তাদের সেই নীতিমালা মেনে চলতে হবে। কেউ যেন নীতিমালার বাইরে না যান, সে জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্স সদস্যদের জন্য মেলায় করা হয়েছে একটি অফিসও। টাস্কফোর্স নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে এই টাস্কফোর্সের কারণে কারো মুক্তচিন্তার কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। ফলে আমাদের উচিত বইমেলার শৃঙ্খলা বজায় রাখা। আমাদের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখা।

অমর একুশে বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। বিশেষ করে লেখক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও সংস্কৃতিকর্মীর মিলনমেলা। বইমেলায় প্রাণ খুঁজে পায় বাংলা ভাষাভাষি। লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে অচ্ছেদ্য সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। নতুন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় মুখর হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। পাঠক অগণিত লেখকের মাঝে খুঁজে নেন তার প্রিয় লেখককে। বইয়ের ভিড়ে খুঁজে নেন তার প্রিয় বইটি। পার্থক্য করতে শেখেন ভালো-মন্দের। ভালো গল্পের যেমন একটা প্রভাব থাকে, তেমনি মন্দ লেখারও একটা প্রভাব কিন্তু থেকেই যায়। দিন দিন বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে কী লাভ? মানুষ যদি মানুষ না হয়। মানুষের মতো মানুষ সৃষ্টি এখন সময়ের দাবি। শিল্পের প্রসার হোক। শিল্পের ধরন পরিবর্তন হোক। তবু শিল্প হয়েই টিকে থাকুক শিল্প। যেহেতু এখনো প্রকাশনা ও লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সুতরাং এর থেকে উত্তরণ দরকার। ফলে সচেষ্ট হতে হবে লেখক ও প্রকাশকদের। প্রকাশনার মানোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। লেখক-প্রকাশক উভয়ের আন্তরিক প্রয়াসে দেশের প্রকাশনা জগৎকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে হবে। সমালোচকরা মনে করেন, যে বই জনপ্রিয়তার কাছে দাসত্ব করছে, সে বই খারাপ। যে বই মননকে স্পর্শ করে, ঋদ্ধ করে; সে বই ভালো। ফলে ভালো বইয়ের সংজ্ঞা আছে। কিন্তু আজেবাজে প্রকাশনার ভিড়ে ভালো বই হারিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সম্পাদনা ও পা-ুলিপি যাচাই-বাছাইসহ মানসম্পন্ন লেখকের বই প্রকাশ ও লেখক সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে বইয়ের মানোন্নয়নে সরকার, লেখক-প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।

স্বীকার করতে অসুবিধা নেই যে, আমাদের প্রকাশনাশিল্প অনেক দূর এগিয়েছে। তাই আর একটু যত্নবান হলেই সব ভুল দূর করা সম্ভব। যে কারণে লেখার মানের দিকে নজর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। লেখক-প্রকাশক নিজেরা যদি সচেতন না হন, তাহলে বাজে বই প্রকাশ বন্ধ হবে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, কিছু ভালো বই বের হয়। খারাপ বই নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ভালো বই যেন প্রকাশ হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। তবে আশার কথা হলো, এত-এত হতাশার মাঝেও ভালো বই আসছে বাজারে। সারাবছরই আসছে। তবে হইচই পড়ে বইমেলায়। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’ কথাটা সত্য। কিন্তু এখন কথাটা একটু পাল্টে যাচ্ছে। এখন বলা যায়, ‘বই প্রকাশ করে কেউ কেউ দেউলিয়াও হয়।’ যদিও ভালো মানের লেখক যারা, তাদের সেই ভয়টা থাকে না। তাই ভালো লেখক হতে হবে, এর জন্য ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বেশি-বেশি পড়ার-জানার চেষ্টা করতে হবে।

আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করবেন, লেখালেখিতে বরাবরই তরুণের সংখ্যা বেশি। পরে হয়তো সে সংখ্যা কমে আসে। অনেকেই নানাবিধ জটিলতায় পড়ে কাব্য বা সাহিত্যচর্চার মতো অতীব জটিল বিষয়টিকে ধরে রাখতে পারেন না। হয়তো এই বহুসংখ্যক লেখক-কবির মধ্য থেকেই আগামীর পথপ্রদর্শক কেউ বেরিয়ে আসবেন। জাতি সেই অপেক্ষায় আয়োজন করে বইমেলার। ফসলের মাঝে কিছু আগাছা তো থাকবেই। তা বলে তো আর ফসল ফলানো বন্ধ হয়ে যাবে না। এর জন্য আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তবে আমরা মনে করি, বছরজুড়েই বই প্রকাশ হওয়া দরকার। ইউরোপ-আমেরিকায় সেটাই হয়। এই কম সময়ে তাড়াহুড়োর মাঝে ভালো বই পাঠক বাছাই করতে পারেন না। এর জন্য আরো সময় দরকার। বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনাবহুল রিভিউ দরকার। মেলার একমাসে হয়তো সে সুযোগ হয় না। হয়তো কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। ব্যবসা আর পরিশুদ্ধ সাহিত্যের প্রসার কিন্তু এক কথা নয়। তাই প্রকাশনা সংস্থাগুলোয় শিক্ষিত রুচিশীল সম্পাদক নিয়োগ দিতে হবে। এমনকি সারাদেশে প্রচুর ভালো লেখক আছেন, তাদের খুঁজে বের করতে হবে।

শুধু তা-ই নয়, প্রকাশনাশিল্পকে বাঁচাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেকোনো শিল্প শুধু বিত্তশালীর জন্য হতে পারে না। নিম্নবিত্তের জন্যও শিল্প থাকা জরুরি। তাই শিল্পকে উভয় বান্ধব হতে হয়। লেখক-প্রকাশক-পাঠক মিলেই এ শিল্প টিকে আছে। আর প্রকাশনাশিল্পের ওপর নির্ভর করে টিকে আছে কতগুলো পরিবার। কেননা প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলাকে ঘিরে আশার আলো দেখে প্রকাশনাশিল্প। তাই পাঠক বরাবরের মতোই আসুক বইমেলায়। মন চাইলে বই কিনবে, না চাইলে ঘুরে ঘুরে দেখুক। কিছু বই তো বিক্রি হবেই। নতুন বইয়ের দাম অনুযায়ী বিক্রি কম হলেই ক্ষতি কী? আশা রাখি, আগামী সপ্তাহ থেকেই অমর একুশে বইমেলা জমে উঠবে। আরো নতুন নতুন বই প্রকাশ হবে। মেলার শেষদিন পর্যন্ত নতুন বই আসবে। প্রকাশক-আয়োজকের মুখে হাসি ফুটবে। লেখক-পাঠকের সম্পর্ক আরো গভীর হবে। প্রকাশক-লেখক-পাঠকে মুখর হয়ে উঠবে বইমেলা প্রাঙ্গণ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close