শেলী সেনগুপ্তা

  ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২

জীবনানন্দ জননী কুসুমকুমারী দেবী

‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।/মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন,/‘মানুষ’ হইতে হবে, - এই তার পণ।’

এই আকাঙ্ক্ষা যার মনে চির জাগরুক ছিল তিনি হলেন কুসুমকুমারী দেবী, কবি জীবনানন্দের রত্নগর্ভা জননী। বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে অর্থাৎ স্ত্রী শিক্ষার প্রথম যুগে যেসব নারী নিজেদের সাহিত্য সাধনার সঙ্গে যুক্ত রেখেছিলেন, তিনি তাদেরই একজন। সাহিত্য রুচির একটি গভীর ঐকান্তিকতা ছিল তার মধ্যে। নিজের জীবন, সমাজ ও পরিবেশ থেকে গ্রহণযোগ্য ও সহজ আদর্শ ছেঁকে তিনি তা সাহিত্যের উচ্চমার্গে নিয়ে মানুষের জন্য পরিবেশন করেছিলেন। শিশুদের জন্য রেখে গেছেন কিছু আপ্তবাক্য।

বঙ্কিম যুগের এই প্রতিষ্ঠিত ধারণার তিনিই ছিলেন শেষ বাহক। কুসুমকুমারী দেবী শুধু নিজের জীবন আলোকিত করেননি, কবির জীবনেও রেখেছেন কুসুমিত প্রভাব। জীবনের সকল লালিত্যবোধ, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা, নিজের চারপাশকে মনের চোখে ক্ষমতা দেখা তিনি মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন।

প্রকৃতি প্রেমিক কবি জীবনানন্দ দাশের শিক্ষায় হাতে খড়ি হয়েছিল বাড়িতে মায়ের কাছে। পরম স্নেহে ও মমতায় মা তাকে অক্ষর চেনাতেন ও ছড়া মুখস্ত করাতেন।

পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন শিক্ষক, তিনি শিশুদের ওপর অল্প বয়েসে পড়াশোনার বোঝা চাপানো পছন্দ করতেন না। তাই একটু বেশি বয়সে তিনি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তবে গৃহে তার আনন্দময় পঠন-পাঠন ছিল নিরন্তর।

এভাবেই তার স্বাভাবিক কবি মনকে তিনি শিক্ষিত ও স্বতন্ত্র করে তোলবার অবসর পেয়েছিলেন।

জীবনানন্দ দাশ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন, পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও প্রচুর পড়াশোনা করতেন, যার মধ্যে মায়ের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছিল অনেক বেশি। দেশি-বিদেশি কবি ও ঔপন্যাসিকের কোথায় কি ভালো, কীভাবে তারা বিশেষ কি দিয়ে গেছেন, এসবের প্রথম পাঠ তিনি মায়ের কাছে পেয়েছিলেন। মনেপ্রাণে তা তিনি ধারণও করেছিলেন।

কুসুমকুমারী দেবী শুধু সন্তানকেই গ্রন্থমুখী করেননি, নিজেও প্রচুর পড়াশোনা করতেন। একই সঙ্গে লেখালিখিও করতেন, তার প্রথম কবিতার সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। ১৮৮৫ সালে কলকাতা থেকে শিশুদের জন্য প্রকাশিত মাসিক ‘মুকুল’ নামক পত্রিকায় তার কবিতা ‘আদর্শ ছেলে’ প্রকাশ হয়েছিল।

মূলত কিশোর, বালক ও তরুণদের উদ্দেশ্যে রচিত কবিতাগুলোর জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে কবিতা ও প্রবন্ধ লেখার হাত ছিল খুবই ভালো তার। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তার এই ক্ষমতার কদর করতেন এবং ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য উৎসাহ দিতেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শিশুদের জন্য চিত্র শোভিত বর্ণশিক্ষার বই লিখেছিলেন। তার প্রথম ভাগে কুসুমকুমারী দেবী রচিত যুক্তাক্ষরবিহীন ছোট ছোট দু-একটি পদ্যাংশ সংযোজিত হয়েছিল, ‘ছোট নদী দিনরাত বহে কুলকুল/পরপারে আমগাছে থাকে বুলবুল।’

তার রচনার একটি বড় অংশজুড়ে আছে কবিতা, তবে কবিতার পাশাপাশি তিনি ‘স্মৃতিসুধা’ নামে একটি আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন। এছাড়া প্রবন্ধে তিনি ছিলেন অসাধারণ পটীয়সী। ব্রাহ্ম সমাজের বিভিন্ন সভায় তার প্রবন্ধ পাঠ হতো। তিনি ‘নারীর আদর্শ’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে স্বর্ণপদকে সম্মানিত হয়েছিলেন।

কবিতা লেখা ছিল কুসুমকুমারী দেবীর সহজাত দক্ষতার অংশ। এজন্য খুব বেশি পরিশ্রম তাকে করতে হতো না। বিশাল একটা সংসারের সব দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। এর মাঝখানে সময় বের করে কবিতা লেখা ছিল অনেক কঠিন একটা কাজ। তবু এর মধ্যেও তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে কিংবা অনেক সময় কাজের মাঝখানে থেকেও তিনি অতি দ্রুত কবিতা লিখে ফেলেছেন। জীবনানন্দ দাশ তার মায়ের কবিতা লেখা নিয়ে লিখেছেন, ‘কি রকম তাড়াতাড়ি লিখতে পারতেন তিনি। রান্না করছেন, রান্না করছেন, পিসেমশায় আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, এক্ষুণি ‘ব্রহ্মবাদী’র ফর্মা প্রেসে যাচ্ছে, অবিলম্বেই একটি কবিতা লিখে দাও কুসুম। ...অমনি মা খাতাণ্ডকলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে একহাতে খুন্তি আর একহাতে কলম নাড়ছেন। দেখা যেত- যেন চিঠি লিখছেন, বড় একটা ঠেকছে না কোথাও! আচার্য চক্রবর্তীকে প্রায় তখুনি কবিতা দিয়ে দিতেন।’

কুসুমকুমারী দেবী যা লিখতেন তা ছিল সহজ বিশ্বাস, বিভিন্ন বিষয়ে তার মহত্তম অনুভব, সভ্যতার সংকট নিয়ে চিন্তা, প্রেম এবং জীবনের অনেক মৌলিক প্রবণতা নিয়ে কুসুমকুমারী দেবী কবিতা লিখেছেন, ‘এই ভুবনের ওপার হতে আজ/যে গান এল ভেসে সুর সুরে/উদাস করা সেই রাগিণী ধরে/হৃদয় আমার থাকবে দূরে দূরে।’ (ওপারের সুর)।

কুসুমকুমারী দেবী কবিতার পাশাপাশি ডায়েরিও লিখেছেন, যেটি ‘দৈনন্দিন লিপি’ নামে প্রকাশিত ডায়েরিটি ভূমেন্দ্র গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। এখানে পাওয়া যায় আত্মচিন্তায় তন্ময় কুসুমকুমারীর জীবনের হেমন্তবেলার নানা সুর।

তিনি জীবনের বিবর্ণ সময়গুলো অমøান করেছেন তার কবিতায় লেখায়। তার কবিতার বিষাদ ও নিরুত্তাপ অন্ধকার থেকে আলো নিয়ে বোবা অন্ধকারকে দিগ্বিজয় রঙে রাঙিয়ে দিতে চায়।

জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ...‘মা’র কবিতায় আশ্চর্য প্রসাদগুণ ...মা যদি নিজের তখনকার জীবনের কবিতা লেখার বিশিষ্ট ঐতিহ্য অত তাড়াতাড়ি নিরস্ত না ক’রে ফেলতেন, তা হ’লে অনেক কিছুই হতে পারতো। যে সাহিত্যিক ও কবির গরিমা তার প্রাপ্য ছিল, সেটাকে অন্তর্দমিত করে রাখলেন। তিনি প্রকাশ্যে কোনো পুরস্কার নিতেন না।’

এমনই মায়ের সন্তান আজও যে জীবনানন্দ দাশ তিরোধানের এত বছর পরও মানুষের কবিতা মানস নাড়া দিয়ে যাচ্ছেন, তিনি একজন দক্ষ শিল্পীর ছেনিতে গড়া কিংবা তুলিতে আঁকা এক চমৎকার সৃষ্টি। শুধু রক্ত-মাংসেই নয়, মননে-ভাবনে-চেতনেও তিনি কুসুমিত পল্লবিত হয়েছেন মায়ের সস্নেহ সান্নিধ্যে। আমরা জানি না, একজন কুসুমকুমারী না হলে একজন জীবনানন্দ হতো কিনা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close