রণজিৎ সরকার

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩

বাবার অভাব

গাড়িতে অনেক সিট, কিন্তু ফাঁকা নেই। রাশেদ গাড়ির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন। পাবলিক গাড়ির ভেতরে নিজেকে যতটা সতর্ক রাখা প্রয়োজন তার ততটা সতর্কে থাকার মনোযোগ নেই। তার দুশ্চিন্তা মেয়ের স্কুলের বেতনের টাকা কী করে দেবেন। অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার চেয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত টাকা পাননি। একটু পর মোবাইল ফোনে মেসেজে টুং করে শব্দ হলো। মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখেন পাঁচ হাজার টাকা এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে কল এলো। কলটা করেছেন কাদির। তিনি বললেন, ‘পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছি। পেয়েছেন?’

রাশেদ খুশি হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, পেয়েছি কাদির ভাই। ধন্যবাদ আপনাকে।’

রাশেদের পাশে কয়েকজন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একজন ছেলে সরে গিয়ে একটা মেয়েকে রাশেদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমার পায়ে পাড়া দিচ্ছেন কেন। আবার শরীরে বারবার ধাক্কা দিচ্ছেন কেন?’

পাশে কয়েকজন ছেলে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ইভটিজিং করা হচ্ছে। এই ড্রাইভার গাড়ি থামা।’

ইভটিজিংয়ের কথা শোনামাত্র ড্রাইভার গাড়ি থামালেন। রাশেদের শার্টের কলার ধরে ওর আশপাশে থাকা কয়েকজন ছেলে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল। হেলপারের ইশারায় ড্রাইভার গাড়ি সামনের দিকে চালাতে শুরু করল। কিন্তু গাড়ির যাত্রীরা কোনো কথা বলল না। আসলে ঘটনা কী ঘটেছে! জানার আগ্রহ দেখাল না কেউ। বিপদে যেন না পড়তে হয় সেজন্য ঢাকা শহরের অধিকাংশ লোক অন্যের বিপদে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। রাশেদের বেলায় এমন দৃশ্য দেখা গেল।

রাশেদ বারবার বলছিল, আমি ইভটিজিং করিনি। তবু সবাই বকা দিয়ে নামিয়ে নিয়ে গেল।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে নেমে রাশেদকে লেকের পাশে নিয়ে গেল ওরা। একের পর এক কয়েকজন রাশেদের গালে-মুখে থাপ্পড় মারল। একজন বলল, ‘তোর মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড দে। বিকাশ নম্বরের পাসওয়ার্ড দে।’

রাশেদ দিতে চাইলেন না। থাপ্পড় আর মুখ খারাপ করে বকা দেওয়াতে দুটি পাসওয়ার্ড দিতে বাধ্য হলেন। পাসওয়ার্ড দেওয়ার পর রাশেদ বললেন, ‘আমার বিকাশে পাঁচ হাজার টাকা আছে। টাকাটা নিয়েন না। মাত্র একজনের কাছ থেকে ধার করে নিয়েছি। মেয়ের স্কুলের বেতন দিতে হবে।’

কিন্তু না ওরা কেউ কথা শুনল না। একজন দৌড়ে গিয়ে শুক্রাবাদ থেকে বিকাশের টাকা উঠিয়ে নিয়ে এলো।

একজন বলল, ‘এত কম টাকা নিয়ে ছেড়ে দেব। ওর বউয়ের নম্বর নিয়ে কল কর। বিকাশে টাকা পাঠাতে বল।’

রাশেদের গালে আবারও জোরে জোরে থাপ্পড় দিল একজন। তারপর বলল, ‘এবার তোর বউকে বল, আমি বিপদ পড়েছি, বিকাশে বিশ হাজার টাকা পাঠাও।’

রাশেদ সহজ সরল মানুষ। তাদের কথামতো ভয়ে তাই করতে বাধ্য হলেন। তার বউ বুঝতে পারলেন রাশেদ মহাবিপদে পড়েছেন। সব আত্মীয়স্বজন সবাইকে কল করা শুরু করলেন। তারপর থেকে রাশেদের মোবাইল ফোনে একের পর এক কল আসতে শুরু করল। ওরা বুঝতে পারল। তার বউ বিষয়টা মনে হয় সবাইকে বলে দিয়েছেন। তাই অনেক নম্বর থেকে কল আসছে। কল রিসিভ করে না ওরা। একটু পর মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে দিল।

যে মেয়েটাকে ইভটিজিংয়ের কথা বলা হয়েছে, সে মেয়েটা এত সময় চুপচাপ ছিল। কারণ সে জানে এই পঞ্চাশোর্ধŸ ভদ্রলোক তাকে ইভটিজিং করেননি।

মেয়েটি হঠাৎ বলল, ‘আপনার স্ত্রীর মোবাইল ফোন নম্বরটা দেন।’

রাশেদ মুখস্থ নম্বরটা আবার বলে দিলেন। মেয়েটা তার মোবাইল ফোনে সেভ করে নিলেন। একজন বলল, ‘কি রে লাবনী, ওর বউকে ফোন দিয়ে কি তুই তার ঘর ভেঙে দিবি নাকি।’

কথা শুনে ওরা হেসে ফেলল।

লাবনী বলল, ‘নম্বরটা অস্ত্র হিসাবে রেখে দিলাম। প্রয়োজনে কাজে লাগাব।’

‘ঠিক আছে। মানুষ তো অস্ত্র রাখে নিজে রক্ষা করার জন্য। আবার এই অস্ত্র নিজেকেই ধ্বংস করে দেয়। ধানমণ্ডিতে নিজ বাসায় আবু মহসিন খান নিজের আত্মরক্ষার অস্ত্র নিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। জানি না তুই এই অস্ত্র কোন কাজে লাগাবি। নিজের না অন্যের।’

‘বেশি কথা বলিস না তো। ভালোর জন্যই রাখছি।’

‘ঠিক আছে।’

একজন বলল, ‘মোবাইলটা ওপেন কর। দেখ তো ওনার বউ টাকা পাঠিয়েছেন কি না।’

একজন ওপেন করল। দেখল কয়েকটা মেসেজ এসেছে। কিন্তু বিকাশ থেকে কোনো মেসেজ আসেনি। একজন একটা মেসেজ দেখে অবাক হলেন। মেসেজে লেখা আছে, চাচা আপনার মনে হয় কোনো বিপদ হয়েছে। আমি আপনার ভাগ্নিজামাই শাওন। র‌্যাব-৬ থেকে বলছি।

মেসেজটা পড়ে বলল, ‘ওনাকে আর রাখা ঠিক হবে না। ওনার এক আত্মীয় র‌্যাবে আছেন। তিনি বিষয়টি জেনে গেছেন। আমাদের বিপদ হতে পারে। ওনাকে এখন ছেড়ে দিই।’

একজন আবার বললেন, ‘এত সহজে ছেড়ে দেব না। তাকে কান ধরে ওঠবস করতে হবে। এবং বলতে হবে আর কখনো ইভটিজিং করব না।’ রাশেদ বাধ্য হয়ে তাই করলেন। দৃশ্যটা ভিডিও করল ওরা।

একজন বলল, ‘তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর আমাদের যদি কোনো কিছু হয় তাহলে এই ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দেব তোর কান ধরার ওঠবসের দৃশ্য ভাইরাল করে দেব। আপমানে মুখ দেখাতে পারবি না আর কোথাও।’

রাশেদ অসহায় হয়ে হাতজোড় করে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দেন। আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না।’

করুণ মিনতি আর র‌্যাবের মেসেজ দেখে ওরা ছেড়ে দিল রাশেদকে। পাঁচজন এক হাজার করে টাকা ভাগ করে নিল। তারপর মেসে গেল। লাবনী তার হলে গেল। হলে যাওয়ার পর লাবনীর খারাপ লাগতে শুরু করল। একজন বাবা তার মেয়ের স্কুলের বেতনের টাকা আমরা মিথ্যা নাটক সাজিয়ে নিয়ে নিলাম। লোকটাকে মারধর করলাম। আবার বাবাও এখনো আমাকে আমার প্রয়োজনীয় টাকা দিতে পারেননি। বাবার তো অনেক কষ্ট হয়। মহামারিতে আয় কমেছে, চাকরি হারিয়েছেন, ভাইয়ের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এই শহরে টিকে থাকার জন্য আমরা অপরাধীও হয়ে উঠেছি। এভাবে লোকটার কাছ থেকে টাকাগুলো নেওয়া ঠিক হয়নি। কৃষিশ্রমিক বাবা-মায়ের খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে অন্তু রায় হোস্টেলের খরচ মেটাতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। সে অপরাধে জড়িয়ে যায়নি। অন্যের কাছে হাত পাতেনি। নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। যদিও সে এটা অন্যায় করেছে। বন্ধুরা মিলিয়ে নাটক সাজিয়ে টাকা ছিনিয়ে নিলাম। অপরাধী হয়ে গেলাম। এসব ভাবতে ভাবতে সারারাত ঘুমাতে পারল না লাবনী।

লাবনীকে খুব পছন্দ করে রাজিব। তাদের বাড়ি একই এলাকায়। রাজিব ব্যবসায়ী। বসুন্ধরায় তার কাপড়ের দোকান আছে। তিনি বলেছিলেন, যদি কখনো তার বিপদ হয়, তাকে স্মরণ করতে। লাবনী সকালে রাজিবকে ফোন দিল। দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমার কিছু টাকা খুবই দরকার।’

লাবনী রাজিবের কাছ থেকে টাকা চেয়েছে তাতেই রাজিব আনন্দিত। সঙ্গে সঙ্গে রাজিব বললেন, ‘কত টাকা লাবনী।’

‘ভাইয়া, পাঁচ হাজার হলেই চলবে।’

‘আচ্ছা, তোমার বিকাশ নম্বরটা দাও। আমি এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। পরে এসে দেখা করো।’

‘আমার এই নম্বরটাই বিকাশ নম্বর।’

‘ঠিক আছে। আমি এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

রাজিব দশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলেন। টাকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাবনী রাশেদের স্ত্রীকে ফোন করে বলল, ‘আপনার কি এই নম্বরটা বিকাশ করা।’

‘আপনি কে বলছেন।’

‘আগে বলেন, এই নম্বরটা বিকাশ করা কি না।’

‘হ্যাঁ, বিকাশ করা।’

‘আপনার নম্বরে পাঁচ হাজার টাকা যাবে। মেয়ের স্কুলের বেতন দিয়ে দেবেন।’

‘আপনি কে?’

‘পরিচয় জানতে চাইবেন না প্লিজ। আপনার মেয়ের জন্য আমি প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাব। না করবেন না। আমার পরিচয় জানার চেষ্টা করবেন না।’

‘বলেন কী!’

ফোনটা কেটে দিয়ে লাবনী বিকাশে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিল। বিষয়টা রাশেদকে খুলে বলল তার স্ত্রী। তখন রাশেদ বুঝতে পেরে স্ত্রীকে বললেন, ‘আমার মনে হয়, যে মেয়েটা আমাকে ইভটিজিংয়ের অপবাদ দিয়ে এত কিছু করল। সেই মেয়েটাই টাকাটা পাঠিয়েছে।’

‘আমারও তাই মনে হয়েছে। মেয়েটা তার অপরাধ বুঝতে পেরেছে। আমাদের অভাবও বুঝতে পেরে আমার মেয়ের পড়ালেখার কথা ভেবে সে টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছে।’

‘এখন চুপচাপ থাকো। আর কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।’

‘ঠিক আছে।’

পরদিন মেয়েকে নিয়ে স্কুলের বেতনের টাকা পরিশোধ করলেন বাবা রাশেদ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close