মিরন মহিউদ্দীন

  ০৫ আগস্ট, ২০২২

বাইশ শ্রাবণ, কবি প্রণাম

যখন বৃষ্টি নামল

বাইশ বছর আগের একটা সন্ধে। মফস্বলের ছোট্ট একটা ক্লাবঘর। তার সামনে চৌকি পেতে বাঁধা হয়েছে স্টেজ। স্টেজের এক পাশে রবীন্দ্রনাথের ছবি। সেখানে মালা আর ধূপের ধোঁয়া পেরিয়ে চোখে পড়ে আর্ট পেপারে খুব সুন্দর হাতের লেখায় কয়েকটা লাইন- ‘পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে’/পথে চলা সেই তো তোমার পাওয়া’। কবির ছবির নিচে শুধু এইটুকু লেখার দায়িত্ব নিয়েছিল অরূপদা। অরূপদা তখন আর্ট কলেজের ছাত্র। ঢাকার একটা মেসে থাকে। সপ্তাহে শনি-রবি শুধু কাটায় এই আধো-অন্ধকার মফস্বলে, নিজের বাড়িতে। দুপুরের দিকে বেশ খানিকটা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। সন্ধেবেলা অনুষ্ঠান, বাইশে শ্রাবণ, কবি প্রণামের। হাওয়ায় তখনো লেগেছিল বৃষ্টি আর ভিজে থাকা ধুলোর গন্ধ। মঞ্চের সামনে গুটিকয় কাঠের চেয়ার আর নিচে বিছিয়ে দেওয়া শতরঞ্জি। অল্পস্বল্প করে লোকজনও আসতে শুরু করেছে। একটা বক্স রাখা ক্লাবঘরের কার্নিশে, আর লাইট পোস্টে চোঙা মাইক। তখনো সন্ধে তেমন নামেনি। কিন্তু আকাশের মুখ ভার দেখে আর কেউ কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। স্টেজে তুলে দেওয়া হয়েছিল রানী আপুকে।

রানী আপু বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী ছিল। নামটি যেমন, গায়ের রংটি তেমন, ঝাঁ-ফরসা; ঘটি হাতা লাল ব্লাউজ আর লাল পাড়ের সোনালি শাড়ি। লাগছিল বেশ। তায় আবার চিবুকের নিচে ছোট্ট তিল। গানের গলা ছিল অসাধারণ, তবু স্বভাবে লাজুক। তাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। যদিও মফস্বলের চায়ের দোকানে মজলিশি আড্ডায় কখনো শোনা যেত- রানী আপু আর অরূপদাকে জড়িয়ে নানা গল্প। কেউ কেউ নাকি দুজনকে একসঙ্গে দেখেছে রেললাইনের ঢালে সবুজ ঘাসের চত্বরে। কেউ বা সমর্থন করত, কেউ বিরোধিতা, কেউ আবার গল্পের গায়ে চড়িয়ে দিত কুৎসার কালি। সেই সেই গল্প কতটা সত্যি জানা হয়নি কারো। তবে একটা জিনিস লক্ষ করল সবাই, রানী আপু গান গাইলে অরূপদা কেমন যেন ঘোরে পড়ে যায়। দুজনে তাকিয়ে থাকে মুখোমুখি, কখনো-বা দুজনের চোখেই ছলকে ওঠে জল।

বাইশ বছর আগের বাইশে শ্রাবণের সন্ধেটায় সেই গল্পের গায়ে অবশ্য রং লেগেছিল অন্য। ক্লাবঘরের সমানের স্টেজে শুরুতেই গান গাইতে ওঠে রানী আপু। সামনের সারিতে বসে অরূপদা। রানী আপু গেয়ে ওঠে, ‘জানি, বন্ধু জানি- তোমার আছে তো হাতখানি’। তারপর হারমোনিয়ামের বি-ফ্ল্যাটে আলতো আঙুলের ছোঁয়ায় বেজে ওঠে সুর। রানী আপুর গলা থেকে উঠে আসে গান : ‘গোধূলি লগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’। অরূপদা স্থির, চোখে-মুখে কাঠিন্য।

রানী আপু চোখ বোজা, চোখ থেকে গড়িয়ে নামছে জল, ধরে আসছিল গলা- ‘চেয়েছিনু যবে মুখ তোল নাই আঁখি/আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি/আর কি কখনো এমন সন্ধ্যা হবে...।’

হঠাৎ কেন জানি না, গান থামিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে রানী আপু। তারপর আবার ধরে, ‘জনমের মতো হায়...’। সামনের চেয়ার থেকে উঠে চলে যায় অরূপদা। আর রানী আপুর গান হতে হতেই কেমন বিনা অনুমতিতে প্রবেশের মতো ঝেঁপে আসে বৃষ্টি। আচমকা ছন্দপাত বাইশে শ্রাবণের কবি প্রণামে। যে যার মতো ছুটতে থাকে বৃষ্টি থেকে পালিয়ে মাথা গোঁজার আশ্রয় খোঁজার জন্য। শুধু একাই ভিজতে থাকেন ফটো ফ্রেমে বন্দি রবীন্দ্রনাথ। ধুয়ে যায় আর্ট পেপারে লেখা কালো রঙের অক্ষরগুলো- ‘পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে...’।

সেদিনের বাইশে শ্রাবণের অনুষ্ঠান না হওয়ায় মন খারাপ নেমে আসে অনেকের মনেই। রানী আপুর ফুঁপিয়ে কান্না, অরূপদার উঠে যাওয়ার কারণ সবই যেন চাপা পড়ে যায় বিষণœতার আকস্মিক বৃষ্টিপাতে। ক্লাবঘর মিটিং বসে তারপর। প্রস্তাব আসে পরেরবার ত্রিপল দিয়ে অনুষ্ঠানস্থল ঘিরে দেওয়ার। খরচের হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে যায়। শুধু এর মধ্যে কেউ তেমনভাবে আর লক্ষ করে না, অরূপদা ঢাকা থেকে এখন আর প্রতি শনি-রবি বাড়িতে আসে না। আর কারা যেন মিষ্টি নিয়ে ঢোকে রানী আপুদের বাড়ি। তাদের সামনে বসে রানী আপু গায়, ‘মনে রবে কি না রবে আমারে...’। মাসখানেক পর কার্ড ছাপার দায়িত্ব যায় কাওমি প্রেসে...

দুই.

ঢাকায় উত্তরার সাততলায় ফ্ল্যাটে একটা পশ্চিমের ঘর তানিয়ার। তানিয়া গত জুনে আঠারোতে পড়ল। ওর কেমিস্টি অনার্সের ক্লাস সবে শুরু হয়েছে। নতুন ভার্সিটি জীবন, সামনে অনেক বড় ক্যারিয়ার। তানিয়ার পশ্চিমের ঘরে জানালা ঘেঁষে বুক শেল্ফ। কতগুলো ইংলিশ পেপার ব্যাক, জন্মদিনে সদ্য উপহার পাওয়া গোয়েন্দা গল্প সাজানো আছে সেখানে। উল্টোদিকের কম্পিউটারে স্ক্রিনসেভারে দোলে সাজেক ভিলায় তোলা মেঘ ছুঁইছুঁই নিজের ছবি। ঘরের দেয়ালে খুব হালকা আলো। তানিয়া তখন ঘুমোচ্ছিল। সময়টা, ওই রাত আড়াইটে মতো। হঠাৎ মেঘগর্জন, সেই সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। তানিয়ার মা জানে, মেঘ ডাকলে, বাজ পড়লে মেয়ে ভয় পায় খুব। হয়তো বাজ পড়ার শব্দেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তানিয়ার। বালিশে কোনো রকমে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে সে। দরজা লক করেনি, তাই মা-ও খুব সহজে আসতে পারেন মেয়ের ঘরে। জানালা দিয়ে আসা বৃষ্টির ছাটে ভিজে গিয়েছে তানিয়ার ঘরের মেঝে। তাই পশ্চিমের জানালা বন্ধ করে মেয়ের মাথার কাছে বসে পড়েন।

এক বছর আগে একটা জোর শক্ পেয়ে একটু ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল তানিয়া। তাই মা বোঝেন, এ সময় ভয় পেয়ে থাকা মেয়ের কাছে থাকাটা জরুরি। তানিয়া বোঝে তার কপালে আর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মা। বাইরে বাড়তে থাকে মেঘের গর্জন, তানিয়াও বালিশ থেকে মাথা তুলে রেখে দেয় মায়ের কোলে। মা বলতে থাকেন, ‘ঘুম হয়নি তোর? নাকি আচমকাই ঘুম ভেঙে গিয়েছে? আমার তো ঘুম ভাঙল মেঘ ডাকার শব্দে। একে বলে শ্রাবণের বৃষ্টি। যখন হবে...’। কথার মাঝখানে তানিয়া বলে ওঠে, ‘একটা গান শোনাও মা’। মেয়ের অবদারে প্রথম হতভম্ব, পরে হেসে ওঠেন মা, ‘কী! এখন! মাঝরাতে গান? তানিয়া আবদার করতেই থাকে। এক বছর আগে খুব জোর শক্ পেয়েছিল মেয়ে। তাই, যতটা পারেন, চেষ্টা করেন মেয়ের মন রেখে চলতে। খুব মৃদু স্বরে গেয়ে ওঠেন কোনো একটা গানে দু’কলি। তানিয়া মায়ের কোলে মাথা রেখেই বলে ওঠে, ‘মা, যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ ছাড়া ঝড় নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আর কোনো গান নেই?’ মা আরো অবাক। বলে ওঠেন, ‘কেন থাকবে না, কিন্তু এই মাঝরাতে হঠাৎ ঝড়, আবার রবীন্দ্রনাথ। ব্যাপার কী তোর?’

তানিয়া ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া এ সময়ের মেয়ে। বাংলা সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল চিরকাল, সিলেবাসের বাইরে খুব বেশি বাংলা বা রবীন্দ্রনাথ পড়া হয়ে ওঠেনি তার। একটু সাহেবি কায়দায় বড় হওয়া ছেলেমেয়েদেরই বন্ধু সে। ফলে, ব্লুজ রক মিউজিকের সঙ্গে যতটা পরিচিত ততটা ঠিক পরিচিত নয় এস্রাজ বা হারমোনিয়াম বেজে ওঠা, গেয়ে ওঠা রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে। শক্ পাওয়ার সময় থেকে মানে ওই বছরখানেক যাবৎ তার রবীন্দ্রনাথ চর্চা শুরু হয়েছে। ও যে হঠাৎ করে রাত আড়াইটের সময় ঝড় আর রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, মা এতটা আশা করেননি।

তাই তানিয়ার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে মা বলে ওঠেন, ‘এখন আর চর্চা নেই, সব ভুলে গিয়েছি। তেমনভাবে প্রোগ্রামই বা হয় কোথায়। আগে পাড়ায় পাড়ায়, কারো বাড়ির ছাদে মাদুর পেতে পালন হতোই পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণের কবি প্রণাশ অনুষ্ঠান। কেউ বা পাঁচজন বন্ধু-বান্ধবকে ডেকে ঘরের মধ্যেই পালন করতেন এই কৃত্য। জানিস, সেই দিনগুলোকে খুব মিস করি। ভীষণ ইনফর্মাল, কিন্তু কী অদ্ভুত আন্তরিকতা ছিল’।

তানিয়া শুনতে থাকে, জানতে চায় দিনগুলোর কথা। বাইরে কমতে তাকে বৃষ্টির বেগ। মা ফিরে যান বাইশ বছর আগের স্মৃতিচারণে। তানিয়া কেন ঝড় নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে চাইছিল, সে কথা জিজ্ঞেস না করে তিনি শুধু বলতে থাকেন বাইশ বছর আগের একটা শেষ না করা গানের গল্প, বাইশে শ্রাবণের অতর্কিত ঝেঁপে আসা বৃষ্টির গল্প। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাওয়া অক্ষরগুলোর গল্প; ‘পান্থ তুমি, পান্থসকা হে’। রানী আপু থেকে তানিয়ার মা হয়ে ওঠার মাঝখানে দীর্ঘ যে সময় বয়ে গিয়েছে, সেই সময়ের ঝড়-ঝাপটায় রোগ-জলে অনেক কিছুই ধুয়ে মুছে গেলেও একটা অপূর্ণ গানের লাইন ঝড় ফিকে হয়ে থেকে গিয়েছে মনের ভেতর।

তিন.

রানী আপু আর তানিয়া, দুজনের ঝড় হয়ে ওঠার বক্তব্য দুরকম। রানী আপু মফস্বলের মেয়ে, যৌথ পরিবারে কড়া শাসনে কেটেছিল তার মেয়েবেলা। অরূপদার সঙ্গে সম্পর্কটার কথা সামান্য জানাজানি হতেই হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটেছিল বাড়িতে। অরূপদা তখনো ছাত্র, মেসে থেকে নিজের খরচটুকু কোনোমতে চলত। বাড়ির অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। অথচ শিল্পী হয়ে ওঠোর স্বপ্ন তখন ভর করেছিল দুচোখে। রানী আপু সবকিছু ভুলে, সমস্ত কিছু ছেড়ে ঝাঁপাতে চেয়েছিল মরিয়া হয়ে- সেই সম্পর্কটার মধ্যে।

অরূপদাও হয়তো চেয়েছিল। কিন্তু বাইশ বছর আগের বাস্তব অন্যরকম কথা বলেছিল। এমনকি বাইশে শ্রাবণের রবীন্দ্রনাথও সেদিন বৃষ্টি ছাড়া হয়তো আর কিছুই আনতে পারেনি।

কিন্তু তানিয়া? জিম করতে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় লিটনের। তানিয়া তখন সবে এসএসসি পাস করেছে। মনের মধ্যে টগবগ করে ফুটছে স্বপ্ন। লিটনের সঙ্গে গোপনে দু-একটা বাইক রাউন্ড; তারপর সোজা বাড়িতে বলে দেওয়া; আলাপ করানো বাবা-মার সঙ্গে। জমে উঠল সম্পর্ক-ডেটিং আর চ্যাটিং-এ। তানিয়ার মনের মধ্যে বেশ ঝাঁকিয়ে ছড়িয়ে বসেছিল ভালোবাসার শেকড়। কিন্তু মাস-সাতেক পর তানিয়া বুঝতে পারে লিটনের বেশ কয়েকজন গার্লফ্রেন্ডের মধ্যে সে একটা নম্বর মাত্র। সম্পর্কের বিষয়ে সিরিয়াস নয় লিটন। বরং সরাসরি বলে ওঠে কোনো কমিটমেন্ট নয়, লাভ মানে প্লেজার আর এনজয়; এর আগেও চারজনকে নিয়ে সে সময় কাটিয়েছে; তানিয়া ইজ ফিফথ।

ভালোবাসার প্রথম স্বপ্নটা এভাবে ভেঙে যাবে, বুঝতে পারেনি তানিয়া। কিশোরীবেলায় আবেগ কাটতে না কাটতেই এত বড় ধাক্কা! ডিপ্রেশনে চলে যায় সে। তারপর ডাক্তার ওষুধ। কিছুতেই আর মন লাগে না তানিয়ার।

এক দিন বিকেলে পশ্চিমের জানালা দিয়ে হালকা আলো এসে পড়তে থাকে তানিয়ার বিছানার প্রান্তে। রানী আপু মেয়ের ঘর গুছাতে গুছাতে আপনমনেই গুনগুন করে গাইছিলেন গান। জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো ডিপ্রেশড তানিয়ার কানে হঠাৎ ভেসে আসে কথা- ‘কে মোরে ফিরাবে অনাদরে/কে মোরে ডাকিলে কাছে/কাহার প্রেমের বেদনায় আমার মূল্য আছে’। চমকে ওঠে তানিয়া- ‘কী বললে মা। এটা আমার মনের কথা! মা এটা কী ংগান- এটা? রবীন্দ্রসংগীত?’ তারপর বাইশ বছর ধরে সংসারের জাঁতাকলে চাপা পড়া রানী আপুর গান, রবীন্দ্রচর্চা একটু একটু করে বেরিয়ে আসতে থাকে, প্রতিদিনের গল্প-কথায়। মা আর মেয়েকে অনুভূতির সেতুতে বাঁধতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। ডিপ্রেশড তানিয়ার ডিপ্রেশন কাটাতে আর ওষুধ খেতে হয় না তেমন। ড্রয়িংরুমে ঘর সাজানোর জন্য যে রবীন্দ্র রচনাবলি কেনা হয়েছিল, তার গায়ের ধুলো সরিয়ে প্রায় রাত্রেই মা আর মেয়ে উল্টে নেয় পাতা। রানী আপু পড়তে থাকে কখনো ‘কথা’, ‘কাহিনী’, আবার কখনো বা ‘এ গান যেখানে সত্য/অনন্ত গোধূলি লগ্নে/সেইখানে/বহি চলে ধলেশ্বরী’। বাইশ বছর আগের শ্যামা, চিত্রাঙ্গদারা ফিরে আসে রানী আপুর গলায়। তানিয়ার ফোনে ডাউনলোড হতে থাকে রবীন্দ্রনাথের গান। তানিয়ার ঘরে বুক শেলফে ইংলিশ পেপারব্যাক থাকলেও মাথার কাছে, বালিশের নিচে থাকে রবীন্দ্র রচনাবলির কোনো একটা খণ্ড।

চার.

বৃষ্টি ধরে এসেছে প্রায়। রাতও বেশ গভীর হওয়ায় মেয়ের ঘর থেকে নিজের বেডরুমে চলে যান রানী আপু। কিন্তু তানিয়ার চোখে ঘুম নেই। আসলে, ঘুম না আসার সঠিক কারণটা তখনো বলেনি তানিয়া, মাকে।

অয়নের সঙ্গে তানিয়ার মাস তিনেক আলাপ। অয়ন সাহিত্যের ছাত্র। চোখে চশমা, একটু উদাসীন। অয়ন কবিতা লেখে। আর অয়নের একটা ডায়েরি আছে। যেখানে শুধু রবীন্দ্রনাথের কোটেশন লিখে রাখা। রবিঠাকুরের গান, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক- এসব লেখার মধ্য থেকে অয়নের যেগুলো ভালো লাগে, সেগুলোই সে লিখে রাখে ডায়েরিতে। তানিয়ার সঙ্গে প্রথম আলাপের কিছুদিন পর হোয়াটসঅ্যাপে অয়ন লেখে, তুমি আজকের দিনের ঔদার্যের মধ্যে কালকের দিনে আশঙ্কাকে টেনে এনো না। তানিয়া অবাক হয়; রিপ্লাইতে লেখে, ‘তুমি দারুণ কথা বলো। অয়ন উত্তর পাঠায়, ‘কথাটা আমার নয়, রবীন্দ্রনাথের, উনিই বলে গিয়েছেন। আমি একটু এদিক-ওদিক করে বললাম তোমাকে। অবাক হয় তানিয়া, সবই কী বলে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ!

রাত দশটা নাগাদ মেসেজ পাঠিয়েছিল অয়ন। বলেছিল, কাল বাইশে শ্রাবণ। একটা রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে তুমি আমার ঘুম ভাঙাবে। তানিয়ার বুকের মধ্যে তারপর থেকেই উথালপাতাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কী গান শোনাবে সে অয়নকে! মাঝরাতে মাকেও বলা হলো না কথাগুলো। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। বাইশে শ্রাবণের আগের দিন। বাইশ বছর আগের বাইশে শ্রাবণে এভাবেই তো বৃষ্টি নেমেছিল মায়ের জীবনে। মা গানটা শেষ করতে পারেনি। কিন্তু তানিয়াকে যে গানটা গাইতে হবে। শুরু করতে হবে। কী গান সে গাইবে- উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। একুশে শ্রাবণের রাতটা যে বড় বেশি তোলপাড় করে দিচ্ছে তাকে। উত্তর না পেয়ে ফোন থেকেই ফেসবুকে লগ ইন করে তানিয়া। চ্যাটে ফেভারিটের জায়গায় জ্বলজ্বল করে অয়নের নাম। শুধু এই মাঝরাতে তার নামের পাশের সবুজ আলো জ্বলে না। নোটিফিকেশন চেক করতে থাকে। দু-একজন এর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের ছবি পোস্ট করে জানান দিয়েছে বাইশে শ্রাবণের। একজন আবার লিখেছে, আজকের দিনেই কবি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আমাদের।

বিরক্ত লাগে তানিয়ার। কে চলে গিয়েছেন? রবীন্দ্রনাথ? কোথায় গিয়েছেন? যদি সত্যিই চলে যেতেন, তাহলে প্রতিটি মুহূর্তে আমরা তাকে ডাকতাম না, খুঁজতাম না, মনে মনে বলতাম না-কী করব বুঝতে পারছি না, একটু বলে দিন না। যে চলে যায়, তাকে তো কোনো দিন কোনো কথা বলা যায় না আর!

বাইরে বৃষ্টিটা থেমেছে। কিন্তু একটা ভেজা গন্ধ ঢুকে আসছে বন্ধ জানালা ঠেলেও। তানিয়ার মনের মধ্যে বড্ড বেশি তোলপাড় হচ্ছে। নিজের ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে লিখে দিল তানিয়া- ‘যেদিন খুব বৃষ্টি হয়, যেদিন মনে হয় সব কথা বলে ফেলি, যেদিন কথাগুলো বলার জন্যও রবীন্দ্রনাথের গানকেই খোঁজে মন, একমাত্র সেই দিনটারই নাম হওয়া উচিত ‘বাইশে শ্রাবণ’।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close