সোহেল মাজহার

  ০১ জুলাই, ২০২২

ধারাবাহিক রচনা- ৩৩

উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু

এখানে একটি কথা বলা দরকার, তাজউদ্দীনের পরিবারের আদি নিবাস মূলত পার্শ্ববর্তী গফরগাঁও থানার নিগুয়ারী গ্রামে। তার দাদা ইব্রাহিম খান বৈবাহিক সূত্রে দরদরিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। অল্প বয়সেই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র তাজউদ্দীন আহমদ পবিত্র কোরআন হেফজ করেন। কিন্তু কিশোর বয়সেই ব্রিটিশবিরোধী তিনজন রাজবন্দি রাজেন্দ্র নারায়ণ চ্যাটার্জি, বীরেশ্বর ব্যানার্জি আর মণীন্দ্র শ্রীমনি তার হাতে দেশবোধ মনীষীর জীবনকথা ও বিপ্লবী চিন্তাধারার বই তুলে দিয়ে তার মানস গঠনে সাহায্য করে, তার মধ্যে দেশবোধের বীজ বপন করে। তাজউদ্দীন আহমদ অল্প বয়স থেকে বিভিন্ন উদ্ভাবনী কাজ করে নিজের সৃজন-মেধার পরিচয় দিয়েছেন। গ্রামের দরিদ্র মানুষের খাদ্য সংকট মোকাবিলা করার জন্য বিত্তশালী গৃহস্থদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে ধর্মগোলা স্থাপন করেন। মাত্র ৯-১০ বছর বয়সে গজারিগাছ সংগ্রহ করে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সাঁকো নির্মাণ করেন। ছাত্র অবস্থায় বনবিভাগের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে জেলে যান। স্বভাবত তাজউদ্দীন আহমদ জাতির গভীর সংকটের মুহূর্তে ধীর স্থিরভাবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবেন।

আবার বঙ্গবন্ধু মুজিবের প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের ঠিক কী ধরনের বিশ্বাস, কতটা গভীর আস্থা ছিল? মনের ভেতর খেলারত সেই অনুক্ত ভাবনারাজি লেখক উল্লেখ করেন। ৭ মার্চের ভাষণের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের চিন্তা স্রোতের প্রকৃতি তার অবাক শ্রবণ- ‘মঞ্চে বসে তাজউদ্দীন অবাক হয়ে শুনছেন মুজিব ভাইয়ের ভাষণ আর ভাবছেন, কী অদ্ভুত, কী অবিশ্বাস্য এই কণ্ঠটি! মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। ...তাজউদ্দীনের হঠাৎ মনে হয় শেখ মুজিব যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা টলোমলো কোনো জাহাজের ক্যাপ্টেন, যিনি ঝড়ের আঘাত নষ্ট বেতার আর বুলেটবিদ্ধ যাত্রীদের নিয়েও সমস্ত দিক রক্ষা করে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন মাস্তুলের পাশে দাঁড়িয়ে। ক্যাপ্টেন বলছেন তাদের কানে কানে সঞ্চিত ক্ষোভের কথা, ক্যাপ্টেন বলছেন তাদের অধিকারের শব্দ। সহসা আঙুল তুলে রূপকথার সেই ক্যাপ্টেন বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

‘সেই মুহূর্তেই ঝড় উঠল সমুদ্রে, আকাশ-বাতাশ তুচ্ছ হয়ে গেল, উত্তেজনায় উন্মাদ হয়ে উঠল সুস্থিরতম মানুষটিও। তাজউদ্দীন গর্জনরত সামনের সমুদ্রের দিকে চেয়ে অনুধাবন করলেন, এই মাত্রই শেখ মুজিবের তর্জনীতে পদ্মার পলিদ্বীপের অভিধানে যোগ হয়ে গেছে একটি অবিশ্বাস্য শব্দ। স্বাধীনতা।’

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এক তাজউদ্দীন আহমদ দিনের পর দিন অতি সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। নিজের ব্যক্তিগত কর্মচারী মকফুরকে নিজ হাতে সেবা ও পরিচর্যা করেন। ছেলে অসুস্থ হওয়ার পরও তাকে একটিবারের জন্য দেখতে যাননি। কারণ কথা দিয়েছিলেন মুক্তি অর্জন না করে পরিবারের সঙ্গে দেখা করবেন না। রণাঙ্গনে সাধারণ যোদ্ধাদের সঙ্গে মাটিতে বসে খাবার খেয়েছেন। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ষড়যন্ত্র ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দ্বিধা অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ সময় তার পাশে যথার্থভাবে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজামানের মতো নেতারা। সবকিছু উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন মুক্তিকামী অধিকাংশ মানুষ একজন তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। খোন্দকার মোশতাকসহ একটি চক্র বারবার তাজউদ্দীন আহমদকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। সেজন্য সে সুকৌশলে যুবনেতাদের মাঝে প্রচার করেন স্বাধীনতা থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে শিলিগুড়ির আস্থা সভায় তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ়তার সঙ্গে বক্তব্য দিয়ে যেভাবে কূটচাল ছিন্ন করেন তা অবিস্মরণীয়। লেখক উল্লেখ করেন- ‘আমরা স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতা পেলেই বঙ্গবন্ধুকে আমাদের মাঝে পাব।’ কোলাহল স্পর্শ করতে চাইল ছাদ, কিন্তু তাজউদ্দীন স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে লাগলেন এক একটি, আর থেমে যেতে লাগল সমস্ত আক্রমণ। আজ যদি বঙ্গবন্ধু মুজিবের জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পাই, তাহলে সেই স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যেই পাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে।...

বাংলাদেশ যদি আজ এত রক্তের বিনিময়েও স্বাধীন না হয়, তাহলে বাংলাদেশ চিরদিনের জন্য পাকিস্তানি দখলদারদের দাস হয়ে থাকবে। ...আর এই অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তানে যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েও আসেন, তবু তিনি হবেন পাকিস্তানের গোলামির জিঞ্জির পরাণ এক গোলাম মুজিব। বাংলাদেশের জনগণ কোনো দিন সেই গোলাম শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলে গ্রহণ করবে না, মেনে নেবে না।

স্বাধীনতা ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। পরাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন না। আমরা যদি ভুল করে থাকি তবে দেশ স্বাধীন হলে আপনারা আমাদের বিচার করবেন এবং আপনাদের রায় আমরা মাথা পেতে নেব।

...মুজিব স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসবেন এবং তাকে আমরা জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনব ইনশাল্লাহ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close