শেখ ফিরোজ আহমদ
বদলে যাওয়ার কবিতা ‘অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত’
কবিতার মহাযাত্রায় রেজাউদ্দিন স্টালিন আশির দশক থেকে শরিক। তার এই সুদীর্ঘকালের কবিতা চর্চার ফসল ৫৫টি কাব্যগ্রন্থ এবং কবিতা অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন দেশের ৩২টি ভাষায়। সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত’-তে কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের বদলে যাওয়া কবিতার উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। নিজের কবিতা নিয়ে এই সন্ধিক্ষণে উপনীত হতে পারাটা কবির জন্য বড় প্রাপ্তি। পাশাপাশি তার পাঠকদের জন্যও তৃপ্তিদায়ক।
‘অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন, ‘স্টালিনের কৃতিত্ব এই- তার জাদুবাস্তবতা ও পুরাণচেতনা সমকাল-সংলগ্ন ঐতিহ্য এবং পুরাণকে পুনর্লিখন না করে তিনি তাকে করে তোলেন প্রতি অর্থে সৃষ্টিশীল।’ বিশ্বজিৎ ঘোষ স্টালিনের গ্রন্থভুক্ত কবিতার মূল মর্মস্বরূপ কথাটি বলেছেন। তার এই অ্যাপ্রিসিয়েশন রেজাউদ্দিন স্টালিনের কাব্যকৃতির বৃহৎ পরিসরে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। যার অভ্যন্তরে তৃপ্তি ঝলমলে একটি কাব্যভুবন অপেক্ষমাণ। তার নাম ‘অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত’।
এই কাব্যগ্রন্থ রেজাউদ্দিন স্টালিনের সৃজনীশক্তিকে নতুন উচ্চতায় চিনিয়েছে। নিজস্বতার চিহ্ন-লক্ষণ নিয়ে কবিতাগুলো প্রবল প্রতাপে উপস্থিত। ফর্ম-বিষয়-দর্শন-দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির ক্রমাগত ভাঙচুর ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তার কবিতা এখন নির্মাণকলায় স্বকীয়তার প্রাজ্ঞ স্বর নিয়ে উপস্থিত হতে শুরু করেছে। এ সময়ে লেখা স্টালিনের কবিতাগুলোকে ‘বদলে যাওয়ার কবিতা’ বলা যায়। যে কবিতার টোনে দার্শনিক ভাবনার স্মিত বিচ্ছুরণ অনুভূত হয়। তবে গ্রন্থভুক্ত সব কবিতাই ঠিক স্বতঃস্ফূর্ত বলা যাবে না। কিছু কিছু কবিতায় ভাবনাকে দর্শন-বিন্দুতে পিনবদ্ধ করার আরোপণ দেখা যায়। যেমন : ‘শিল্প’ কবিতাটি। কবিতাংশটি গ্রন্থভুক্ত প্রথম কবিতা ‘বিক্ষত পদাবলি’ থেকে নেওয়া- ‘মুক্তিযুদ্ধে বিক্ষত এদেশ দেখলে মনে হতো/পা কেটে ফেলা কোনো অশ্বত্থ/অ্যালেন গিন্সবার্গ বলেছিলেন- /জমাটবাঁধা কান্নার পাহাড়/সেই কান্নার পাহাড় আরো উঁচু হয়েছে/পঞ্চাশ বছর ধরে।’ (বিক্ষত পদাবলি/অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত)।
‘বিক্ষত পদাবলি’র শুরুর ওই পঙ্ক্তিগুলোতে পাই দেশমাতৃকার জন্য অন্তহীন আকুতির বহিঃপ্রকাশ। পুরো বইয়ে এই একটি কবিতাতেই নিজ দেশের পরিস্থিতিগত প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশিত। অন্য কবিতাগুলোতে দর্শন ও ভাবনার নানামুখী অনুসন্ধান দেখতে পাওয়া যায়। ফর্মের সঙ্গে অনুভূতির সূক্ষ্ম মিতালির মাধ্যমে আমাদের ক্ষুদ্র মানবজীবন ও বিশ্বব্রহ্মা-ের নানান সৌন্দর্য তার কবিতায় ফুটে উঠেছে। কখনো কখনো রেজাউদ্দিন স্টালিন টাইম অ্যান্ড স্পেস থেকে বেরিয়ে গেছেন নির্লিপ্ত দূরত্বে- আবার ফিরে ফিরে এসেছেন। কবিতার কুহকজালে তখন মনে হয় এ কি ঘোরগ্রস্ততা, জাদু মুহূর্ত না কি পরাবাস্তব আচ্ছন্নতা- কোথায় ‘আমি’! এই ‘আমিটা’ ছিঁচকাঁদুনে ব্যক্তির ‘আমি’ না থেকে হয়ে পড়ে সমষ্টির প্রতীক ‘আমি’। সত্য এটাই যে, সব মানুষই স্বপ্নকে সম্বল করে ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে এগোতে চায়- সে বুঝতে পারে বিমিশ্র এ অভিজ্ঞতা থেকে নিস্তার নেই কারোর। ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ নামের কবিতায় স্টালিন কি সেজন্যই বলেছেন? ‘স্বপ্নবিক্রেতা জানে/কল্পরাজ্যে কত পাখি ওড়ে/আর নতুন স্বপ্নের সাথে/পুরোনো স্বপ্ন জুড়ে দিলে/কেন সেতু ভেঙে পড়ে।’ (ভবিষ্যদ্বাণী)।
‘বিক্ষত পদাবলি’র বুনন কৌশল থেকে রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় বাঁক বদলের কিছু ইঙ্গিত দৃশ্যমান। প্রথমত, পঙ্ক্তি নির্মাণে সহজ ভাষা ও বর্ণনাত্মক ধরন ব্যবহার। দ্বিতীয়ত, অর্থনিহিত বা মূল বক্তব্য হিসেবে একটি দার্শনিক ভাবনা উপস্থাপন। তৃতীয়ত, কবিতায় চিন্তাকে সময় ধারণার বাইরে নিয়ে গিয়ে আবার সময়ের মধ্যে ফেরত আসা। চতুর্থত, কবিতায় গল্পকথকের নৈপুণ্য ব্যবহারে পারঙ্গমতার মিশ্রণ। পঞ্চমত, কবিতায় ‘ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন’ বা মুক্ত অনুষঙ্গের পরিমিত প্রয়োগ।
ওপরের প্রসঙ্গে মনে পড়ছে- ‘শিল্পী ও সুন্দরী’ কবিতার কথা। এই কবিতার মূলপ্রাণ সহজভাষা সহযোগে বর্ণনাত্মক রীতি। সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে গল্পের স্বাদ। শেষে বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য একটা ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন বা মুক্ত অনুষঙ্গের ব্যবহার ঘটেছে। এগুলো হচ্ছে টেকনিকের দিক। কবিতার সারাংশ এ রকম- নগরে মেলা বসেছে; সেখানে বেলুন-বাঁশি-ফুল-পাখি-নাগরদোলা সবই আছে। আছে তরুণ ফুলদানি বিক্রেতাও। তার কাছে রয়েছে সাদামাটা এবং কারুকাজ করা দু-ধরনের ফুলদানি। এক সুন্দরী ক্রেতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফুলদানি দেখার পর দাম জানতে চাইল। তরুণ বিক্রেতা বলল, দুটোর দাম একই। সুন্দরী ক্রেতা জানতে চাইল, কেন এক দাম? তরুণ ফুলদানি বিক্রেতা বলল, আমি শিল্পী ফুলদানির মূল্য নিতে পারি, সৌন্দর্যের নয়। এই বিস্ময়কর উচ্চারণটিই কবিতায় মুক্ত অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে। কবিতাটির শেষাংশ এ রকম- ‘কিছু ফুলদানি সাদামাটা,/কয়েকটিতে দারুণ কারুকাজ।/মূল্য কত জানতে চাইলো সুন্দরী,/প্রতিটি ফুলদানির দাম একই- /জানালো তরুণ।/কেন কারুকাজগুলোর দাম/সাধারণ ফুলদানির মতো?/আমি শিল্পী ফুলদানির মূল্য নিতে পারি, সৌন্দর্যের নয়।’ (শিল্পী ও সুন্দরী/অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত)।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা নির্মাণে কার্যত পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে কিছু আগে থেকেই। ‘অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত’ কাব্যগ্রন্থটি তার সাম্প্রতিক নমুনা মাত্র। এ গ্রন্থে একটি কবিতা আছে- নাম ‘অন্য একদিন’। পড়ার পর বেশ আনন্দ পাওয়া গেল। কেন এই আনন্দ? তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আমি এর কারণ খুঁজতেও ইচ্ছুক নই। স্রেফ ভালো লাগাটাই এখানে ব্যাপার। কবি টাইম অ্যান্ড স্পেস থেকে আউট হয়েছেন আবার ফিরেও আসেন- শেষাবধি একটা আড়ালের তুমি তার কাছে সময় চিহ্নিত করার উপলক্ষ হয়ে উপস্থিত হয়েছে। অর্থাৎ সময়কে নিয়ে এই যে তিনি খেলেছেন বা জাদু মুহূর্ত বানিয়েছেন কবিতায়- এটাই আমার কাছে বেশি তৃপ্তিদায়ক। তখন মনে হলো, এরপর এ কাব্যগ্রন্থ থেকে রেজাউদ্দিন স্টালিনের আর কোনো কবিতা না পড়লেও চলে- তাতে একটা স্থায়ী আবেশ সঙ্গে রাখা যাবে। কবিতার শুরুর দুই পঙ্ক্তিতে বলা হয়েছে, ‘যে দিনের কথা বলছি/তা কোনো ক্যালেন্ডারে নেই’। শেষ দুই পঙ্ক্তিতে বলা হলো, ‘কীভাবে আসে এই দিন/বুঝি শুধু তোমার পায়ের শব্দ শুনে’। অসাধারণ ঘোর লাগা মুহূর্ত। এই যে ‘তোমার পায়ের শব্দ’- দিনের আগমনকে চিনিয়েছে, এটাই এ কবিতার ইউনিকনেস।
গ্রন্থের সর্বশেষ কবিতা ‘অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত’। শিরোনাম থেকে যে রকম একটা বিপ্লব বিপ্লব কথা-প্রতিমার (ইমেজারি) আমেজ পাওয়া যাচ্ছিল। কবিতায় ঢোকার পর দেখতে পাওয়া গেল সেটা একটা অন্যকিছু। বিচিত্র ফ্যান্টাসি কোলাজের নাট্যিক সমন্বয়ে কবিতার একটা জটিল নির্মাণ মাত্র। খানিকটা স্পষ্টতা, খানিকটা ধোঁয়াশা ও রহস্যময় সমাপ্তি- এটাই এই কবিতার শেষ ট্রিটমেন্ট। কবিতাটি যেভাবে এগিয়েছে- আমাদের শিশুকালে ‘বর্ণপরিচয়’ শেখানোর জন্য অক্ষর অনুযায়ী ভীতিকর বস্তু ও প্রাণীর উদাহরণ টেনে আনা হতো, যেমন- ‘অ-তে অজগর কানের কাছে/ফোঁস-ফোঁস করে’- সে রকম করে। এই ধরনের প্রাণী দিয়ে অক্ষর চেনানোর মনস্তাত্ত্বিক ভীতির প্রতিক্রিয়া সারা জীবন জেঁকে বসে থাকার কথা। কবি তার কবিতায় এ চিন্তাসূত্রটির উপস্থাপন করেছেন। সঙ্গে নির্ভীক ও স্বাধীনচেতা হওয়ার জন্য উপমা হিসেবে আধুনিক বিধ্বংসী সমরাস্ত্র ‘এ কে ফরটি সেভেন’, ভ - খ্রিষ্ট এবং ‘ভালোবাসার স্তনের চাপ’-এর সলিড সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। যার মাধ্যমে অস্ত্র ভেঙে গুঁড়ো হয়। কবিতায় শেষাবধি ভালোবাসার প্রতীকী রূপই ক্ষতবিক্ষত মানব অস্তিত্বের বিজয় নির্মাণ করতে পারে- এ প্রত্যয়ই ব্যক্ত হয়েছে বোধ করি। কবিতায় শক্তিশালী কথা-প্রতিমা তৈরি করে কবি তার চিন্তার এ দর্শনগত স্তরকে সমৃদ্ধ করেছেন।
রেজাউদ্দিন স্টালিন সময়ের অন্যতম কবি। সুদীর্ঘ চর্চার মধ্য দিয়ে তার আপন কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রটি বদলে যাওয়ার সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। তার হাতে আসতে শুরু করেছে সার্বভৌম পঙ্ক্তি- ‘অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত’ সেই জয়ধ্বনির ইঙ্গিত দেয়।
"