বই আলোচনা
মৌতাত : বিস্তৃত জীবনের চেনারঙ
জীবনে নানা ধরনের ঘটনা ঘটে। বৈচিত্র্যময় ঘটনার মধ্যে কিছু বর্ণময়, মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করতে থাকে, আবার কিছু বর্ণহীন। এসব নিয়েই জীবন, দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা। সেই সব টুকরো টুকরো ঘটনার প্রকাশ থেকেই জন্ম নেয়, এক একটি গল্প।
মৌতাত একটি গল্পগ্রন্থ, লেখক নুসরাত সুলতানা। ৯টি গল্প রয়েছে এ গ্রন্থে। মধ্যবিত্ত জীবনের নানা অনুষঙ্গ, সমস্যা, জটিলতা, পাওয়া, না পাওয়া, খুঁটিনাটি নানা বিষয় সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে এ গ্রন্থে।
রবীন্দ্রনাথ অঙ্ক কষার মতো ছোটগল্পের সূত্র দিয়েছেন, সে সূত্র কেউ কেউ মেনে চলেন, আবার কেউ মানতে চান না কোনো রীতি। এ ব্যাপারে লেখকের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। তিনি ফর্ম ভাঙতে পারেন। একান্ত নিজস্বভাবে উপস্থাপন করতে পারেন, তবে তিনি যা-ই করেন না কেন, ম্যাজিক ও লজিক এ দুয়ের সমন্বয়ে গল্পের বিন্যাস অত্যন্ত জরুরি। কেননা গল্প পাঠের পরে যদি অনুরণন না থাকে, স্মৃতিতে ধরে রাখতে না পারলে প্রচেষ্টা অবশ্যই ব্যাহত হয়। এসব দিকে লক্ষ্য রেখেই নুসরাত সুলতানা তার প্রতিটি গল্পের শরীর তৈরি করেছেন। গল্প পরিবেশনের মুনশিয়ানা আছে। চরিত্রকে ভেঙে, ব্যবচ্ছেদ করে, তার ডিটেইল, সুন্দরভাবে ধরা পড়ে তার গল্পে।
তৃতীয় নয়ন গল্পের কথাই যদি বলি, এটা মলি আর নাজিব আযাদ, দুই অসমবয়সি নর-নারীর প্রেমের গল্প। মলি ছাত্রী আর নাজিব আযাদ তার প্রিয় শিক্ষক। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় মলির ক্লাসমেট রাহিল। স্বাভাবিকভাবে মলি আর রাহিলের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হওয়ার কথা কিন্তু বন্ধুত্ব হয় নাজিব আযাদের সঙ্গে। ‘মলি নাজিবকে একদম শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরে। কানে কানে বলে, ল্যভিউ স্যার।’ এর পরে গল্পের শেষে এসে পাঠক যখন দেখতে পায়, মলি ঠিকই রাহিলকে কাছে টেনে নেয়। তাহলে পাঠক কি ধরে নেবে, লেখক বৃত্তের বাইরে আসতে পারেননি বা লেখক তথাকৃত সামাজিক বেড়াজালে আবদ্ধ? তবে পুরো গল্পে পাঠক একটা সম্মোহনের মধ্যে থাকে। এখানেই নুসরাত সুলতানার গল্পের ভিন্নতা, নিজস্বতা।
লেখক শুধু নগরকেন্দ্রিক গল্প লিখে তৃপ্তি পান না। তাই তিনি ছুটে যান গ্রামে, লেখার মধ্যে ঘুরে ফিরে আসে গাছপালা, পাখি, জমি জেরাত, হাস, মুরগি, শিমের ফুল, লাউ গাছ, লাল শাখ, সবুজ অরণ্য, খাগড়াছড়ির বর্ষবরণের অনুষ্ঠান সাংগ্রাই। গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যান মাটির কাছে, শুনতে পান বিভিন্ন ধরনের পাখির ডাক। রঙিন প্রজাপতি। এরকম ভিন্ন ভিন্ন সব চিত্র। এসব পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে ওঠে পাঠকের মন। গভীর এক অনুভূতি মনকে ছুঁইয়ে যায়। লেখকের কিষানী গল্পে এর যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়। এ গল্পের চরিত্রগুলো গ্রামীণ আবহাওয়ার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার।
প্রকৃতির অকৃতিম বর্ণনা ও পটভূমি প্রকাশের কুশলী কারিগর নুসরাত সুলতানার গল্পে আবহমান বাংলার গ্রাম আশ্চর্য বিস্ময় হয়ে ওঠে আসে। তবে আলোচিত গ্রন্থের বেশির ভাগ গল্পই নগরকেন্দ্রিক, চরিত্রগুলো উচ্চমধ্যবৃত্ত। একই সঙ্গে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল মানুষের কথা তিনি অপকটে বলেছেন, সেটা কখনো ইশারায়, কখনো সরাসরি। কাজেই তার লেখার একশ্রেণির পাঠক এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। তিনি জানেন শব্দের বুননে সঙ্গে কীভাবে কল্পনা-রহস্য এবং আবেগ জুড়ে দিতে হয়। প্রান্তিক মানুষের জীবন নিয়ে তিনি নিজস্ব রীতিতে নতুন এক গদ্যভাষা নির্মাণ করেছেন, যা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং ছুঁয়ে থাকবে দীর্ঘসময়। ভরা পুকুরের জলের মতো টলটলে তার ভাষা, সারস পাখির চোখের মতো প্রখর তার গল্পের প্রতিটি শব্দ।
নুসরাত সুলতানা শুধু লেখার জন্য লেখেন না, তার প্রতিটি লেখায় পাঠক কিছু না কিছু মেসেজ পান, সেটা অবশ্যই পজেটিভ মেসেজ। যেমন, যুদ্ধ জন্ম। তিনি এ গল্পে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটা চিত্র তুলে এনেছেন। নীরা আর কনক দুজন, দুজনকে ভালোবাসে, আর তখনই যুদ্ধ শুরু হয়, পারিবারিকভাবে ওদের দুজনের আকদ সম্পন্ন হয়, এরপর কনক চলে যায় যুদ্ধে এবং একরাতে কনক এসে থেকে যায় নীরার সঙ্গে, এর ফলে জন্ম নেয় শুদ্ধ। শুদ্ধকে অনেকে যুদ্ধশিশু মনে করলেও, পরে প্রমাণিত হয় শুদ্ধ কনক আর নীরারই ছেলে। গল্পটা সাধারণ অর্থে সাদামাটা মনে হলেও, নীরা যখন বলে, ‘সব নারী মুক্তিযোদ্ধা আমার বোন, আর সব যুদ্ধশিশু আমার সন্তান।’ এ আবেগমাখা সত্য কথনে সব পাঠকের ভেতরটা ভিজে উঠবে, একই সঙ্গে লেখককেও স্যালুট জানাবে।
গল্প পরিবেশনার গুণে অন্য এক রূপ পায়, একই সঙ্গে পাঠক পায় অদ্ভুত এক প্রশান্তি। জীবননির্বাহের জন্য কিছু কিছু জটিলতা অবশ্যই গল্পে থাকবে, তবে তা অতিক্রম করাই লেখকের কাজ, যেটা নুসরাত সুলতানা দক্ষতার সঙ্গে করেছেন।
বইটি ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ প্রকাশ করেছে হরিৎপত্র প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন শ ই মামুন। অভিনন্দন গল্প লেখককে।
* সৈয়দ নূরুল আলম
"