reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০১ জুলাই, ২০২২

নতুন চোখে অন্য রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরম বিস্ময়, অতল শ্রদ্ধা, শ্রেষ্ঠ সৃজনীক্ষমতার একজন। যার সম্পর্কে আমরা সবাই অল্প-স্বল্প বা একটু বিস্তৃত জানি। এই অল্প জ্ঞান আর স্বল্প জানা দিয়ে এক অসীম ক্ষমতাধর সাহিত্যকে নিয়ে যে যার মতো ভাবি। এই ভাবনায় শত বছর ধরে রস জুগিয়ে যাচ্ছে বাজারে ব্যাপক প্রচলিত এবং জনপ্রিয় যৌনগন্ধী গালগল্প। তরুণ লেখক আমিনুল ইসলাম হুসাইনীর ‘আরশজানের বায়স্কোপ’ পাঠ করে ভালো লাগা থেকে তারই রচিত ‘রবীন্দ্রনাথ কথা রাখেনি’ গ্রন্থটি পাট করতে আগ্রহী হই। কিন্তু এখানে দেখি সেই চর্বিত চর্বন। রবীন্দ্রনাথ ও তার পরিবারকে নিয়ে মনগড়া রং মাখামাখি। এর আগে ‘আমি মৃণালিনী নয়’ বা ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট’ পাঠ করা ছিল বলে এ জাতীয় লেখার অন্তঃসারশূন্য, কল্পনাবিলাসী অচিন্তনীয় লেখা সম্পর্কে অবগত আছি। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হয়ে রবীন্দ্রনাথ বা বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে একটুখানি পড়ালেখা, চিন্তা করা শিখেছি। রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনী বা তার ছেলের রচিত ‘আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ’, কিংবা মৈত্রেয়ী দেবী রচিত ‘মঙপোতে রবীন্দ্রনাথ’ পাঠ করেছি। কিন্তু কোথাও এমন অতি নাটকীয়তা, আদি রসাত্মক বর্ণনা পাইনি। হ্যাঁ, স্বীকার করছি রবীন্দ্রনাথ আট-দশটা মানুষের মতোই সামাজিক, পারিবারিক, জাগতিক। সেই সঙ্গে পরাধীন ভারতবর্ষের ওই সময়ের উচ্চবিত্তই বলা চলে।

পারিবারিক আভিজাত্য, রুচিবোধ, স্বশিক্ষা, সুশিক্ষা, শৈল্পিক জীবনযাপন, স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিমণ্ডলে সাংস্কৃতিক আবহে বড় হয়ে ওঠা শিল্পীসত্তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, সমগ্র ঠাকুর পরিবারই ছিল বাঙালির কাছে আগ্রহের বিষয়, শিক্ষণীয় জায়গা, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তাই তাকে নিয়ে এমন গালগল্প হওয়াটা অতি স্বাভাবিক। হোক; তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু যৌনজীবন নিয়ে এমন মনগড়া লেখা কেন? আমি মৃণালিনী নয় কিংবা কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট যেমন শুদ্ধ পাঠকের কাছে মনগড়া, অতি নাটকীয়তায় পূর্ণ লেখা মনে হয়েছিল, তেমনি আমিনুল ইসলাম হুসাইনী রচিত ‘রবীন্দ্রনাথ কথা রাখেনি’ গ্রন্থটিও আমার কাছে অর্বাচীন মস্তিষ্কপ্রসূত, কল্পনাবিলাস বলে মনে হয়েছে। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নতুন বৌঠান কাদম্বরীর মধ্যে বন্ধুত্বের শুরুটা লেখক ভালোভাবেই দেখিয়েছেন। তাদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব বা প্রেম তা শতভাগ খাঁটি সত্য। কিন্তু তাদের নিয়ে অতিরঞ্জিত মাখামাখি প্রেমের কাহিনি মিথ্যার চেয়েও মিথ্যা। রবীন্দ্রনাথের শৈল্পিক সত্তা বিকাশে প্রথম দিককার অনুপ্রেরণা এবং যিনি আজীবনই তার কাছে পরম শ্রদ্ধার ভালোবাসা পূর্ণ আসনে আসীন ছিলেন তিনি কাদম্বরী দেবী। তাই তাদের নিয়ে অতিনাটকীয় রসপূর্ণ মনগড়া কথোপকথন আমাদের আহত করে।

এই বইয়ের লেখক ধন্যবাদ পাবেন তার সাহসের জন্য। তার পঠনপাঠনের জন্য, ঝুঁকি নেওয়ার জন্য। কেন না বাঙালি মাত্রই যে রসের হাঁড়ির খবর নিতে চায়, সেই রসের কথাটিকেই তিনি পাঠকের কাছে নিজের মতো উপস্থাপন করেছেন। যেহেতু এটি একটি ইতিহাস আশ্রিত, একটি সময়কে ধারণ করা পরিবারের কাহিনি, সেহেতু চরিত্র নির্মাণে আরো অনেক বেশি পরিশ্রমী অনুসন্ধানী তথ্যনির্ভর হওয়া জরুরি ছিল। বইয়ের ভাষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার সময়কে ধারণ করেনি। তৎকালীন শিক্ষিত শিল্পিত চরিত্রের ভাষা মোটেও ওই স্থানকে নির্দেশ করে না। এই উপন্যাসে নর চরিত্রগুলোর চেয়ে নারী চরিত্রগুলো অনেক বেশি সক্রিয়। তাই তার উচিত ছিল তৎকালীন কলকাতার ভদ্র কিংবা নিরক্ষর নারীদের ভাষাটা আয়ত্ত করা। উপন্যাসে লেখক যে গানগুলো ব্যবহার করেছেন এবং যে সময়ের কথা বলেছেন, তা সম্পূর্ণ মনগড়া। শুধু বিয়ের আসরে তিনি যে গানটির কথা বলেছেন সেটি বাদ দিলে বাকিগুলো মোটেও সময় স্থান অনুযায়ী হয়নি। এই উপন্যাসের সব থেকে মিথ্যাচারটি হলো উপন্যাসের শেষের চিঠিখানি। এখানে লেখক ভুলে গেলেন কল্পনারও লাগাম থাকে।

নারী চরিত্রগুলো সৃষ্টিতে লেখক অনেকাংশেই সফল। পরবর্তী লেখায় তিনি যদি নারীসুলভ ভাষা, নারী মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-দ্বান্দ্বিকতা মাথায় রাখেন বা রপ্ত করেন, তা হবে পাঠক লেখক দুজনের জন্যই কল্যাণকর উপভোগ্য। মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে লেখক বুঝি তৎকালীন দাপুটে অভিনেত্রী বিনোদিনীকেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বানাতে আগ্রহী এই উপন্যাসে। পিরালি বংশের যে ইতিহাস এই গ্রন্থে আমরা পাই, তা শতভাগ নির্ভুল মনে হয়নি। যেখানে লালন সাঁইজির প্রসঙ্গে লেখক বলেন, তখন মনে হয় আমি যেন গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রটি দেখছি। এতটা কপি না করলেও চলত। এখানেই শুধু কুষ্টিয়ার খাঁটি ভাষাটি পাই। কিন্তু এ যে চলচ্চিত্র থেকে নেওয়া!

লেখক যদি নিজে পরিশ্রম করতেন তবে এ সমস্যা খুব সহজেই উতরে যেতে পারতেন। অনেক জায়গায় মনে হয়েছে অতি নাটকীয়তা, খানিকটা যাত্রা পালার ঢং। যেমন- কাদম্বরীর পায়ে জড়িয়ে ধরা। রামকৃষ্ণ, বিনোদিনী, গিরিশ ঘোষ, গঙ্গা বাই, ব্রজনাথ শেঠ এদেরও তিনি সমান গুরুত্ব দিয়েছেন বা কিছু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বা কাদম্বরীর চেয়েও বেশি ফোকাস দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয় পরে তিনি এদের নিয়ে আলাদা আলাদা উপন্যাস লিখলে ভালো করবেন, তবে সেগুলো হতে হবে ইতিহাস আশ্রিত, পরিশ্রমের ফসল।

* মো. রাজন মিয়া

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close