সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ঋতুর রানির শুভ্র মেঘের শাড়ি

প্রকৃতির অপরূপ রূপের সৌন্দর্য নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ। সবুজ রঙের অপূর্ব চিত্রকর্ম মন কাড়ে সবার। শস্য-শ্যামল দেশটি বহুগুণে গুণান্বিত। দেশটির এ সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ছয়টি ঋতু। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত- তার আপন মহিমা নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। নানান রূপের ছটায় থমকে দাঁড়ায় পথিকবর। আটষট্টি হাজার গ্রামবাংলার সবুজ-শ্যামল রূপ কবিদের মনেও আনন্দের হিল্লোল বয়ে আনে। শিল্পীর কণ্ঠে আনে গান। চিত্রকরের তুলিতে আনে বর্ণিল আবহ। কৃষকের মনে আনে প্রশান্তি, দেহে আনে শক্তি। প্রত্যেকটি ঋতুর আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য হাজির হয় আমাদের সামনে। তাই তো বলা যায়, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি।/সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’

সেই ‘সকল দেশের রানি’র জন্য শরৎকাল যেন ঋতুবৈচিত্র্যের এক অপার বিস্ময়। আমরা জানি, ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ভাদ্র ও আশি^ন মাস শরৎকাল। ছয়টি ঋতুর মধ্যে তৃতীয় ঋতু হচ্ছে শরৎ। এও জানি যে, শরৎকে ইংরেজিতে ‘অটাম’ বলা হয়। আর উত্তর আমেরিকায় একে ‘ফল’ হিসেবে ডাকা হয়। পৃথিবীর চারটি প্রধান ঋতুর একটি হচ্ছে এই শরৎকাল। উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বরে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চে শরৎকাল গ্রীষ্ম ও শীতকালের মধ্যবর্তী ঋতু হিসেবে আগমন করে। এ সময় রাত তাড়াতাড়ি আসে এবং আবহাওয়া ঠান্ডা হতে থাকে। এ সময়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- গাছের পাতা ঝরে যাওয়া।

প্রকৃতিতে শরতের ফুল হচ্ছে- হিমঝুরি, গগনশিরীষ, ছাতিম, পাখিফুল, পান্থপাদপ, বকফুল, মিনজিরি, শেফালি বা শিউলি, জুঁই, হাসনাহেনা, টগর, মল্লিকা, গাঁদা, কলিয়েন্ড্রা ও কাশফুল প্রভৃতি। অন্য ফুলের নাম না জানলেও কিংবা না দেখলেও এই কাশফুল, পরিষ্কার নীল আকাশ আর সবুজ মাঠ- শব্দগুলো শুনলেই মনে আসে ঋতুর রানি শরতের নাম। ফল হিসেবে হাট-বাজারে দেখা মেলে আম, আনারস, পেয়ারা, মাল্টা, আমলকী, জলপাই, জগডুমুর, তাল, অড়বরই, করমচা, চালতা, ডেউয়া ইত্যাদি।

শরৎ তার আপন মহিমায় সবার অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে। জায়গা করে নিয়েছে কবি-সাহিত্যিকদের অন্তরেও। তাই তো কবিগুরু বলেছেন, ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি,/ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।/শরৎ, তোমার শিশির-ধোয়া কুন্তলে/বনের-পথে-লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’ এভাবেই বাঙালির সামনে শরতের সৌন্দর্য উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্যত্র শুভ্রতার ঋতু শরতের বর্ণনা দিয়ে কবিগুরু এভাবেই পঙ্ক্তিমালা সাজিয়েছেন, ‘আজিকে তোমার মধুর মুরতী/হেরিণু শরৎ প্রভাতে/হে মাত বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ/ঝরিছে অনল শোভাতে।’ এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীন গ্রন্থ ‘কুশজাতক’ কাহিনি অবলম্বন করে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যও রচনা করেছেন।

কবিগুরু ছাড়াও সাহিত্যে কাশফুলের কথা নানাভাবে এসেছে। শরতের সৌন্দর্য বর্ণনায় পিছিয়ে নেই বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলামও। তিনি বলেছেন, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলী বিছানো পথে/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ কিরণ রথে- ’ জাতীয় কবির এমন কথামালা শরতের সৌন্দর্যেরই মূর্তিমান বহিঃপ্রকাশ। শুধু তা-ই নয়, তিনি শরতের শিউলি ফুল নিয়ে গেয়েছেন, ‘শিউলী ফুলের মালা দোলে/শারদ রাতের বুকে ঐ।’

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ এ ঋতুর চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রিয়তমাকে। তিনি তার ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতায় লিখেছেন, ‘এখানে আকাশ নীল/নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ফুটে থাকে হিম শাদা/রং তার আশি^নের আলোর মতন।’ তাই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ বারবার শরতের প্রশংসা করেছেন। এ ছাড়া জনপ্রিয় বাংলা গানও রয়েছে শরৎ বন্দনার। উৎপল সেন লিখেছিলেন, ‘আজি শরতের আকাশে মেঘে মেঘে স্বপ্ন ভাসে।’

কবি-সাহিত্যিকরা শরৎকে বলেছেন শুভ্রতার প্রতীক! কেননা সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জোছনা, দিনভর আলো-ছায়ার খেলা নিয়েই তো শরৎ। শরৎকালের প্রথম মাস অর্থাৎ ভাদ্রের শুরু থেকেই শরতের আবির্ভাবটা লক্ষণীয়। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ! জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে তখন আমরা বুঝতে পারি শরৎ এসেছে। শরতের আগমন সত্যিই মধুর।

শরৎ মানেই প্রভাতের শিশিরভেজা শিউলি, ঝিরিঝিরি বাতাসে দোল খাওয়া ধবধবে কাশবন, পদ্মণ্ডশাপলা-শালুকে আচ্ছন্ন জলাভূমি শরতের চিরকালীন রূপ। এক কথায় শিউলি ফোটার দিন। কাশফুলের দিন। নানা ধরনের ফুলদলের মধুগন্ধ বিলানোর দিন। নদীর পাড়ে কিংবা জলার ধারে ফোটে রকমারি কাশফুল। পাশাপাশি হাসনাহেনা, ছাতিম, জারুল ও মল্লিকার রূপ-গন্ধ মোহিত করে সবাইকে। শরতের সকাল শান্ত-স্নিগ্ধ, মিষ্টি আমেজ মাখা। সূর্যরশ্মি পড়ে যেন মনে হয় মুক্তার দানা। বাতাসে শিউলি ফুলের সুগন্ধ মণ্ডম করে। ছোটরা শিউলি ফুলের মালা গেঁথে অনাবিল আনন্দ পায়। কখনো কখনো প্রেমিকা আপনমনে মালা গাঁথে। প্রেমিকপ্রবর তার প্রিয়তমার খোঁপায় গুঁজে দেয় শিউলি ফুলের মালা। আবার কখনো মেঘের আড়ালে সূর্য হারিয়ে যাওয়া। শরৎ আসে মূলত মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরির ভেতর। কখনো ধুমধাম বৃষ্টি, কখনো কাঠফাটা রোদ্দুর। কাঠফাটা রোদ্দুরের পর হঠাৎ বৃষ্টি।

শরতের জোছনার মতো নির্মল স্বচ্ছ জোছনা অন্য ঋতুতে মেলা ভার। বিস্তীর্ণ স্বচ্ছ জলরাশির ওপর ভেসে বেড়ানো ডিঙি নৌকা; ওপরে নীলাকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। স্বচ্ছ স্থির পানিতে সেই চাঁদের প্রতিবিম্ব। তাই তো তন্বী মজুমদার বলেছেন, ‘অনুপম রূপ সৌন্দর্যময়-স্ফীত শরৎ ঋতু ‘শারদ লক্ষ্মী’ নামে পরিচিত। বর্ষণবিধৌত, মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপ-কান্তি, লঘুভার মেঘের অলস-মন্থর নিরুদ্দেশ যাত্রা, আলো-ছায়ার লুকোচুরি, শিউলি ফুলের মন উদাস করা গন্ধ, প্রভাতের তৃণ-পল্লবে নবো শিশিরের আল্পনা, তাতে প্রভাত-সূর্যের রশ্মিপাত ও শুভ্র জোছনা পুলকিত রাত্রি- এই অনুপম রূপ নিয়ে বাংলার বুকে ঘটে শারদ লক্ষ্মীর আনন্দময় আবির্ভাব।’

কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘শরৎ যে এত সুন্দর আগে হয়তো বাঙালি জানতও না। রবীন্দ্রনাথই তার গান, কবিতার মাধ্যমে সবাইকে শরৎকাল উপভোগ করতে শিখিয়েছেন। তার গানগুলো শুনলেই শরতের সমস্ত সৌন্দর্য ধরা পড়ে।’ তিনি আরো বলেন, ‘গ্রামের বধূ যেমন মাটি লেপন করে নিজ গৃহকে নিপুণ করে তোলে, তেমনি শরৎকাল প্রকৃতিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। বর্ষার পরে গাছগুলো সজীব হয়ে ওঠে। আকাশে হালকা মেঘগুলো উড়ে উড়ে যায়।’

মহাকবি কালিদাস শরতের রূপ-সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ,/নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’ কবিতায় তিনি শরৎকালকে নববধূর সঙ্গে তুলনা করেছেন। শরৎকালকে তিনি নববধূর মতো সুসজ্জিত বলে আখ্যা দিয়েছেন। যে রূপ সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শুধু কালিদাসই নন; বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাসের কবিতায়ও শরৎকে তুলে ধরা হয়েছে। কবি শরতের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘ভাদর মাসে অহোনিশি অন্ধকারে।/শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহলে/তাওনা দেখিবো যবে কাঞ্চির মুখ/চিন্তিতে চিন্তিতে মোর ফুটি জায়ির বুক।’ পদ্মাবতীর কবি আলাওল তার কাব্যের ‘ষট ঋতু বর্ণন খণ্ডে’ শরতের রাত যাপনের এক মিলন মধুর দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। কবি বলেছেন, ‘আইল শরৎ ঋতু নির্মল আকাশ।/দোলায় চামর কাশ কুসুম বিকাশ।’

বাস্তব কিংবা সাহিত্যে, স্বপ্ন কিংবা অবলোকনে শরৎ হচ্ছে মেঘের ঋতু, স্পষ্টতার ঋতু। কেননা শরতের আকাশ থাকে ঝকঝকে পরিষ্কার। নীল আকাশের মাঝে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ যেন ভেসে বেড়ায়। শরৎ মানেই নদীর তীরে কাশফুল। শরৎ মানেই গাছে গাছে হাসনাহেনা আর বিলে শাপলার সমারোহ। শরৎ মানেই গাছে পাকা তাল। সেই তাল দিয়ে তৈরি পিঠাণ্ডপায়েস। আর খেতে খেতে আমন ধানের বেড়ে ওঠা চারা।

কালের বিবর্তনে গ্রামগঞ্জে কাশফুলের আধিক্য কমে গেছে। কমে গেছে তালগাছ। মাঠে নেই আমন ধান। নগরায়ণ আর কাল-কারখানার দৌরাত্ম্যে হারিয়ে যাচ্ছে সবই। তাতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিতে। তাই তো মনে দারুণ কষ্ট নিয়ে মুস্তাফা মনোয়ার বলেছেন, ‘আমরা মানুষরা শুধু লোভীর মতো প্রকৃতির কাছ থেকে খাদ্য চাই। কিন্তু প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিছুই করি না। যেমন আগে প্রায় প্রতিটি গ্রামে বটগাছ দেখা গেলেও এখন তেমনটা চোখে পড়ে না। মানুষ নিজের প্রয়োজনে সেগুলো কেটে ফেলেছে। অথচ আগে এই বটগাছকে কেন্দ্র করে কত উৎসব হয়েছে। বটগাছের ছায়ায় মানুষ বিশ্রাম নিয়েছে। আশ্রয় নিয়েছে কতরকম পাখি আর পোকামাকড়। কিন্তু এখন আর সেসব নেই।’

শরতের কোন রূপের কথা বলব? সব রূপই তো মানুষের মনে আনন্দ জাগায়। জাগায় ভালোবাসা। ভাদ্র মাসের দাবদাহে কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি। মানুষের ক্লান্ত মনে এনে দেয় স্বস্তি। এই হঠাৎ বৃষ্টি আবার হঠাৎ রোদ। আবার কখনো রোদের মধ্যেই বৃষ্টির হানা। এই মেঘ-রৌদ্রের এমন লুকোচুরি খেলা আনন্দ দেয় শিশুদের। শিশুরা তখন সমস্বরে গেয়ে ওঠে- ‘রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে, খেঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে।’

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রকৃতি বিশাল প্রভাব ফেলে। সে বর্ষা, বসন্ত, শরৎ বা হেমন্তই হোক না কেন? তাই তো শরতের সৌন্দর্য বর্ণনায় পিছিয়ে নেই আধুনিক কবিরাও। কবি ভবানী প্রসাদ মজুমদার লিখেছেন- ‘শরৎ এলো কী উল্লাসে কাঁপছে নদীর জল/পাখনা মেলে বেড়ায় খেলে প্রজাপতির দল,/বাজলো কাঁসর সাজলো আসর চলরে সবাই চল/মন-গালিচায় বন গালিচায় নামলো খুশির ঢল।’ কবি নির্মলেন্দু গুণ শরতের চিত্র আঁকেন এভাবে- ‘সবে তো এই বর্ষা গেল/শরৎ এলো মাত্র,/এরই মধ্যে শুভ্র কাশে/ভরলো তোমার গাত্র।/ক্ষেতের আলে মুখ নামিয়ে/পুকুরের ঐ পাড়টায়,/হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে/বাঁশবনের ঐ ধারটায়।’

কাশবন, নীল আকাশ, সাদা মেঘ, সবুজ মাঠ, ফুলের সৌরভ- সবই তো শরতের উপাদান। অন্যসব ঋতুর মাঝেও শরতের আবেদন অস্বীকার করার উপায় তো নেই। তবে যেভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে, তাতে আতঙ্কিত হতেই হয়। এই উপাদানগুলো যদি প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যায়, তবে কি আমরা শরৎকে আর খুঁজে পাব? তখন কি চিনতে পারব একে? আমরা কি বলতে পারব- আমাদেরও শরৎকাল ছিল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close