রুখসানা কাজল
ধারাবাহিক উপন্যাস- ১০
বায়োস্কোপ
খুশিতে হইহই করে উঠেছিল ওমর। সেই রাতে কিছু পুরোনো কবিতাসহ মায়কোভস্কির কবিতাসমগ্র, মাহমুদ দারবিশ আর নাজিম হিকমতের কবিতার বই পূরবীর কাছে গচ্ছিত রেখে হাটে গিয়েছিল ওমর চাল ডাল তেল কিনতে। সেই সঙ্গে ঢাকার যে বাম ঘেঁষা পত্রিকায় ছদ্মনামে ওর কবিতা ছাপা হয় তাদের কবিতা পাঠাতে। কী ভেবে ওমরের কবিতাগুলো দেখতে দেখতে চমকে উঠেছিল পূরবী। ইনুকে ডেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। ওমরের তিনটে কবিতার শেষে লেখা- নেক্সট তারিখ, অমুক গ্রাম। যে যে ঘাঁটিগুলোতে ওরা থেকে এসেছে, প্রত্যেকটির নাম লেখা। দলপতি হিসেবে ইনু তখন অসম্ভব তীক্ষ্ম এবং ধারালো বুদ্ধির কমরেড ছিল। বুদ্ধিকে নানাভাবে খেলিয়ে এখন পর্যন্ত ওর দলের ৬ জন কমরেডকেই ও সেভ রাখতে পেরেছে। একমাত্র মনির অপারেশন করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছিল গ্রামের চেয়াম্যানের লোকজনের হাতে। যে শোষিত জনগণের মুক্তির জন্য ওরা রাজনীতি করছিল, সেই জনগণই রাত পাহারা দিয়ে রক্ষা করত চেয়ারম্যানকে। তাদের হাতেই চরম ধোলাই খেয়ে আধমরা মনির থানার বারান্দায় পড়ে ধুকছিল মৃত্যুর সঙ্গে। ভিড়ের ভেতর থেকে মনিরকে দেখে সেই প্রথম ইনুর মনের মধ্যে কি যেন হয়ে গেল। খতমে ও আর উৎসাহ পাচ্ছিল না। চলমান রাজনীতির এই ফাঁকটা ও ধরে ফেলেছিল। জনগণ নেই ওদের সঙ্গে। ভারত বাংলাদেশের একই অবস্থা। মনিহারা ফনির মতো। এ দেশের ক্ষুধার্ত জনগণ পেট মোটা জোতদার, ব্যবসায়ী, সরকারের কাছে কিছু না পেয়ে আল্লাহ ভগবানের দোহাই পেড়ে পেটে খিল মেরে মৃত্যুকে মেনে নেয় কিন্তু প্রতিবাদে শামিল হয় না বা প্রতিবাদীদের সঙ্গী হয় না।
ওমরের কবিতার নিচে স্থান তারিখ লেখা দেখে গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ে ইনু। দলীয়ভাবে কঠোর নিয়ম করা ছিল, কেউ কোথাও এমন কিছু লিখবে না যাতে দল বিপদে পড়তে পারে। পুলিশের নাক পিঁপড়ের চাইতেও শক্তিশালী। ওমর কম প্রশিক্ষিত কমরেড হলেও কবিতা লেখার দুর্বলতা ছাড়া অন্য কোনো কিছু নেই ওর মধ্যে। এমনকি আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের দুই বছরের ভেতর একবারের জন্যও বাড়িতে যায়নি। শুধু ওই পত্রিকার জন্য লেখা পাঠানো ছাড়া আর কোথাও কোনো যোগাযোগ নেই ওর। তাছাড়া মূলত ইনুরা পালাচ্ছে। এ মুহূর্তে ভারতের পশ্চিম বাংলা প্রদেশে ওরা ঢুকবে না। সেখানকার পরিস্থিতি ওদের জন্য নরকের চাইতেও ভয়াবহ। ওদের পরবর্তী টার্গেট সুন্দরবনের কোনো অজ গ্রাম। পূরবী ছাড়া আর কেউ জানে না এই সিদ্ধান্ত। বাস্তবতা এখন এমন যে, আক্ষরিক অর্থে জনবিচ্ছিন্ন ডাকাত দলের মতোই ওরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আপাতত চট্টগ্রাম থেকে ফিরে ঢাকার কাছাকাছি কোনো গ্রামে ওরা আছে। গেল দুই মাসে কোনো অপারেশন করেনি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব খতম তত্ত্ব নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেছে। সম্ভবত দল আবার ভাঙছে। ইনু অপেক্ষা করছে খতমবিরোধী অংশের জন্য। আবার এটাও ঠিক ওমরের তিনটি কবিতায় যে স্থানগুলোর নাম লেখা আছে, সেগুলোতে রেইড করেছে স্থানীয় পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনী। তবে প্রতিবারই ওরা আগের দিন সরে যাওয়ার পর ওরা এসেছিল। চিন্তা বাড়ছিল ইনু-পূরবীসহ দলের সবার। পুলিশ কি করে জানতে পারছে ওদের অবস্থান? তাও একেবারে নিখুঁত ধারাবাহিকভাবে? স্থানীয় যে দু-চারজন ওদের সাহায্য করছে তাদের ভেতরের কেউ নয় তো? পাঁচজনই একই ভাবনা ভেবে আরো সচেতন হয়ে যায়। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামগুলো বেছে নেয় ঘাঁটি হিসেবে। যাতে পুলিশ
রক্ষীবাহিনী আসার আগে পালানোর কিছুটা সুযোগ থাকে।
"