ড. আফরোজা পারভীন

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’

আত্মপরিচয়ের বিশ্বস্ত দলিল

বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবনকে বর্ণিল আর সৃষ্টিমুখর করেছিলেন কবি। সৃষ্টির উন্মাদনা নিয়েই ছিলেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। বাংলা ভাষার অজেয় প্রতিনিধি তিনি

সব্যসাচী লেখক হিসেবে পরিচিত তিনি। যার দুহাত সমান চলে, তিনিই তো সব্যসাচী। তিনি সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। মঞ্চনাটক, গল্প এবং কবিতায় তার অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম এখনো মানুষের মুখে মুখে। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কিংবা ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’ তাকে আমাদের মাঝে অমর করে রাখবে।

জন্মেছিলেন ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর, কুড়িগ্রাম জেলায়। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা শেষ করেননি। সাংবাদিকতা করেছেন কিছুকাল। ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। পেয়েছেন আরো অনেক সাহিত্য পুরস্কার। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : একদা এক রাজ্যে, বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা, অগ্নি ও জলের কবিতা, রাজনৈতিক কবিতা; গল্প : শীত বিকেল, রক্তগোলাপ, আনন্দের মৃত্যু, জলেশ্বরীর গল্পগুলো; উপন্যাস : বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ; নাটক : পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরুলদীনের সারাজীবন, ঈর্ষা; শিশুতোষ গ্রন্থ : সীমান্তের সিংহাসন।

‘আমার পরিচয়’ সৈয়দ শামসুল হকের একটি বহুল পঠিত ও নন্দিত কবিতা। এই কবিতায় কবি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার নেপথ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পটভূমি তুলে ধরেছেন। কবিতায় কবি আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে বাঙালির পুরোনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সুদীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস আমাদের সামনে এনেছেন। হঠাৎ করে পাওয়া বা রাতারাতি গড়ে ওঠেনি কবির এই আত্মপরিচয়। তার আত্মপরিচয় এ দেশের ঋদ্ধ, সংগ্রামী ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ঘেরা। চর্যাপদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যযাত্রা, পালযুগের চিত্রকলা, বৌদ্ধবিহারের জ্ঞানচর্চা, মুসলিম ধর্ম ও সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ, জমিদারি প্রথা, মৈমনসিংহ গীতিকার জীবন, কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে শুরু করে তিতুমীর, হাজী শরিয়তুল্লাহ, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম প্রমুখের বিপ্লব-বিদ্রোহ একাকার হয়ে আছে তার আত্মপরিচয়ের পেছনে। রবীন্দ্রনাথের বিশাল সৃষ্টি, নজরুলের দ্রোহী চেতনা ও সাম্যবাদ কবির আত্মপরিচয়ের পশ্চাৎ-এ ক্রিয়াশীল। তিনি বাঙালির ভাষা আন্দোলন আর সেই পথ ধরে ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রামের ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় অর্জনের সঙ্গে আত্মপরিচয়টি জুড়ে দিয়েছেন।

‘আমার পরিচয়’ কবিতায় ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলাদেশের মনোরম শ্রী প্রকাশ পেয়েছে। বাঙালির ইতিহাস লড়াই এবং বিবর্তনের। শোষণ, শাসন আর জুলুমের হাত থেকে মুক্ত করেই বাঙালি শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কবি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি তার পরিচয় দিয়েছে গর্বের সঙ্গে। বাঙালির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তার প্রমাণ। বাঙালির যে স্বকীয়তা রয়েছে- তা তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন পরম যত্নে। এ কবিতায় তিনি বাঙালির উত্থান থেকে ক্রমবর্ধমান অবস্থা পর্যন্ত চিত্রিত করেছেন সুনিপুণ হাতে।

কবিতাটি কবির ‘কিশোর কবিতা সমগ্র’ থেকে নেওয়া হয়েছে। এ কবিতার বাঙালির বর্ণাঢ্য অতীতের বয়ানের সঙ্গে সঙ্গে তুলে ধরেছেন বাংলার কৃতী সন্তানদের কথা। এই সন্তানদের যেন দেশবাসী ভুলে না যায়, সেই বোধ থেকে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের সামনে তাদের কথা অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় উপস্থাপন করেছেন। কবিতার ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত হয়েছে দেশের জন্য তার নিবিড় নিখাদ ভালোবাসা। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন- ‘আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি,/আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।/চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।/তেরশত নদী শুধায় আমাকে, ‘কোথা থেকে তুমি এলে?’।

কবি জন্মেছেন এই বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বহু দেশ ঘুরেছেন তিনি। জানেন একাধিক ভাষা। কিন্তু কথা বলেন বাংলায়, ভাববিনিময় করেন বাংলায়। এতেই তিনি স্বচ্ছন্দ। এটি তার মাতৃভাষা। তিনি বাংলাকে ভালোবাসেন। বাংলার আলপথ তার প্রিয়। এই আলপথ দিয়ে তিনি হাজার বছরের পথ পার হয়ে এসেছেন। ‘আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে/আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।/আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে/আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।/এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে।’

চর্যাপদের অক্ষরগুলো আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের আদি ভিত্তি। জালের মতো বিস্তারী নদী আমাদের সংস্কৃতির অংশ। চর্যাপদ থেকে পাওয়া অক্ষরগুলো দিয়েই আমরা গেয়ে যাই সময়ের গান। এ দেশের মানুষ যুগপৎ শান্ত আর দ্রোহী, পারস্পরিক ধর্মীয় মেলবন্ধনে হয়ে উঠে মানবিক এবং উদার। পলিমাটির মানুষদের মন বাউলের মতো কবি সে-কথাও আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি মনে করিয়েছেন প্রাচীনকাল থেকে বড় বড় বাণিজ্য তরী ভাসিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন সওদাগররা। চাঁদ সওদাগরের কথা আমাদের অজানা নয়। তিনি মালকাব্যে বর্ণিত চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা মধুকরের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আমাদের। বাঙালি জাতির বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি কৈবর্ত বিদ্রোহের কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিদ্রোহের নেতা ছিলেন কৈবর্ত সম্প্রদায়ের বীর দিব্য বা দিব্বোক। আনুমানিক ১০৭০-১০৭৭ খ্রিস্টাব্দে মহিপালের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ করেন অনন্তসামন্ত চক্রের মিলিত শক্তি। ইতিহাসে এটি ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। কবি বাঙালির শিল্পসমৃদ্ধ ঐতিহ্য বোঝাতে পালযুগের চিত্রকলার কথা উল্লেখ করেছেন গর্বের সঙ্গে। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে গোপালের রাজ্য শাসনের মধ্য দিয়ে বঙ্গে পালযুগের সূচনা হয়। পালদের রাজত্ব চার শ বছর টিকে ছিল। এ সময় শিল্প-সাহিত্যের অসামান্য বিকাশ হয়েছিল।

‘এসেছি বাঙালি জোড় বাংলার মন্দির বেদি থেকে।/এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে/এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।/আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারো ভূঁইয়ার থেকে/আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।/আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরিয়ত থেকে/আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।’

বাংলার মুসলিম ঐতিহ্য সুমহান। এ ঐতিহ্যের পরিচয়স্বরূপ কবি সোনা মসজিদের কথা বলেছেন। অপরূপ শিল্প সৌন্দর্যের আধার এই স্থাপত্যকর্ম হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) নির্মিত হয়। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্রভূমে অবস্থিত ছোট সোনা মসজিদ। একই সঙ্গে কবি আউল-বাউল, মাটির দেউলের কথাও বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে স্মরণ করেছেন। কবি স্মরণ করেছেন, বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণাকারী বারো ভূঁইয়াদের কথা। বাংলায় পাঠান করানী বংশের রাজত্ব দুর্বল হয়ে পড়লে স্বাধীন জমিদারদের উত্থান ঘটে। ১৫৭৫ সালে মোগল সম্রাট বাংলা জয় করার পর এই জমিদাররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করেন। এরাই ইতিহাসে বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত। লোককাহিনির প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে কবি ‘কমলার দীঘি’ ও মহুয়ার পালার কথা উল্লেখ করেছেন। এ দুটিই মৈমনসিংহ গীতিকার বিখ্যাত পালা।

ইংরেজের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম দীর্ঘদিনের। আমাদের বীররা জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন। সেই বীরদের একজন তিতুমীর। কবি তিতুমীর ও হাজী শরীয়তউল্লাহর বীরত্বের কথা স্মরণ করেছেন। চব্বিশ পরগনার হায়দরপুর গ্রামে ১৭৮২ সালে মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হন। হাজী শরীয়তউল্লাহ বিদেশি শাসন-শোষণ, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্ত করার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি (১৭৮১-১৮৪০ খ্রি.) মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার সামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন ধর্মকে আশ্রয় করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় কীর্তি। এ দেশের স্বাধীনতাণ্ডসংগ্রামে তাদের গান ও কবিতা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনীশক্তি। ‘এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে/এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।/এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে/এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।/আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে/আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।’

মাস্টারদা সূর্যসেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সশস্ত্র যোদ্ধা। মাস্টারদা সূর্যসেন আর ক্ষুদিরামকে কবি বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন কবি। ক্ষুদিরাম বসু (১৮৮৯-১৯০৮ খ্রি.) মেদিনীপুর জেলার মৌবনি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এই মহান বিপ্লবীকে হত্যা করে ইংরেজরা। মাস্টারদা সূর্যসেন (১৮৯৩-১৯৩৪ খ্রি.) চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ইংরেজদের অস্ত্রাগার লুট করে তিনি তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং চট্টগ্রামের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। এই দুই যোদ্ধার মতো জয়নুল আবেদিন আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজও আমাদের ঐতিহ্য। কবি স্মরণ করেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপুল শিল্পকর্মের কথা। জয়নুল আবেদিন (১৯১৪- ১৯৭৬ খ্রি.) কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন। চিত্রশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক অবনঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১ খ্রি.) কলকাতার জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কবি বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে স্মরণ করেছেন। কারণ বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনার পথ ধরেই সূচিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলন। বাংলা ও বাঙালির অবিসংবাদী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিস্ময়কর প্রতিভাদীপ্ত নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ অতিক্রম করেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বাঙালির ঐক্য ও সংহতির প্রতীক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণ বাঙালির প্রেরণার উৎস। বাঙালির ইতিহাস, নিজস্ব সংস্কৃতি ও বিপ্লবী মানুষের স্মৃতিচারণ করেছেন কবি। তাদের পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করতে পেরে কবি নিজেও গর্বিত। বাঙালি হতে পেরে কবির অপরিসীম আনন্দ! আমরাও কবির মতো আন্দোলিত হই।

বাঙালির প্রেরণার উৎস নানাবিধ এবং বিচিত্র। আমাদের সোনার দেশে গর্ব করার ইতিহাস অফুরান। এখানে বীরত্বের গল্প শুনতে শুনতে শিশু তার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। তাইতো কবি বলেছেন- ‘এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে/শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে?/তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই- /‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’/একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবই- /সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবই।’

একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলার ছবি এঁকেছেন কবি সৈয়দ হক। যেখানে মসজিদণ্ডমন্দির পাশাপাশি। অথচ তাতে কোনো হানাহানি নেই। এক নিগূঢ় ভালোবাসা কিংবা ভ্রাতৃত্বের নিরুপম গল্প শোনাচ্ছেন আমাদের। সবশেষে কবি সাম্যের আহ্বান জানিয়েছেন। সব বিভেদ ভুলে গিয়ে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ রেখে পথচলার তীব্র আকুতি জানিয়েছেন। কবি বাঙালির কাছে প্রত্যাশা করেন, বাঙালির দীর্ঘদিনের ইতিহাস-ঐতিহ্য কোনোভাবেই যেন ক্ষুণœ না হয়। বাঙালি ঐক্যের প্রতীক হয়েই থাকুক।

বাঙালি তার পরিচয়ে গর্বিত। সাহসিকতায় অনন্য। যারা উদ্ধত কোনো খড়্গকেও ভয় পায় না। কারণ তাদের ইতিহাস লড়াইয়ের। বাঙালি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। এক হাতে অস্ত্র ধরতে জানে, অন্য হাতে শস্য ফলাতেও জানে। সুতরাং বাঙালি কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। বাঙালির ইতিহাসে আপসের কোনো জায়গা নেই। বাঙালি হাসতে হাসতে বাঁশি বাজিয়েছে আবার হাসতে হাসতে গলায় ফাঁসও পড়েছে। তাইতো কবি বলেন- ‘পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের- /কখনোই ভয় করি নাকো আমি উদ্ধত কোনো খড়গের।/শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;/অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;/একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;/আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।’

বাঙালি কৃতজ্ঞ জাতি। তারা বীরত্বের ইতিহাস, আত্মত্যাগকে স্মরণ করে বারবার শ্রদ্ধার সঙ্গে। ভুলতে পারে না। তাই কবি বলেন- ‘সেই ইতিহাস ভুলে যাব আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;/তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি- /চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।’

সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি বাঙালির সামগ্রিক পরিচয়ের একটি বিশ্বস্ত দলিল। কবি যেমন বাঙালি হিসেবে গর্বিত, তেমনই গর্বিত বাংলার আপামর বাঙালি। কারণ বাঙালির আছে শাশ্বত চিরজীবী ইতিহাস।

বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবনকে বর্ণিল আর সৃষ্টিমুখর করেছিলেন কবি। সৃষ্টির উন্মাদনা নিয়েই ছিলেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। বাংলা ভাষার অজেয় প্রতিনিধি তিনি। সৈয়দ শামসুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার নিজের জন্য লিখি। আমার নিজের ভেতরে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, যা কিছু দেখছি, যা কিছু শুনছি, যা কিছু জানছি, যা কিছু পড়ছি, যা কিছু ভাবছি, সেগুলো আমাকে বলতে হবে। না বলতে পারলে আমার ভেতরটা অসুস্থ হয়ে পড়বে। কাজেই প্রথমত লিখি আমার নিজে চিকিৎসিত হবার জন্য।’ ‘নিজেকে চিকিৎসিত’ করতে লিখেছেন কবি। কিন্তু শুধু নিজেরই চিকিৎসা করেননি। তার কলমে চিকিৎসা পেয়েছে বাংলা ভাষার বিপুল পাঠক।

তিনি বহুপ্রজ। বিরামহীন লিখেছেন অজস্র। পেশাদার ছিলেন। এত যে লিখেছেন কিন্তু তার কোনো লেখাই হালকা হয়নি। একটি লেখা আরেকটিকে অতিক্রম করে গেছে। পাঠককে হতাশ করেননি। লিখেছেন সমান নিষ্ঠা আন্তরিকতা আর সততা দিয়ে। বাঙালির আইডেনটিটি তুলে ধরেছেন উচ্চকিত ভাষায়, অসীম আনন্দে। উত্তর-প্রজন্মকে দিয়েছেন নির্দেশনা কবিতার দেহজুড়ে।

এ কবিতার ভাষা সহজ-সরল, ঝরঝরে। শব্দমালা আমাদের পরিচিত। কবিতার গাঁথুনি আর ইতিহাসের একীকরণে কবি আমাদের দিয়ে যান পরিচয়। শুধু কবির শারীরিক প্রস্থান হয়েছে।

দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে অমোঘ মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন। কিন্তু তিনি আছেন তার লেখায়। যুগে যুগে বাঙালির ফিরে যেতে হবে তার কবিতার কাছে। ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি নিজ গুণে অনন্য। চির নতুন অর্থবহ এবং তরতাজা। এটি বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক কবিতা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close