আহমদ বশীর

  ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

অন্তর্বর্তী সময়

তারপর?

হ, সেই দিনই।

হ্যালো সালমা।

জি স্যার।

ওই মাতারি কিছু বললো? মুখ খুলছে? ছোট সাহেব! ছোট সাহেব সম্পর্কে কিছু বলেছে? আজকে তো আমি আসতে পারলাম না। আপনি ভালো করে ইন্টারভিউ করেন। কিন্তু মনে রাইখেন, আমাদের হাতে টাইম খুব শর্ট। খুবই কম। ছোট সাহেব সম্পর্কে ও যা বলেছে তাই হবে আমাদের রিপোর্ট। ছোট সাহেবকে আমরা ধরে ফেলেছি আর সময় দিতে পারবো না।

স্যার এখনো ছোট সাহেবের পার্ট আসেনি।

আহ্ কী সব কেচ্ছা শুরু করেছে মেয়েটা! আচ্ছা যেভাবেই হোক, আগান। ওভার।

ওহ। হ্যাঁ খাদিজা, তোমার কথা শুরু করো।

আপা, মোবাইলে স্যারে ছোট সাহেবের কথা কী কইলো? সময় নাই?

আহ, সেই প্রসঙ্গ পরে আসছি, তুমি বলো হাট থেকে তুমি আর তোমার মা এসে কী দেখলে!

আমরা আইস্যা দেখি আমাগো ঘরের সামনে বাপে বইসা রইছে। আর তারে তালের পাংখা দিয়া বাতাস করতেছে দাড়িওয়ালা এক মৌলবী সাব। বাবায় একটা গেঞ্জি পিন্দা রইছে আর ব্যাডায় একটা পাঞ্জাবি। মায়ে তাগো দেইখ্যা মাথায় কাপড় দিয়া ঘরের ভেতরে দৌড় দিলো, আমিও তার পিছপিছ দৌড়াইলাম। পেছন থেইক্যা শুধু শুনলাম নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ। কেডায় কইলো? দুইজনেই হইতে পারে। আমরা বাড়ির বাহির থেক্যা আইছি এইটা আসলে ভালো হয় নাই। পর্দার কথা আমরা পড়ছি, মক্তবে ভালো কইরা কইছে হুজুররা কিন্তু আমরা তাগো হুকুমমতো চলতে পারি নাই। হেই লাইগ্যা আইজ পর্যন্ত আমাগো বালা হইবো না। আমি গুনাহ করছি। মাইয়া হইয়া বেপর্দা ঘুরছি, আইজ বুঝতে পারি কী গুনাহর আছর আমাগো ওপর হইছে।

আচ্ছা বুঝলাম, তোমাদের গুনাহ হইছে। এখন প্রায়শ্চিত্ত করো। তা বলো নতুন মৌলবী লোকটা কে?

ঘরের ভেতরে বাপে আইলো। আইসা মায়ের কয় হামেলার মা, তুমি ভালো কইরা আইজ একটু রান্না করো তো একটা মোরগ পাকাও, লগে আলু দিও কয়েকখান আর কুইচ্চা মাছের চচ্চড়ি।

বাহ। আইটেমগুলো তো সুন্দর। কুইচ্চা মাছের চচ্চড়ি।

তো, মায়েরে সেদিন বাপে একটুও পিটায় নাই। রাতে খানাপিনার শ্যাষে হেই মৌলবী সাবরে আমাগো বাড়িতে শুইতে দেওয়া হইল। আমি আর আমার মা পাশের বাড়িতে গিয়া শুইয়া রইলাম।

তোমাদের এই নতুন অতিথি কে? তোমার বাবার আত্মীয়?

না, আমরা তারে চিনি নাই। বাবায়ও কিছু কয় নাই। খালি কইছে উনি খুব কামেল লোক। সমাজের সবে নাকি তারে মান্যগণ্য করে। তার কথা শোনে। দুনিয়াবি পাপ থেইক্যা বাঁচা যায়। তার লম্বা জুব্বায় চারটা পকেট ছিলো। সেদিন সকালে খুব ঝলমইল্যা রোদ উঠছিলো। আমাগো বাড়িতে কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজার আপা আইলেন। মায়ে কইলো, প্রদর্শনী খামারে যাইতে হইবো, মা আমারে পাঠাইলো। আমি সারা দিন প্রদর্শনী খামারে কথাবার্তা কইলাম। কেমনে আমরা উচ্চ ফলনশীল বেগুন লাগাইছি, কেমনে আমাদের সেই বেগুন বাজারে বিক্রি করছি; সেই বিবরণ শুইন্যা সবাই খুব হাততালি দিলো। কৃষি বিভাগের অফিসার কইলেন বাংলাদেশের নারীদের কতো উন্নতি হইছে, কৃষিক্ষেত্রে তারা আগাইয়া আইছে। নারীদের স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিতে হবে। তারা দেশের কর্মক্ষেত্রে নানারকম সুযোগ পাইবো। তারপর তিনি বললেন, যে পরের সপ্তাহে জেলার অনুষ্ঠানেও আমারে যাইতে হইবো।

তার মানে তোমাকে কৃষি বিভাগ খুব অ্যাপ্রিসিয়েট করছিল? প্রশংসা করেছিল? বাহ... তারপর?

তারপর আপা- কী কমু, আমি বাড়িত আইসা দেখি, আমার ছোট ভাই ঘরের সামনে বিরিং খেলতাছে। আমি তারে জিগাইলাম মা কই? সে খেলতে খেলতে কইলো ভিতরে। ভিতরে ঢুইকা দেখি, মা মাথা নিচু কইরা কুলার ওপর চাল বাছতাছে। আমি কইলাম, মা কৃষি আপা কইছে- প্রদর্শনী খামারের লাইগ্যা আমারে জেলা সদরে যাইতে হইবো। আমার কথা শুইনাও মা দেখি কোন কথা কয় না। শেষে দেখি মা কাঁদতেছে। আমি জিগাই- মা কী হইলো? মায়ে কয়, হামেলা তরে এখনই পলাইতে হইবো, তুই এহনি কাপড়ের ব্যাগ লইয়া তোর খালার বাসায় পলায়া যাবি। তোর খালা তরে লুকায়া রাখবো, অহনই পালা। আমি কিছুই বুঝি না। কইলাম, ক্যা? আমি কেন পালামু? মা কইলো, তোর বাপে ওই নতুন অতিথির লগে তোরে বিয়া দিবো। আইজকা রাইতেই তোর বিয়া।

সেই রাতেই?

হ, সেই রাতেই আমারে বিয়া দিবো। বাপে সব ঠিকঠাক করছে। বাবায় হেই বেডারে লইয়া গেছে বাজারে শাড়ি-ব্লাউজ কিনবো। কিছু মোরগ-মুরগি কিনবো। নাকফুল কিনবো- আর আগরবাতি। মায়ে কইলো, হামেলা আর সময় নাই- তুই অক্ষণই চইলা যা। যা থাকে কপালে হইবো, তুই অখনই পালা।

তারপর তুমি পালাইতে পারলা?

আমি বইয়া বইয়া চিন্তা করলাম- আমি পলাইলে আমার মারে মাইরাই ফালাইবো। আর আমি কই পালামু। বাপে আমারে খুইজাই আনবো। আমি চুপচাপ বইয়া রইছি দেইখ্যা মায়ে খুব চ্যাতা চেতলো। কইলো হারামজাদী পলাইবি না? এহ্যানো বইস্যা ওই অচেনা-অজানা বুইড়া ব্যাডার লগে বিয়া বইবি? তর জীবনে কী হইবো! হায় হায় আমার সুন্দর পাখিটারে ওরা মাইরা ফালাইবো। হায় হায়। মায়ের কান্দন শুনি আর চুপ কইরা ভাবি। একটু আগে আমারে কত সম্মান দিলো কৃষি আপা। ব্লক সুপারভাইজার আমারে ডিস্ট্রিকে পাঠাইবার জন্য মত দিলো। আর অহন আমি অচিনা-অজানা এক ব্যাডার লগে ঘর বাইন্দ্যা চইলা যামু।

চার.

বিস্ফোরণের পর ঘরের ভিতর লাশগুলো দলাদলা হয়ে গেছে। কিনতু খাদিজা তুমি আর তোমার বাচ্চা বেঁচে গেছো। আর তোমাদের মধ্য থেকে আরেকজন নিখোঁজ। তিনি হলেন ছোট সাহেব। ঘটনাটা কীভাবে হলো?

হ্যালো স্যার, জি স্যার, জি স্যার, আমি ওর ইন্টারভিউ নিচ্ছি। জি স্যার- বেশ কথা বলছে। ওর জীবনের ইতিহাস না জানলে তো ক্রিমিনালদের ক্রাইমের সিনক্রোনাইজেশন করা যাবে না। না কেচ্ছাকাহিনি না, মনে হচ্ছে সত্যি কথাই বলছে। জি স্যার ও হ্যাঁ, ছোট সাহেবের প্রশ্ন করেছি স্যার। জি স্যার ওই বিষয়টাই এখনো অবসকিউর। জি স্যার আমি কোশ্চেন করছি। আপনি আসেন স্যার, দশ মিনিট! ঠিক আছে স্যার।

কেডা ফোন করছিলো আপা? বড় স্যার?

হ্যাঁ, বড় স্যার। আচ্ছা খাদিজা, তুমি এখানে তোমার কাহিনি একটু স্টপ করো, আমাকে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেও।

কয়েন।

প্রথম হলো, তোমার ওই ছোট সাহেব সম্পর্কে সত্যি বলছো কি-না আরেকবার বলো, দেখো আমি একজন মহিলা, তুমিও একজন মেয়ে মানুষ। তুমি আর যাই হোক আমার কাছে মিথ্যা বলো না।

আপা, আমি সত্যি কথাই কমু আমার বাচ্চাটারে আমার কাছে দিয়া যান, বাচ্চাটা কান্দে- আমার খুব বুকব্যথা হয়।

আহ্হা, দুধ খাওয়ানোর সময় তো বাচ্চা তোমার কাছেই থাকে। এখানে ইনভেস্টিগেশন সেল, এখানে বাচ্চা দেওয়া যাবে না। আচ্ছা আবার বলো, এই যে চারটা ছবি দিলাম- এর মধ্যে কোনটা ছোট সাহেবের ছবি তুমি ঠিক করে বলো।

আপা কাইলকা না আমি কইয়া দিছি, আবার ক্যান।

এটা একটা রুটিন টেস্ট। তুমি সঠিক বলছো কি না এখন তাই ধরা পড়ে যাবে।

ও মা, কী কন! দেহি দেহি, আমি কইতাছি। হ-হ-এই চাইরটা ছবির কুনটাই ছোট সাহেবের না।

ক্যামনে বুঝলা?

আপা, ছোট সাহেবের মুখে ডাইনে দিকে একটা তিল ছিল।

খাদিজা! তুমি কী বলছো? ছোট সাহেবের মুখের তিল তুমি মনে রাখছো? তোমার সঙ্গে না ছোট সাহেবের দেখাই হতো না। তাহলে কীভাবে এত কাছে থেকে তারে দেখছো?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close