রুখসানা কাজল

  ২৫ নভেম্বর, ২০২২

ধারাবাহিক উপন্যাস- ২

বায়োস্কোপ

পূরবীর কোল থেকে কখন যে নেমে গেছে গুস্তাভ একদম বুঝতে পারেনি। ইনুর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ও বুঝতে পারে গুস্তাভ নেমে গেছে। আর খেলতে খেলতে চলে গেছে ইনুর ঘরে। নিশ্চয় বড় মাপের কিছু একটা আকাম করে ফেলেছে গুস্তাভ! চিৎকার শুনে তাই তো মনে হচ্ছে।

গেল কয়েক দিন লেখা নিয়ে দারুণ ব্যস্ত রয়েছে ইনু। এমনিতে কোনো নিয়ম বেঁধে লিখে-টেখে না। কিন্তু এ দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্ব হিসেবে মাঝেমধ্যে বিশেষ কোনো সম্পাদকের অনুরোধে লেখা দেয়। সময় করে দেশ বা বিদেশের এক্সক্লুসিভ যেকোনো পলিটিক্যাল ঘটনার ওপর প্রবন্ধ বা মতামত লিখে বিশিষ্ট পাঠকদের মনে মোচড় ফেলে দেয়। বিষয়টা যদি আমেরিকা হয় তবে তো কোনো কথা নেই। কালক্ষেপণ না করে ইনু সঙ্গে সঙ্গে পুঁজি রাক্ষস আর যুদ্ধবাজ আমেরিকাকে তছনছ করতে ডাবল খুশিতে লিখতে লেগে পড়ে। তাতে সম্পাদকের কেল্লা ফতে। ইনুর লেখা ভালো। ওর বক্তব্যে সুতীব্র ধারের সঙ্গে যুক্ত থাকে সাধারণ মানুষের মানস চাহিদা। ফলে বিদগ্ধজনের আগ্রহ তো থাকেই। তার চেয়ে বেশি, এখনো স্বপ্ন দেখা আদর্শবাদী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ওর লেখার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায় চুম্বকীয় গতিতে।

যে পাঠক ইনুর লেখাটি পড়ে, তৎক্ষণাৎ তার মন হয়ে যায় শানিত ছুরির মতো। নিজেকে লেনিন, মাও সেতুং, চে গুয়েভারা বা চারু মজুমদারের আত্মার কমরেড ভাবতে শুরু করে। ইনুর যুক্তির সঙ্গে একাত্মতা মেনে কুচি কুচি করে সে আমেরিকাকে কেটে ফেলে। লেখাটি আলোচিত হতে থাকে বিভিন্ন মহলে। রাজধানী পেরিয়ে পৌঁছে যায় জেলা শহরে। সেখান থেকে গ্রামে। পত্রিকার দপ্তরে পাঠকদের লাগাতার মন খোলা আবেগের উপচানো পাঠপ্রতিক্রিয়া আসে। সম্পাদক হ্যাপি। আর আমেরিকান সিঙ্গেল মল্টস স্কচ হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে তাড়িয়ে হাসে ইনু। একের পর এক অনুরোধ নিয়ে কল আসতে থাকে। সেসব রিসিভ করে উদাত্ত স্বরে জানিয়ে দেয়, ‘নো নো। নো ব্রাদার। নট নাউ। রিলাক্সে আছি রে ভায়া। আগামী দু-মাসে আর কোনো লেখা নয়। কাইন্ডলি ওয়েট।’ এর পরও অনুরোধের বিরাম হয় না। ইনু তখন হেসে বলে, ‘আরে দেব রে ভায়া, দেবোসিওর। বুড়ো মগজে অক্সিজেন ডিপোজিট করছি। মাস দু-এক যাক। একেবারে গরমাগরম লেখা হাতে পেয়ে যাবে দোস্ত।’

এ দেশের জ্ঞানীর আসনে এখনো তার অস্তিত্ব অটুট আছে। চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে কিছুটা গর্ব আর আত্মতৃপ্তি একা একাই ভোগ করে ইনু। এরপর লেখা নিয়ে বসে পড়ে। দু-মাস পর আবার লিখে দেয় কোনো কলাম, নিবন্ধ বা প্রবন্ধ। এ লেখাতেও থাকে যথেষ্ট যত্ন আর রাজনৈতিক জ্ঞানের চরম মুনশিয়ানা। এর সঙ্গে গুঁজে দেয় সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের ক্ষেপে ওঠার জন্য জ্বালাময়ী উপাদান। দেশের ছিন্নবিচ্ছিন্ন বাম আদর্শের পাঠচক্রগুলোতে আশার সলতে হয়ে জ্বলে ওঠে ইনুর লেখা। ফেসবুকের ওয়ালে দু-একটা পোস্টার-ফোস্টারও পড়ে অবলুপ্ত সাহসের চমক হয়ে। এবার সরকার কিছুটা নড়ে-চড়ে বসে। আর সাধারণ পাঠকের মধ্যে আলোচনায় তুঙ্গে থাকে লেখাটি। মাঝে মাঝে তো এমন হয়, পাঠক এবং সরকার দুপক্ষ হয়ে যায়। পত্রিকার কাটতি বাড়ে হুহু করে। সম্পাদক সাহেবরা আগাম উকিলের সঙ্গে কথা বলে রাখেন। কিছুদিন বেশ একটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি জিইয়ে থাকে। কিন্তু দু-মাস না যেতেই ইনুর নতুন লেখা ছাপা হয়। এবারের লেখা জুড়ে থাকে সরকারের বিশেষ বিশেষ সফলতার গুণগান। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খাত ও ক্ষেত্রে সরকারের নানাবিধ কাজ-কম্মের সবিশেষ সুনাম করে পরিপুষ্ট পোষ্যের মতো নতজানু হয় এ লেখা। ইনুর ওপর বিরক্ত হয়ে নড়চড় খাওয়া সরকার তব্দা খেয়ে যায়। গভীর রাতের পার্টিতে তিন-চারটি গ্লাস চিয়ার্স বলে ঠুকে যায় একে অপরকে। বুড়ো গলায় হল্লা ওঠে। কিছুটা কম বয়েসি নেতা, আমলা, সাংবাদিক, সম্পাদকরা পাঠ শিখে নেন সে হল্লার রেজুলেশন।

আর পত্রিকার সুনাম বিনিময়ে রাজুর জন্য সাম্মানিক হিসেবে অতিরিক্ত মোটাতাজা একটি খাম পাঠিয়ে দেয় গুণগ্রাহী সম্পাদক এবং পত্রিকার মালিকানা গ্রুপ।

কিন্তু গুস্তাভ কী এমন কাজ করল যে, লেখা ফেলে এমন অসহিষ্ণুভাবে চেঁচাচ্ছে ইনাম? বিশ্রী বিশ্রী শব্দের আজেবাজে গালি দিয়ে মুখ ছুটাচ্ছে কেন সে?

একেবারে ক্ষ্যাপার মতো ক্রুদ্ধ গর্জন করে পুবের ঘর থেকে এবার বারান্দায় চলে আসে ইনু, ‘কী হচ্ছে কী পূরবী? সামান্য একটা কুকুর তাও সামলাতে পারছো না! নাকি ইচ্ছে করে ছেড়ে দিচ্ছ আমাকে জ্বালাতে! উফফ্?, কী সাংঘাতিক ষড়যন্ত্রকারী মহিলা। শরীরে তো পারলে না। এখন কুবুদ্ধিতে খেল খেলাচ্ছো! বাহ বাহ ঘষেটি বেগম! এই শালার বাঁটকু কুকুরটা দিয়ে আমার লেখার দফারফা করে দিলে তো তুমি! হিংসুটে খোঁড়া মাগি। দাঁড়া, এবার দেখাচ্ছি মজা!’

ইনুর গালাগাল শুনে এক ঝলক রক্ত খেলে যায় পূরবীর বিব্রত বয়স্ক মুখে। কী বলবে ভেবে পায় না। কিছুটা ভয়ও পায়। রাগের তাণ্ডবে একবার হুইলচেয়ার উল্টে ওকে ফেলে দিয়েছিল ইনু। ভাগ্যিস সে সময় মেয়েরা ঘরে ছিল! মাথা এবং মুখে ব্যথা পেলেও বেঁচে গেছে সেবার। কম হুলুস্থুল হয়নি তা নিয়ে। বড় মেয়ের ঝোলা ব্যাগে সব সময় স্টিলের একটি ছোট চাইনিজ হাতুড়ি থাকে। সেদিন দুবোন বেশ কয়েক ঘা মেরে দিয়েছিল ইনুকে। বাবা বলে কোনো রেয়াত করেনি ওরা। সেই থেকে পূরবীকে ছুঁতে আর সাহস পায় না ইনু। তা ছাড়া দুই মেয়ের নিয়োজিত দুজন শক্তিশালী মহিলা আছে। এরা পূরবীকে দেখাশোনা করে। ইনু পূরবীর সংসার নামের এই লোকদেখানো প্রতিষ্ঠানকে ওরাই পরিচালনা করে। এমনিতে ক্ষীণ দেহের কমজোরি ইনু সহসা এই মহিলাদের মুখোমুখি হতে চায় না। সময়ে খাওয়া-দাওয়া করে নিজের ঘরে চলে যায়। চা-নাশতা পানি পেয়ে যায় নির্দিষ্ট সময়। তা ছাড়া ডিজিটালের আশীর্বাদে এ যুগে কাছেপিঠে বা ঘরে লোকজন না থাকলেও কেউ এখন একাকী হয় না। দৈবপ্রাপ্তির মতো মোবাইল আর ফেসবুক মানুষের মানসিক একাকিত্বকে অনেকটা কমিয়ে দিতে পেরেছে।

আজ কর্মসহায়িকা দুজনের কেউ বাসায় নেই। বড় মেয়ে ডেকেছে। ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ আন্দোলন মিছিলে যোগ দিতে ওরা দুজনেই বেরিয়ে গেছে। টেবিলে রেডি করে রেখে গেছে দুপুরের খাবার। এসব অবশ্য ইনু জানে না। খোঁড়া অচল হলেও এ সংসার এবং এই ফ্ল্যাটের মালিক যে পূরবী, সে কথা কর্মসহায়িকাদের ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে দুবোন।

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে পূরবীকে একগাদা গালাগাল করে ইনু। তারপর গজগজ করতে করতে প্যাসেজ ধরে ভেতরে চলে যায়।

একটু পরেই চব্বিশ শ স্কয়ার ফুটের নিঝুম ফ্ল্যাটের বাতাস কেটে গুস্তাভের চিৎকার ভেসে আসে। বিস্ময়ে কেঁপে ওঠে পূরবী। কী আশ্চর্য! ইনু মারছে কুকুরটাকে। ওর শরীর বেঁকে যায় অপমান আর উত্তেজনায়। বুঝতে পারে, ক্রোধে উন্মত্ত ইনু ওকে মারতে না পেরে বেচারা গুস্তাভের ওপর শোধ তুলছে। চরম নিষ্ঠুরের মতো মারছে অবলা জীবটাকে। নির্দয় আক্রোশ ঝরে পড়ছে তাতে। একই সঙ্গে ছুটছে মুখ খারাপের নোংরা ফোয়ারা। প্রতিটি মার যেন ওর গায়ে এসে পড়ছে। প্রতিটি গালি ওর মনটাকে কুৎসিত কালো করে দিচ্ছে। অপমানে বোবা হয়ে যায় পূরবী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close