সোহেল মাজহার

  ২৪ জুন, ২০২২

ধারাবাহিক রচনা- ৩২

উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথাসাহিত্যে স্পষ্ট করে বললে উপন্যাসে তার যথাযথ প্রতিফলন নেই। যতটুকু আছে তা শুধু কল্পনানির্ভর। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত, বাস্তবতা ও পরিসংখ্যানভিত্তিক কথাসাহিত্য নেই। মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ, সেনা কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ আমলা, ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের মন-মানস, দৃষ্টিভঙ্গি মানসিক চিন্তার গতি-প্রকৃতি প্রসঙ্গে তেমন কোনো উপন্যাস লিখিত হয়নি। পীর হাবিবুর রহমান প্রধান সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একটি অনালোচিত অধ্যায়কে আবিষ্কার করেন। লেখক পাকিস্তানের দুজন শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তির তীব্র নারীসঙ্গের প্রবণতা, বহুগামিতা ও যথেচ্ছ ভোগের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন। পাশাপাশি পাকিস্তানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বাঙালিবিদ্বেষ ও রক্তপিপাসা চিহ্নিত করেন।

অন্যদিকে লেখক ষাটের আন্দোলন, ছয় দফা ও গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন। তবে একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ২৫ মার্চের আগের থমথমে অবস্থা ইয়াহিয়া শেখ মুজিব সংলাপ, ১৯ মার্চ জয়দেবপুরের প্রতিরোধ যুদ্ধ, ২৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি লেখক সুচারুভাবে প্রতিস্থাপিত করেন। ২৫ মার্চের গণহত্যার আশু আশঙ্কার কারণে বিভিন্ন নেতাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে নির্দেশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু পালিয়ে না যাওয়াতেই ইতিহাস তার অনন্য ভঙ্গির কাছে নত হয়। আবার কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের স্বাধীনতার ঘোষণা বিস্তারিত উপন্যাসে মূর্ত হয়; যার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়া পাঠ করেছেন মাত্র। পাকিস্তানের কারাগারের শেষ কয়েক দিনের ঘটনা লেখক সবিস্তার তুলে ধরেন তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জুলফিকার আলীর প্রস্তাবের সামনে যে অনমনীয় দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসাযোগ্য। লন্ডনে শেখ মুজিবকে দেওয়া আন্তরিক অভ্যর্থনা, ভারত হয়ে দেশে ফেরার ঘটনাপ্রবাহ লেখক তার গতিশীল ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরেন।

সুহান রিজওয়ানের সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ : ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় ইতিহাসের ভয়াবহতম ঘৃণ্য গণহত্যা চালায়। গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সমগ্র ঢাকাবাসী-দেশবাসী প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটেছেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতারা ও সংগঠকদের অধিকাংশ ছিলেন হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অনেকে হয়তো স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুজিবের অনুপস্থিতে একটি প্রতিনিধিত্বশীল অবস্থান থেকে সমগ্র জাতির মুক্তিযুদ্ধকে সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় পরিচালনা করা খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। তাজউদ্দীন আহমদ সেই প্রয়োজন, তাৎপর্য ও আইন সংগত অধিকার অতিসত্বর অনুভব করেন। মার্চের ২৭ তারিখ স্বল্প সময়ের জন্য কারফিউ তোলে দিলে মুহূর্তের মধ্যেই তিনি তার কর্তব্য স্থির করেন। লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশ নিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বেরিয়ে যান। সঙ্গে ছিল তরুণ সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-পরিজনের নিরাপত্তার ভাবনা তাদের কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুতি করতে পারেনি। উপরন্তু সবাই তার কাছে দেশের অগণন মানুষের একজন হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। সে কারণে স্ত্রীর কাছে তিনি যে চিঠি লিখেছেন, তা অবিশ্বাস্য রকমের হৃদয়গ্রাহী- ‘লিলি, আমি চলে গেলাম। যাওয়ার মুহূর্তে কিছু বলে আসতে পারিনি, মাফ করে দিও। পরিবার নিয়ে তুমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে মিশে যেও। কবে দেখা হবে জানি না... মুক্তির পর।’

মূলত লেখক বঙ্গবন্ধুর প্রবল ব্যক্তিত্বের কারণে অনালোকিত একজন নিঃসঙ্গ মুক্তিনায়ক তাজউদ্দীন আহমদের আখ্যান বলেছেন ‘সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ’ উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শুধু নয়, ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, অসহযোগ আন্দোলন যোগসূত্রে যুক্ত থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিবের বিশ্বস্ততা অর্জন করেন, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু একজন তাজউদ্দীন আহমদ কীভাবে দেশবোধ, গভীর নিষ্ঠা, নির্মোহ জীবনবোধ, সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি, দূরদৃষ্টি, গভীর প্রজ্ঞা ও আনুগত্যবোধ অর্জন করেন? পাঠক উপন্যাস পাঠে জানতে পারেন তাজউদ্দীন আহমদ কাপাসিয়ার শীতলক্ষ্যা নদী-তীরবর্তী শাল-গজারি বনবেষ্টিত দরদরিয়ার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close