আলমগীর খোরশেদ
গল্প
বাদল রাতে ভূতের ভয়
তখন বর্ষাকাল। বৃষ্টি শুরু হলে দাঁড়ি, কমা মানে না যেন। থামার নামণ্ডগন্ধও থাকে না। বিনতি নানু বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। অজপাড়াগাঁয়ে নানুবাড়ি। বিদ্যুৎ না থাকায় কুপিবাতি আর সারা বাড়িতে একটাই গোল চিমনির হারিকেন। আসার পর থেকেই বৃষ্টি আর বৃষ্টি, একেবারে বন্দিজীবন। বিনতির মনটাই খারাপ হয়ে যায়। বাড়ির সামনেই বিল। পানি আর পানি। বিলপাড়েই শ্মশান। বড় বড় চারটা শিমুলগাছ, কয়েকটা শেওড়াগাছ, গাবগাছ, তালগাছ কয়েকটা এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে বেহায়া মানুষের মতো, কারো কথা, মানা অগ্রাহ্য করে। গ্রামের বাড়ি, সন্ধ্যার পরই যেন মধ্যরাত উঁকি মারে।
- যে বাদলা পড়ছে, সাত দিন তো যাই যাই। বিনতির নানু মিরানা বেগম পানের বাটা হাতে নিয়ে বসতে বসতে বললেন।
- কী বলো নানু? এত দিন কেন?
- এহন তো কম বিনতি, আমরা ছোডো সময় দেখতাম, বাদলা শুরু অইলে দশ-বারো দিন চইল্যেয়া যাইতো।
- এত বৃষ্টি ভালো লাগে না আমার, নানু।
- এইডা তো আল্লার আতো। আমরার কিচ্ছু নাই করার। দোহানপাট বেবাক বন্ধ, ঘরো কেরাসিন তেল নাই, তোমরা বেহেই খাওয়া দাওয়া কইরা লাও।
সন্ধ্যা সাতটার আগেই খাওয়া-দাওয়া শেষ। বিনতি ওর ভাইয়া শোভন শহরে এগারোটার আগে শোতে যায় না কোনো দিন। আব্বু রহমত সাহেব আসেননি, অফিসের কাজে ছুটি পাননি, তাই। নানুবাড়ির উঠোন জুড়ে ফলের গাছ। পেয়ারা, বরই, ঘরের পেছনেই আমগাছ। তার পেছনেই অনেক বড় জঙ্গল। দিনের বেলাতেই ভয় কাজ করছে মনে বিনতির। বৃষ্টির সঙ্গে যোগ হলো জোরে বাতাস। সামনে খোলা বিল, বাতাস জোরে এসে প্রথম ধাক্কা দেয় গাছগুলোকে, আর গাছ উপড়ে পড়ছে টিনের চালে। বাতাসের ধাক্কায় টিনের ঘর কেঁপে উঠে যেন।
- নানু, ঘূর্ণিঝড় নাকি?
- লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) পড়ো মনে মনে তোমরা।
- কিছুক্ষণ জোরে ও আস্তে কলিমা পড়ে গলা শুকিয়ে আসে বিনতির।
- নানু, পানি খাব।
- দাঁড়াও, আনতাছি। কলসিতে বুরাইয়া।
পানি খেয়ে নানুকে জড়িয়ে ধরে বিনতি।
- নানু, গল্প বলো।
- কিয়ের কিছসা হোনতে চাও?
- ভূতের নানু।
- না আম্মা, এদের ভূত টুথ বলো না। পরে দেখবা, হিসু করতে গেলেও তিনজন পাহারাদার লাগবে, ভয়ের কারণে।
- না, নানু। আমি বাসায় টিভিতে ভূতের ছবি দেখি। কোনো অসুবিধা হবে না।
- আইচ্ছা আবুদোবে কিছসা, হোনতো চায়, না করিস না।
- নানুমণি অনেক ভালো। বলো।
- তহন আমি চোডু। তোমার বয়সি বিনতি। পাঁচ বছর বয়সেই তোমার নানার লগে বিয়া অয় আমার।
- কী বলো নানু, তোমরা বাল্যবিবাহ করেছিলে? জানো, এটা কত বড় অপরাধ, আইনে?
- কিতা যে কও, আমরার সময় বেহেই বাল্যবিয়াই করতো।
- আচ্ছা, গল্প বলে যাও নানু।
- তোমার নানা আমারে লইয়া বিলপাড়, সিতাশাল নাও লইয়া শালুক, ভ্যাট, তোলা সব করতাইন। এক দিন আমার কি মন চাইলো, সিতাশাল, বিল পাড়ে একলা চইলা গেলাম। দুপুর থেইক্যেয়া রাইত অইয়া গেল, আমি এত হাঁডি, ঘুইরা ফিইরা সিতাশালেই খাড়া। বাড়িতে আসার রাস্তা ভুইলা গেছি।
- সিতাশাল কী নানু?
- শ্মশান রে গাধা, বুঝোছ না? - বিনতির ভাইয়া শোভন বলে ওঠে।
- আম্মু, ভাইয়া আমাকে গাধা বলল কেন?
- কোন কাইজ্জেয়া করবি না। নানুর গল্প শোন।
- নানু বলো।
- সিতাশালো এই দিন খুব সহালে মরা পুড়ছিল। আমরার বাড়ির উত্তরপাড়ার ঘোষবাড়ির বউ পোলাপান অয়না দেইখ্যেয়া মেরে ফেলছিল বিষ দিয়া। আমি তো জানতাম না। বিলপাড় সিতাশাল, জঙ্গলো ঘুরলাম, বাড়ির রাস্তা পাই না। তোমার নানা, আমার হৌরি, বেহেই হারিকেন লইয়া বিলপাড়ে শিমুলগাছের নিচে আমারে পায়। বাড়িত আইন্যেয়া রাইতই গরম পানিতে বরই পাতা দিয়া গোসল করাইয়া ঘরে নিলো। সাত দিন নিরামিষ, গলায় চার পাঁচটা তাবিজ দিল আমার হৌরি।
সবাই কইলো, আমারে ‘আন্দাওয়ালা’ ভূতে ধরছে।
- আন্দাওয়ালা ভূত, কেমন নানু? - বিনতি জিজ্ঞাসা করে।
- এইডা একটা ভূত। কানাওয়ালা ভূতও কয়। মাইনসেরে এলহা পাইলেই ধরে, সারাক্ষণ হাঁটাইবো, রাস্তা ভুলাইয়া দিবো। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গাতেই থাকবা। কাহিল হয়ে গেলে ঘাড়টা মটকাইয়া ভাঙ্গিয়া রক্ত খাইয়া ফেলে এই ভূত।
- পরে তোমার কী হলো নানু?
- আমার আর কী অইবো? ডানায়, গলায় তাবিজ দিল কবিরাজ বেডা।
বৃষ্টির তোড়, সঙ্গে জোরে বাতাস। হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকানি। পৃথিবী সাদা আলোয় ভরিয়ে দিয়ে আবার অন্ধকারে হারিয়ে যায়। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ যেন, কেউ ঢিল ছুড়ছে এমন।
- আম্মু, টিনের শব্দে ঘুমাতে পারি না। - বিনতি বলে।
- এসব বৃষ্টির শব্দ। টিনে পড়ে শব্দটা হচ্ছে।
নানু একটা পান খেয়ে নিলেন। জর্দার সুবাস, ভালোই লাগে পান খাওয়া মানুষ। ভাবে বিনতি আর শোভন।
- নানু আবার শুরু করো গল্প। ভূতের।
- কোনডা কইয়াম?
- শাকচুন্নী ভূতেরটা, নানু।
- শাকচুন্নী অইলো এক ধরনের পেত্নী। অল্পবয়সী বিবাহিত্যেয়া মাইয়ারা কোন কারণে মইরা গেলে এর আত্মারা শাকচুন্নী অয়। জঙ্গল, রাস্তার লগে শেওড়া, হিমুল, গাবগাছ এরা থাহে। কেউ অসময়ে গেলেই হেরে ধরে। তোমার মাইঝ্যা মামা শাওন। তহন ক্লাস টেনে পড়ে। মেঘ শুরু অইলেই কুইচ, জাল লইয়া মাছ ধরতে যাইবোই। এক দিন গেল মাছ ধরতে বিলো। গিয়া দেহে, সাদা শাড়ি পইরা সুন্দরী একটা মেয়ে বইসা ফুঁফাইয়া ফুঁফাইয়া কাঁদতেছে। শাকচুন্নীরা নদী, পাগাড় বড় গাছ, বেবাক তানো সুন্দর পোলা দেখলেই ফাঁদে ফেলতো চায়। শাওন দেহে মাছ তার চোলায় নাই। যতই মাছ ধরে, থাহে না। শাওন বুঝতাছে, এইতা শাকুচন্নীর ভূতের কাম। এক দৌড়ে আইয়া পড়ল বাইত।
- মেছোভূত কী করে নানু?
- মাচ্ছোয়া ভূত তো খালি মাছের লাইগ্যেয়া পাগল। বাজার থেইক্যেয়া বড় মাছ কিননিয়া আওনের সময় ঐ মানুষটারেই ধরে। আমরা বাড়ির কামের ছেড়া মোতালেবরে ধরছিল মাচ্ছোয়্যা ভূতু।
- কেমনে নানু?
- সিতাশালের ধার দিয়া পাকুন্দিয়া বাজারে যাওয়ার রাস্তা। মোতালেব বাজার থেইক্যেয়া মাছ লইয়া আইতাছে। সিতাশালের ধারো গাবগাছের নিচে দুজন ভূত তার রাস্তা আটকায়। বড় বড় শৈল মাছের ব্যাগটা হাত থেইক্যেয়া নিয়া খচখচ করে খেয়ে ফেলে ভূতরা।
- মোতালেব কী করল নানু?
- মোতালেব কী তাহে নাহি আর? এক দৌড়ে বাইত। সবাই হের চিৎকার হুইন্যেয়া হারিকেন, লাইট লইয়া বাইর অয়।
- নিশি ভূত কী নানু?
- নিশি ভূত খুব খারাপ। মাইনস্যেরে গভীর রাইতে শুর কইরা নাম ধইরা ডাকে। যারা বুইজঝা লায়, তারা চুপ কইরা থাহে। বাইর অইলেই বিপদে ফালাইয়া দেয়। নির্জনে পাইলে আক্রমণ করে।
- আর মামদো ভূতরা কী করে নানু?
- মামদো ভূত অতো দুষ্টু থাহে না। এরা মুসলমানদের আত্মা। শিমুলগাছ, গাবগাছ, বটগাছে দল বাইন্ধ্যেয়া থাহে এরা।
- আর আলেয়া ভূত কী করে নানু?
- আলেয়া অইলো পাগারো, খালের গ্যামের ভূত। এরা জালোরা মাছ ধরতে গেলে বিপদে ফালায়।
বিকট শব্দে দূরে বাজ পড়ে। নানু গল্প বলায় বিরতি দেন। এত শব্দ- যেন কাছেই পড়ল কোথাও।
- কিতা যে অইলো, এত বাদলা, কবে শেষ অইবো গো আল্লাহ?
- বলতে বলতে নানু পানের বাটা হাতে নেন। আরেকটা পান মুখে নিয়ে বলেন-
- ঘুম আইয়ে না বুঝি আমরার বিনতির চৌক্কো?
- না, নানু, আর কী ভূত আছে? বলো তো?
- বাংলাদেশের গেরামগুলাতে জঙ্গল, বিল, খাল, নদী, পাগাড় জলাভূমি, শ্মশান যেমন আছে, ভূতের কিচ্ছাও তেমুন আছে।
- শোভন বলে উঠল।
- আচ্ছা নানু, মোহিনী ভূত কী? - বিনতি বলে।
- বিনতি তো দেহি ব্যকতাই জানে। কোনো মোহিনী ভূত মাইয়ারা, মইরা গেলে হেরার আত্মারা মোহিনী ভূত হয়ে যায়। সুন্দর পোলা দেখলেই ধরে এরা।
- কীভাবে নানু?
- এইডারও একটা মজার ঘটনা আছে। হোনো তোমরা।
- কী নানু, বলো তো? - শোভন বলল।
- এই হানো আমরা নয়া বাড়ি বানছে তহন। উঠানে তোমার নানা বড় একটা বাগান করছিল। নানান জায়গা থেইক্যেয়া অনেক ফুলের চারা লাগাইছিল। গোলাপ, গন্ধরাজ, বেলি, কামিনী, শিউলি, গ্যান্দা আরো কত সুন্দর ফুল। চান্নি রাইতে ফুলের সুবাসে সারাডা বাড়ি মণ্ডম করত। একরাইতে দেহি, বড় বড় কালো রঙ্গের সাপ ফুলগাছ পেঁচাইয়া ফুলের ঘ্রাণ লয়। গাছের কাছে গেলেই সাপ মিলয়ে যাইত। এক দিন খুব সহালে। আমি ফজরের নামাজ পড়তে উঠলাম। দেহি, তোমার নানারে দুইডা সুন্দরী মাইয়া জানালা দিয়া টানতাছে। আমি দৌড়ায়া গেলাম। সুন্দরী মাইয়া দুইডারে বহা দিলাম। ছাড়ার লাইগ্যয়া কইলাম। হেরা আমারে একটা কাঠ দিয়া জোরে ইডা মারল। হাতে লাগল আমার। আমার চিৎকারে মেয়ে দুইডা চইলা গেল। হেরপর থেইক্যেয়া পূর্ণিমা অমাবস্যা আইলে বুকের ব্যথাটা বাড়ে।
- কি বলো নানু? কথা সত্যি?
- হ্যাঁ, মিছা কইতাম কেরে।
- হা হা হা-করে হেসে উঠে শোভন।
- নানু, নানারে লইয়া টানাটানি করছে ভূতের সাথে নানু যা বললেন।
- তোমরা অইলা টাউনের মানুষ। বিশ্বাস করবা না।
- নানু, ভূত বলতে কিচ্ছু নাই।
- গেরামো থাকলে বুঝবা, ভূত আছে কি না।
- নানু, সায়েন্স ভূত মানে না। এটা জাস্ট একটা মনো অঙ্কের খেলা। ভূত দেখার ব্যাপারটা চোখের বিভ্রম। যা মতিভ্রম বা মায়া। ইংরেজিতে এটাকে বলে হ্যালুসিনেশান। মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো উল্টাপাল্টা ভাবনায় প্রভাবিত হয় চোখের দৃষ্টিকে ভ্রম ঘটায়ে তার চিন্তা অনুযায়ী ম্যাটারিয়েলটাই চোখে দেখে।
- বুঝলাম না ভাইয়া, বুঝিয়ে বলো। - বিনতি বলে।
- শোন বিনতি। বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ ব্রায়ান কক্স, পরমাণু নিয়ে গবেষণা তার। তার মতে ভূত বলতে কিছুই নেই। থার্মোডাইনামিকসের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী এনার্জি উত্তাপে লোপ পায়। কক্সের মতে, ভূত যদি থাকত, তবে তারা যেকোনো এনার্জি দিয়েই গঠিত হতো। ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার’ বিশ্বের বৃহত্তম আনবিক বিশ্লেষণ যন্ত্র। চৌম্বক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই যন্ত্র মহাজগতের মৌলিক বস্তুসমূহকে বুঝতে চায়।
- মানে কী ভাইয়া?
- মানে খুবই সহজ। সবই হলো মস্তিষ্কের খেলা। মানুষ যখন ভয় পায়, তখন রক্তের প্রবাহ বাড়ে, যা চোখের দৃষ্টিতে ভ্রম এনে দেয়। তাই ভয় পাওয়ার মুহূর্তে মানুষটি যা তার অবচেতন মন থেকে ভাবে, সেটাই তার চোখে ভাসে। সবার মনে, ভূত মানেই সাদা শাড়ি পরা, ওই ভয় পাওয়া লোকটাও সাদা শাড়ি পরা মেয়েই দেখে। তুই-ই বল, ভূতরা কি সাদা শাড়ি ছাড়া আর কোনো শাড়ি পরতে চায় না?
- আর কোনো কথা নাই বিনতি, শোভন, ঘুমা তোরা- মায়ের ধমকে চুপ হয়ে যায় ভাই বোন।
বিনতির আম্মু খেয়াল করলেন, জানালা থেকে হঠাৎ একটা ছায়ার মতো কি যেন ঘরে গেল, এপাশ থেকে ওপাশে। মুখে কিছু বললেন না। বাচ্চারা সত্যিই ভয় পেয়ে যাবে বললে। বিনতিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমের যতই চেষ্টা করেন, চোখে কেবল ওই ছায়াটাই এসে হাজির হচ্ছে বারবার। একসময় গভীর ঘুমে হারিয়ে যায় সবাই। সরে যাওয়া ছায়ার বিষয়টা অমীমাংসিতই থেকে যায়।
"