সৈয়দ নূরুল আলম

  ০৫ আগস্ট, ২০২২

গল্প

বয়ফ্রেন্ড

রাত দুটো। টিভি অন করা। মাসুদ সাহেব ৫৬ ইঞ্চি টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে আছেন কিন্তু কিছু দেখছেন না। বয়স তার উনষাট বছর ছয় মাস। ছয় মাস পিআরএল চলছে। আর ছয় মাস পরে পুরোপুরি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেবেন। মাসুদের স্বাস্থ্য ভালো। লম্বা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। শরীরের চামড়া এখনো টান টান। একসময় ফুটবল খেলতেন। সকালবেলা নিয়মিত ৪৫ মিনিট হাঁটেন। চশমা পরেন। চশমা এখন সোফার সামনে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা।

‘মেয়েটা বলল, বয়ফ্রেন্ডের জন্মদিনে যাচ্ছি, আর তুমি শুনে কিছু বললে না? নীরব সম্মতি জানালে?’ এত রাত হলো মেয়েটা বাসায় ফেরল না। ও কি বয়ফ্রেন্ডের বাসায় রাতে থেকে যাবে? ভাবতে পারছো, বিষয়টা?

মাসুদ সাহেব মুখে ঝাঁজ তুলে স্ত্রী মেহেরুন্নেছাকে কথাটা বলেন। মেহেরুন্নেছা কোনো উত্তর দেন না। স্বামীর জন্য চা করতে গিয়েছিলেন, রান্নাঘর থেকে ব্যস্ত হয়ে ছুটে এসে চায়ের কাপটা নিঃশব্দে সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে একটু দূরে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। মেহেরুন্নেছা নীরব থাকায় মাসুদের রাগ আরো বেড়ে যায়। চায়ে এক চুমুক দিয়ে কাপ শব্দ করে দূরে সরিয়ে রাখেন। সন্ধে থেকে মন তিতা হয়ে আছে, সে কারণে বোধ হয় চা-টাও বিস্বাদ লাগছে। মাসুদ সাহেব এবার গলায় কাঁসার ঘণ্টার মতো আওয়াজ করে বলেন, ‘বয়ফ্রেন্ডের নাম কী, কোথায় থাকে? এসব জানতে চাইবে না? আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে মেয়েটার মাথা নষ্ট করে দিয়েছো। তা না-হলে বয়ফ্রেন্ডের বাসায় রাত কাটানোর সাহস পায় কীভাবে?’

মেহেরুন্নেছা দুপা এগিয়ে এসে গলার স্বর অনেকটা খাদে নামিয়ে বলেন, আমাদের মেয়েকি ওরকম। হয়তো কোনো অসুবিধায় পড়েছে। আর ফোনে চার্জ নেই, সেজন্য কিছু জানাতে পারছে না। তুমি কোনো চিন্তা করো না। চলো শোবে।’

‘এ অবস্থায় শোবো! ঘুম আসবে?’ তোমার আসতে পারে, আমার আসবে না। তুমি গিয়ে ঘুমাও।’

মেহেরুন্নেছা বড় অসহায় বোধ করেন। স্বামীর কথায় কি বলবে বুঝতে পারেন না। শাড়ির আঁচলে হাত মোছেন, জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে গ্লাসটা একটু এগিয়ে স্বামীর সামনে রাখেন তারপর কাতর মুখে বলেন, চা ভালো হয়নি, আবার করে আনব?

মাসুদ সাহেব কিছু না বলে চায়ের কাপটা টেনে নেন। তারপর ভাবেন, ঠিকই তো, রিমার চালচলনে তো কখনো মনে হয়নি, ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। তা ছাড়া ও কখনো এমন কোনো কাজ করেনি, যাতে সন্দেহ করা যায়। আর রাতে বয়ফ্রেন্ডের বাসায় থেকে যাবে, তাণ্ডতো ভাবা যায় না। এখন কি পুলিশে খবর দেওয়া উচিত? মাসুদ নিজেকে প্রশ্ন করেন।

‘ওর বান্ধবী যাদের চিনি, তাদের সবার কাছে তো ফোন করলাম। কেউ কিছু বলতে পারল না।’ মেহেরুন্নেছা টেবিল থেকে খালি কাপটা তুলে নিতে নিতে বলেন।

রিমা বরাবর শান্তশিষ্ট। পড়ালেখাতেও ভালো। একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ট্রিপল ই নিয়ে পড়ছে। এবার লাস্ট সেমিস্টার। ওর কোনো বাড়তি চাওয়া-পাওয়া নেই। বাবা-মার একমাত্র সন্তান হলে অনেক ক্ষেত্রে যে উড়নচণ্ডী ভাব হয়, সেসব রিমার মধ্যে নেই। বরং অনেকটা মানবিক। বাবা-মার ভালো-মন্দ খোঁজখবর রাখে। আত্মীয়স্বজন বা ফ্ল্যাটের অন্য সবার সঙ্গে নরম ভাব। ভার্সিটির বন্ধুদের মাঝেমধ্যে ফোন করে, কিন্তু আজ পর্যন্তÍ কাউকে কখনো বাসায় আনেনি। সেই মেয়ে আজ এমন করবে। মাসুদণ্ডমেহেরুন্নেছা দুজনই বিস্মিত হয়েছেন।

মাসুদ সাহেব টিভি বন্ধ করে মেহেরুন্নেছার দিকে তাকিয়ে একটু চোরা হাসি হাসেন। সেটা মেহেরুন্নেছার চোখ এড়ায় না। বলেন, ‘তুমি হাসছো যে?’

‘যারা একটু শান্তশিষ্ট হয়, তাড়া সহজে বড় কিছু করে বসে। বাইরে ভালো মানুষ থাকলেও ভেতরে-ভেতরে বেশ বদ হয়, আমার নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে হাসি পেল। আমিও তো রিমার মতো শান্তশিষ্ট, গোবেচারা ছিলাম, সেটা তো তুমি জানো। তারপর দেখলে না, কী সাহসের একটা কাজ করলাম। আমাদের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার আগেই, বাড়িতে বলা নেই, কওয়া নেই দুম করে তোমাকে বিয়ে করে সরাসরি খালার বাসায়। বাড়ির কেউ ভাবতে পারেনি, আমার দ্বারা এ ধরনের একটা কাজ হতে পারে। কিন্তু হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল- নিশ্চয় তোমার মনে আছে।

মাসুদের কথা শুনে এবার মেহেরুন্নেছার মুখেও হাসি ফোটে। হাসতে হাসতে বলেন, মনে আবার নেই। তুমি যে ভেতরে-ভেতরে এতটা রোমান্টিক, এতটা পাগল, সেই প্রথম দিনের আগে সেটা বুঝতে পারিনি। খালা-খালু বাসায় নেই জেনে, তুমি কাজি অফিসে বিয়ে রেজিস্ট্রি করে সরাসরি খালুর বাসায় নিয়ে তুললে, তারপর সারা রাত সেকি পাগলামো। আমার ভয় করছিল। আমি তোমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছিলাম, আমরা তো কোনো পাপ করছি না। তখন তোমার কোনো উত্তর দেওয়ার সময় নেই, তুমি কালবৈশাখী হয়ে শরীর-মন তছনছ করতে ব্যস্ত। তারপর ঝর থেমে গেলে, তুমি বলেছিলে- পাপ কেন? তুমি তো এখন আমার বিয়ে করা আদুরে বউ।

কিছু সময় থেমে মেহেরুন্নেছা সেদিনের সেই আদুরে গলায় বলেন, ‘আচ্ছা, আমাদের রিমা যদি কাল সকালে একটা ছেলেকে নিয়ে এসে বলে, বাবা আমি ওকে বিয়ে করেছি। তুমি মেনে নেবে?’

কিছু না ভেবেই মাসুদ সাহেব বলেন, অবশ্যই মেনে নেব। আমি যেটা অত বছর আগে করতে পেরেছি, আজকের মেয়ে রিমা সেটা করলে দোষ কি। তবে-

‘তবে কী?’

‘আমি তো সৎ ছিলাম, আমার মধ্যে সততা ছিল। আজকালকার ছেলেদের মধ্যে সেই সততা আছে? সেখানেই আমার ভয়।’

এমন সময় ‘আশ্রয়’ বৃদ্ধ নিবাস থেকে ফোন আসে, রিমা দাদু ভাই আমার এখানে আছে। আজ রাতে এখানে থাকবে। আমার জন্মদিন, ও মনে রেখেছে। আসার সময় বড় একটা কেক নিয়ে এসেছে। কেক কাটার পর, কত বললাম, বাসায় যাও। বাবা-মা চিন্তা করবে। গেল না। বলল, ‘আজ একটা রাত তোমার কাছে থাকব।’

একটানা কথাগুলো বলে একানব্বই বছরের মানুষটা হাফায়, ঘনঘন শ্বাস নেয়। তারপর কিছু সময় থেমে আবার বলে, ‘পাগলি দাদু বলে কি, বৃদ্ধ নিবাসের এই ঘরটা বুকিং দিয়ে যাবে, আমার চলে যাওয়ার পরে, ওর বাবার এখানে আসতে হবে, তাই।’

এতটুকু বলে বৃদ্ধার চোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে আসে, ফোনটা রেখে দেয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close