মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
বিষাদের দিনলিপি

মাঝেমধ্যে জীবনের প্রতি প্রচণ্ড রকম আক্রোশ জন্মে। কারণ খুঁজতে গিয়ে যেন কিছুই খুঁজে পাই না। আলোছায়ার মতো দুম করে মনে আসে, ফের হারিয়ে যায়। নিঃসঙ্গ দুপুরে মনের ওপর পীড়াটা আরো বাড়ে। খানিক পরপর চোখ বন্ধ করে নিজেকে হাতড়ে ফিরি। স্মৃতিরা আনাগোনা বাড়িয়ে দেয়। হৃদযন্ত্রে কম্পন বাড়ে। কিন্তু খুঁজে পাই না কিছু। সন্ধ্যার আঁধার মেখে চলতে গিয়ে মনে হয়, পৃথিবীটা কত গতিময়! শুধু একাকী সন্ধ্যাগুলো স্থবির হয়ে আছে।
খুব করে আগের মতো ইচ্ছে হয় না- চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে, অলস বিকেলে আকাশ দেখতে কিংবা জীর্ণ প্রেমের পুরোনো ছবি আঁকতে। অথচ চোখের সামনেই বেড়ে উঠছে ধানখেতগুলো, কচি লাউ ডগাটা। বড় হয়ে যাচ্ছে আমার লাগানো আমগাছ। প্রভাতের হিম হিম হাওয়া, স্নিগ্ধ মায়ার পৃথিবী- এসব পর্যন্ত আজ আর টানে না। বয়স বেড়ে যাচ্ছে মনের। প্রেম ফুরিয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছেও ডুবে যাচ্ছে চোখের জলে। আজকের পরে কালকের কথা ভাবতে ধাঁধা লাগে। হৃদয়ে হাহাকার জাগে। চোখের সামনে প্রিয়-অপ্রিয়দের কাঁচা চুলে পাক ধরেছে। চামড়া ঝুলে পড়েছে। মহাযাত্রার আয়োজন হচ্ছে। অথচ নির্বিকার মনে দেখে যাওয়া ছাড়া আমার কিছুই করার নেই।
শরতের বৃষ্টিভেজা সকালের নেশায় মন উতলা হয়। ডুবে যেতে ইচ্ছে করে প্রাণপণে। স্যাঁতসেঁতে মনে শীতল হাওয়ায় যেন স্বপ্নগুলো জমাট বেঁধে একাকার। ভাঙা চালার ফাঁকে দু-চার ফোঁটা জলের ধারা ছুঁয়ে যায় দেহমন। টিনের চালার অবিরাম মৃদু সংগীত জাগিয়ে তোলে প্রাণ। রাস্তার পাশে ভিজে চুপসে যাওয়া অচেনা বুনোফুল, ক্লান্ত আকাশের গর্জন কিংবা সিক্ত দেহে ছুটে চলা বাহারি বাহন- সব যেন এক অন্য রূপের পসরা সাজিয়ে। শহর থেকে দূরে জলাশয় দাপিয়ে বেড়ানো অবাধ্য গ্রাম্য বালিকার মতো আমারও ঢেউ তুলতে ইচ্ছে হয় জীবনের জলাভূমিতে। মন শ্রীহীন মোড়কের আড়াল ছেড়ে ছুটতে চায় রঙিন দেশে। ভাঙা স্বরের বেসুরা গান বড় টানে। প্রাণ ভিজতে চায় তাতে।
ষোড়শীর কপালের গোল টিপের মতো রুপালি চাঁদটা ক্ষয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। বদলে যাবে শরতের আকাশ। শুধু আমি ঝিম মেরে আছি জীর্ণ অতীতে। রাঙা উষায় হিম বাতাস ভিড় বাড়াচ্ছে দুয়ারে, আমায় আলিঙ্গন করবে বলে। আর আমি এড়িয়ে যাই প্রাতর্ভ্রমণে ইচ্ছে নেই বলে। অবিরত সৌম্যধারায় বয়ে চলা জলের মতো প্রাণে বেজে চলছে জীবনস্রোতের বাণী। একসময় বড় সাধ ছিল নীলজলে সূর্য ডোবা দেখার, জোছনা জোয়ারে খোলা চুলে কাউকে দেখার, পাহাড়ের গা চুঁইয়ে পড়া জলে স্নান করার; আজ আর ইচ্ছে করে না।
ডাহুকের ডাক শুনি না বহুদিন। শেয়ালও ডাকে না। কুকুরগুলো কেমন বিষণœ সুরে কেঁদে যায়। জমাট বাঁধা আঁধারের বুকে আলো জ্বালানো জোনাকির মতো আশাগুলো ছুটে যাচ্ছে দূর থেকে বহুদূরে, সীমানার বাইরে। জীবনের শীতল আহ্বানে ভয় হয়। উষ্ণ ছোঁয়া পেতে ইচ্ছে জাগে। বহু পেছনের আবছা আমি শুধু বিস্ময় চোখে দেখি, হাসি আর অবাক হই। এখানে সবই মরে যাচ্ছে দিন দিন, শুধু আমিই বেঁচে আছি, মরার মতো। উদ্ভট সম্ভোগে মেতেছে সবাই; অকারণে ছুটে চলছে অজানায়, বিনয় করে আমায় ছুড়ে ফেলে জঞ্জালের খাদে। হৃদয়ের মূল্য এখানে শূন্য। ব্যস্ত পৃথিবী চোখ বুজে রাখে অদম্য অবহেলায়। চোখের জলের ধারা আর হৃদয়কে স্পর্শ করে না। ভেজায় না অবিরত। আঁধারের দেয়ালঘেঁষে আমিও এখন দাঁড়াই না উঠোনের কোণে। যেখানে কাল সন্ধ্যাতেই বৃষ্টি পড়েছে বেলপাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
আজ বাদে কাল, বদলে যাচ্ছে সব! ধূসর স্মৃতির পুঞ্জ ভারী করে চলেছে মনের পর্দা। আজ সন্ধ্যা জুড়ে যে আবেদনের মাত্রা মূল্যহীন, এক দিন আমার কাছে এর বড় মূল্য ছিল। সেসব সন্ধ্যা আজও লেপ্টে আছে চোখের পাতায়। উড়ে চলা বাদুড়ের পথ ধরে জেগে আছে মায়া-মৃত্তিকার ভুবনে। সাধ জাগে, যদি সেসব স্মৃতির শহরে ঘুরতে যেতে পারতাম! ধুলোর পরতে জমা জীবনের রূপ, রং আবারও মাখতে পারতাম! তবু আমি বেঁচে আছি, মরার মতো, এতটুকু আশা নিয়ে; যদি এক দিন বাঁচতে শিখে যাই।
মাঝেমধ্যে আকাশটা দেখে বড্ড অবাক হই। এত সুন্দর সাজ! নান্দনিক রেখা! বড় ভালো লাগার। গোধূলিবেলার লালচে কিংবা নীলাভ আসমানটা দেখি বারবার। অবসরে আকাশটাই যে আমার বড় সঙ্গী। নিঃসঙ্গ মাঠে সবুজাভ দিনমান খুঁজি। কখনো বা আকাশটা পেয়েই এক রকম আত্মতৃপ্তিতে হারাই। খুব বেশি কিছু তো চাইনি ছোট্ট এ জীবনে। এই একটা আকাশই তো চেয়েছি বরাবরই। যা পরম সুখের। যেখানে নিঃশ্বাস ফেলে ক্লান্তিরা ঘুমোয় বড় স্বস্তির ঘুম।
দুর্বাঘাসে সরোবর প্রকৃতিই তো আমার প্রাণ। সেই সঙ্গে নির্জন কোনো ঘর, খোলা জানালা, একটা সকাল, এক কাপ চা, আর এক টুকরো রোদ্দুর- এটুকুই তো চেয়েছি জীবনের কাছে। এর চেয়ে বেশি কিছু তো নয়! কিন্তু জীবন আমায় কড়ায় গণ্ডায় তার অনেকটা পাওনা মিটিয়েছে। জীবনের কাছে তাই আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। পরম মমতায় সে আমায় কখনো ভালোবাসার পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেয়নি। ঘোর অবিশ্বাসে আমি তার হাত ছেড়ে দিলেও সে আমায় আগলে রেখেছে। ভীষণ ভয়ের রাতে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত¡নার বাক্য শুনিয়েছে। ক্লান্তিতে ন্যুয়ে পড়া দেহে উষ্ণ কাঁথাটি টেনে দিয়েছে। প্রতিটা রাতজাগা রাতের শেষে একরাশ স্বপ্ন দেখিয়েছে। যে সকালগুলোয় নিজেকে তেমন চিনতে পারিনি। কোথাও গভীর হতে গভীরে প্রিয়তম মানুষটির মুখ উপহার দিয়েছে। বুঝিয়েছে, ‘আলো তার পদচিহ্ন আকাশে না রেখে চলে যেতে জানে। চিরদিন থাকে অমলিন।’ তাই তো করজোড়ে জাপটে থাকি জীবনের সঙ্গে। যেন কেটে যায় বেলা-অবেলায় জীবনকাহিনি।
ইচ্ছেঘুড়ি তবু ডানা মেলে পৃথিবীর রঙ্গিলা পথে। ধুলোয় ধূসরিত সাদাকালো জীবন কাহনে সাজে। হারায় বা কোনো এক ঝুম বৃষ্টিধারায়। পেতে চায় মুঠি মুঠি বরফে হিম হয়ে যাওয়া অধরা হাতের রেখা। শুকোতে চায় খোঁপায় জড়িয়ে থাকা ভেজা ভেজা পুষ্পপাতার মায়াবী গন্ধ। এমনকি কাকভেজা হওয়ার ইচ্ছে বহুদিনের। বৃষ্টিবিলাস হোক হুড খোলা রিকশায়। ভালোবাসায় উপচে যাক জীবনের এই অলিগলির শহর। ভেসে যাক রাজপথ, ঘরদোর। এমনকি জীবনের সবটা। শুদ্ধতায়, হৃদ্যতায় সাজুক জীবনের প্রতিটি রুপালি ভোর। এর চেয়ে খুব বেশি কিছু তো চায় না জীবন। শুধুই তো চায়- কেউ একজন আলগোছে সুখের কথা বলুক। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকুক অপলক। বুকে নাক ঘষে বলেই ফেলুক শেষমেশ, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভীষণ রকম ভালোবাসি।’
"