মনি হায়দার

  ২৯ জুলাই, ২০২২

স্রোতের বিপরীতে রবিন

আমি খুব সাধারণ মানুষ। একটু-আধটু গল্প লিখি। কিছু কিছু পাঠকে পাঠ করেন দয়া করে। কেউ কেউ কোথাও কোথাও নামণ্ডটাম বলেন। তখন বুকের ভেতরে এক ধরনের আগুন আনন্দের জন্ম হয়। সেই আগুন নেভে না। জলের ভেতরেও সেই আগুন জ¦লে দাউ দাউ দ্রোহে। আমি খুব একটা স্বীকৃতি পাইনি। কিন্তু যখন প্রত্যন্ত প্রান্তর থেকে আমাকে কেউ নাড়া দেয়, গ্রহণ করে আমি সাগরের ঊর্মির মতো আবেগে ফেটে পড়ি। কয়েক বছর আগে শেরপুর থেকে নাহিদ হাসান রবিন আমাকে ওর পত্রিকায় একটা গল্প পাঠাতে বলে, মোবাইলে। আমার খবর পায় গল্পকার সমীর আহমেদের কাছে। ওর তীক্ষè কণ্ঠস্বরে মনে হলো, বেশ ভারিক্কি টাইপের আর বয়স্ক মানুষ হবে। তো আমি আপনি আপনি বলে ওকে গল্প পাঠালাম। রবিন গল্প ছাপিয়ে পত্রিকাও পাঠাল। মফস্বলের যেকোনো কাজ, হোক সে পত্রিকা বা অন্যকিছু হয়তো খুব রঙিন হয় না কিন্তু প্রাণের স্পর্শে থাকে আকুল করা গন্ধ। রবিনের পত্রিকাও ছিল আমার কাছে সে রকম।

এ ঘটনার কয়েক মাস পরে, টাঙ্গাইলে মাহমুদ কামালের কল্যাণে দেখা হয়ে গেল রবিনের সঙ্গে। অনুষ্ঠানে কথাসাহিত্যের একটি পর্বে রবিনও ছিল আমার সঙ্গে। রবিন, এক্কেবারে তরুণ, তরতাজা একটা ছুটন্ত অশে^র মতো। মুহূর্তে, আমার যা স্বভাব, ওকে তুমি বললাম। রবিন মেনে নেয়। গড়ে ওঠে ওর সঙ্গে আমার যুগলবন্দির বন্দিশ। টাঙ্গাইলে দেখা হওয়ার পরে ওর সঙ্গে আমার ফোনে যোগাযোগ হতে থাকে। সেই যোগাযোগের সূত্রে এক বিমূর্ত সন্ধ্যায় রবিন আমাকে জানায়, শেরপুরে ওর একটা সংগঠন আছে অপরাজিত। সেই সংগঠন থেকে লেখক সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এবং আমাকে কথাসাহিত্যে একটা সম্মাননা দেবে। অপরাজিত কথাসাহিত্য সম্মাননা-২০১৬। আমিও পাগলা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলাম শেরপুরে।

ঢাকায় আমরা যারা থাকি, একটা ঘোর, একটা দৌড়ের ওপর থাকি। কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় পাই না। তো, শেরপুরে যাওয়ার পর ঢাকা শহরের অনেক লেখকের সঙ্গে দেখা হলো। থাকার আয়োজন করল বগুড়া পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমির বিশাল ক্যাম্পাসে। সেই রাতটা ছিল আমার জীবনের এক বিস্ময়কর রাত। আমার রুমে বসেছিল লেখক আড্ডা।

একটু শীত ছিল তখন। ঢাকায় কোনো শীত ছিল না। কিন্তু আমি শীত উপভোগ করতে চাই। খুব ভোরে উঠে আমি একা একা বেরিয়ে পড়ি কুয়াশা মাখা শীত দেখতে। বগুড়া পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমির ভেতরটা যদিও আলিশান প্রাসাদে পরিপূর্ণ কিন্তু চারপাশটা ঘিরে আছে গাছপালা। সেই গাছপালা ঘেরা প্রান্তর পার হয়ে আমি প্রবেশ করি ধানখেতে। ধানখেত জুড়ে ছিল ঘন কুয়াশার চাদর। অনেক অনেক দিন পরে আমি শীতের কুয়াশামাখা চাদর শরীরে মেখেছিলাম। সেই অনন্য সুযোগের জন্য রবিনের কাছে...। ওখানে আমার প্রথম পরিচয় হয় গল্পকার প্রত্যয় হামিদ, কবি মিজানুর রহমান বেলালের সঙ্গে। রবিনের সূত্র ধরে সেই পরিচয়ের সূত্র এখন অন্যরকম এক অনুভূতিতে পৌঁছেছে।

সম্মাননা নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছি। রবিনের সৃজনময়তার গল্প এখন আমার ভেতরে বেগমান। শুরুতেই লিখেছি, ঢাকার মানুষ নিত্য ছুটে চলে বেঘোরে বেহুঁশের মতো, দিগ্বিদিক। আমার খুব বেশি ফোন করা হয় না রবিনকে। কিন্তু রবিন আমার খোঁজ নেয়, প্রায়ই। আমি নিতে পারি না রবিনের খোঁজ, কিন্তু শিল্পের আলোয় আলোকিত রবিন রয়ে গেছে আমার অস্তিত্বের বারান্দায়। আমি ওকে গল্প লিখতে বলি। কোনো পত্রিকায় ওর লেখা দেখলে আমি পড়ি। এরই মধ্যে রবিনের ‘নির্বাচিত ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে এবং বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। বিশ্বাস করি, মফস্বলের যাবতীয় দৌড় অতিক্রম করে রবিন এক দিন সাহিত্যের নিবেদিত একজন পরম মানুষ হয়ে উঠবে।

আমাদের শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি টিকে থাকে এসব সৃজনবান্ধব রবিনের জন্য। কিন্তু রবিনদের আমরা খুব সহজে ভুলে যাই। এই ভুলে যাওয়া পাপ, অপরাধ। রবিন সৃজনের মধ্যে বেঁচে থাকো বিরামহীন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close