আহমদ বশীর

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

অন্তর্বর্তী সময়

আপা।

কী হলো? মুখ আঁচল দিয়ে ঢাকছো কেন? কাঁদছো? কাঁদছো কেন? খাদিজা। শোনো, কথা বলো।

আপা, আমি কী অপরাধ করছিলাম? কী জন্য আমার জীবনে আল্লায় এত কষ্ট দিলো! আপা আমি কী এগো চিনতাম!!, না জানতাম! গিরামিন ব্যাংকের লোন লইয়া আমার মায়ে আমারে মানুষ করছে। মাইনষের পায়ে ধইরা ধইরা আমরা খাইছি। আমরা বন্দুক-পিস্তল দেহিনাই আপা... আমরা বন্দুক পিস্তল দেহি নাই। আমি যুদ্ধ কি কইতে পারি না।

খাদিজা। শক্ত হও। তোমার কথাবার্তার ওপর এই কেইসটা অনেকখানি নির্ভর করছে। তোমার জীবনে কী হয়েছে, সেটা ইম্পর্টেন্ট না। তুমি আইনের সামনে কথা বলছো, দেশে একটা আইন আছে- সেটা বুঝেসুঝে কথা বলো।

আপাগো, আইন আমারে বাঁচাইবো না। আইন আমারে কী করবো। হায় হায়। আমি অহন কী করমু!

খাদিজা, শোনো। আমরা কিন্তু এখনো জানি না- তোমার ওই ছোট সাহেব কোথায়? আসলে আমরা তো ছোট সাহেবকে চিনতেই পারছি না। তুমি আমাদের সাহায্য করো। তোমার বক্তব্যের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

আপা, আমারে একটু পানি দ্যান, পানি খামু।

নাও পানি খাও।

আচ্ছা, আমরা একটু সিস্টেমিটিক্যালি আসি। তুমি আমার কাছে সবকিছু স্বীকার করো খাদিজা। একটু পরে স্যার আসবেন- তোমাকে আবার মারধর করতে পারেন। তুমি ভয় পেতেও পারো। তাই আমার কাছে তুমি সব খুলে বলো। নো প্রবলেম। আমি প্রায় ১০ বছর ধরে এই লাইনে আছি। তোমার মতো মেয়ের পেটের খবর বের করতে আমার সময় লাগবে না। তবু... তবু আমি সময় নিচ্ছি কারণ, তোমার ওপর আমার বেশ দরদ পড়ে গেছে। আমিও তো মেয়েমানুষ। তোমার কষ্টটা আমি ফিল করি। আচ্ছা বলো, সেই রাতে তোমার বিয়ে হলো কীভাবে?

সেই দিন মায়ের সামনে বইসা বইসা ভাবতাছি- আমি চইলা গেলে মায়ের কী হইবো। এমন সময় আমার খালা আইলো। খালা ওই পোল্ডারের জিয়ানীবাজার মহল্লায় থাকতো। খালা আইসা আমারে লইয়া গেল, সেই সময় খালাও একটা বোরখা পরছে। আমিও মায়ের তালিমারা বোরখা পইরা চুপচাপ পালাইছি। খালার বাসায় আইসা আমি পলাইয়া রইছি সারাদিন। শেষে সন্ধ্যার পরে বাবায় খুঁজতে খুঁজতে আইছে, আইসা খালারে জিগাইছে আমি আইছিনি। খালায় কইছে না, আহে নাই। এদিকে আমি চাইলের মটকার ভিতরে লেপটি মাইরা নিশ্বাস বন্ধ কইরা শুইয়া থাকছি। বাবায় আইসা মটকার ওপরে চাইলের ওপর হাত দিছে। আমার চুল পায় নাই। শেষে চইলা গেছে। কিন্তু...

কিন্তু কী?

রাইতটা আমি চৌকির তলায় চুপচাপ হুইত্যা রইছি। খালায় কইছে, হামেলা এ্যাহানো ছাপায়া তুই থাকতে পারবি না। সবচেয়ে ভালো হইলো, তুই কাইলকা সকালে বাসে কইরা রাধানগর চইলা যা। ওখানে আমার চাচি শাশুড়ি আছে, তুই তাগো বাড়িত কাম কাজ করবি, থাকবি। আমার চাচি শাশুড়ি খুব মায়া করবো। আমি তার কথামতো রাধানগর যাইবার জন্য ঘরের বাইর হইতে গেলাম।

তারপর?

তারপর ঠিক দুপুর বেলা আমার ছোট ভাই দৌড়াইতে দৌড়াইতে আইলো। আইসা কইলো, বোনরে তুমি সত্বর কইরা বাড়ি চলো, বাপে আমাগো মায়েরে মাইরা কিচ্ছু রাখে নাই। অহন বাপে মায়ের গলার ওপর পা চাইপ্যা দাঁড়ায়ে আছে- যদি অহন তুমি বাড়িত চইলা আসো তাইলে বাবায় আর মারে মারবো না। এই কথা শুইন্যা আমি দৌড় দিলাম। বাসায় আইস্যা দেখি মায়ের গলার ওপর পা দিয়া বাবা জিজ্ঞাসা করতেছে, বল তোর মাইয়ারে কোথায় রাখছোস? তর মাইয়া কই? মাইয়া আবার বড় হইছে তারে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে শাদি দিমু। ঠিক কইরা বল, তর মাইয়া কোথায়। না হইলে গলায় পাড়া দিয়া মাইরা ফালামু।

তারপর?

তারপর আমি চিৎকার দিয়া কইলাম মায়েরে ছাইড়া দ্যাও। আমি শাদি করুম, আমি চইলা আইছি। তো তখন বাপে হাসতে হাসতে কইলো, আমি জানি আমার ময়না পক্সক্ষী আমার কথার বাইরে যাইবো না। আয় আয় মা- আইজ তোকে বিয়া দিমু। আমার কত আনন্দ! আমার মাইয়ার বিয়া হইবো। এই বইলা বাবা মায়ের গলা থেইক্যা পা উঠায়া লইলো। আমার ছোট ভাই ভয়ে ঠকঠক কইরা কাঁপতেছিলো। সে আর আমি মারে উঠাইলাম, পানি খাওয়াইলাম।

হু, ভেরি ইন্টারেস্টিং।

তো সেই দিন রাত্রেই আমার বিয়া হইয়া গেলো। বিয়ার রাত্রেই আমারে বোরখা পরানো হইলো। কথা হইলো, নতুন অতিথি লোকটা আমারে লইয়া ঢাকায় চইলা যাইবো। রেলে গাড়িতে কইরা পরদিন সকালে ঢাকায় রওনা হইলাম। পথের মধ্যে আমাগো কুন কথা হয় নাই। ঢাকার স্টেশনে আইস্যা উনি পরথম আমারে কইলেন যে, আমরা অহন একটা হোটেলে উঠমু। তুমি কারো লগে কোন কথা কইবা না। বোরখার ভিতরে থাইক্যা আমি শুধু হু হু কইরা গেলাম। রাইতে উনি বিছানায় আমার কাছে আইলেন। আমি তখন ফুপাইয়া ফুপাইয়া কাঁদতেছিলাম। উনি আমার পিঠে হাত রাখলেন। তারপর খুব মহব্বতের লগে কইলেন, ‘মাইয়া তোমার মনে কুন ডর রাইখো না। আমি তোমারে যেইটা কই সেইটা ভালোভাবে মনে রাইখা চইলো- তোমার কুন কষ্ট হইবো না। মা-বাপরে ছাইড়া আইছো, মনে তো কিছু ব্যথা থাকবোই। এতদিন তুমি বাপমার কাছে ছিলা, তাদের কথা শুইন্যা আইছো। অহন তুমি আমার স্ত্রী, অহন থেইক্যা আমার কথাই তোমারে মাইন্যা চলতে হইবো। রাজে? আমি মাথা নাইড়া কইলাম- হ, হ। এরপর উনি আমারে জড়ায়া ধরলেন।

তার মানে তোমার স্বামী তোমাকে বোঝালো? কিন্তু সে নিজে কী চাকরি-বাকরি করে, এগুলো কিছুই বল্লো না?

না, হেগুলা কিছুই বল্লো না। কিন্তু পরের দিন আমার স্বামীর গলার স্বর বদলাইয়া গেলো। তিনি প্রথমে তার ব্যাগ থেইক্যা কী সব কাগজপত্র আর মেশিনপত্র নামাইলেন। তখনো আমি এগুলি দেখি নাই।

এগুলো কি অস্ত্র ছিল?

পরে হুনছি। এগুলি রিভলভার, পিস্তল।

তারপর?

তিনি কইলেন, ভয় পাইও না। তোমারে কিছু কথা কমু, মন দিয়া হুনো। আমি একটা যুদ্ধের জন্য তোমারে বিয়া করছি। তুমি মেয়ে মানুষ, তোমার বেশি জানার দরকার নাই। মুখতাসার শুধু একটা জিনিস বুঝবা- আমি একটা যুদ্ধ করনের জন্য তোমারে লইয়া আইছি। আমি যা যা কমু, তুমি তাই তাই মাইনা চলবা। আমি কিছুই বুঝি নাই। শুধু উনার কথা শুইন্যা মাথা নাড়াইছি। তখন আমার কেউ নাই। আমার মা নাই, বাবা নাই, আমার ছোট ভাই নাই। আমি জানি, জীবনে আর তাগো লগে দেখা হইবো না। আমি জানি না, আমি কই ভাইস্যা যামু।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close