আবু হাসান শাহরিয়ার

  ২৪ জুন, ২০২২

সাহিত্যের ত্রয়ীকথা অথবা গ্রন্থে শোকে ‘ব্যাকরণ মানি না’

শব্দ জনপদের তিন নৃপতি শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র মুখোপাধ্যায় ও মৃণাল বসুচৌধুরীর প্রয়াণসংশ্লিষ্টতায় তিনটি বইয়ের ত্রয়ীর অধিক ত্রয়ী ওঠার আখ্যান এই পর্ব। প্রাসঙ্গিক হলে আর স্বতঃস্ফূর্ত এলে কবি ও কবিতাবিষয়ক ‘আর কিছু... আরো কিছু...’ কথাও থাকতে পারে- থাকবে।

বই তিনটির নাম- ‘শিশিরে পা রাখো অসুখীরা’, ‘শরণার্থী ঘর-বারান্দারা’ ও ‘নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর’। প্রথম দুটি আমার কবিতাগ্রন্থ; তৃতীয়টি মৃণাল বসুচৌধুরী ও আমার চিঠি চালাচালিতে রচিত একটি বই। উৎসর্গ সুবাদে প্রথমটির আরো একটি পরিচয়- দীক্ষাগুরুকে আমার সামান্য গুরুদক্ষিণা ওই উৎসর্গ।

আমার লেখালিখি যাদের ভালো লাগে কিংবা যাদের ভালো লাগা আমার লেখালিখির প্রেরণা, তাদের অনেকেই জানেন, শঙ্খ ঘোষ আমার তিন দীক্ষাগুরুর (অন্য দুজন লালন ও রবীন্দ্রনাথ) একমাত্রজন, যাকে আমি যুগপৎ কৃত্যে ও কায়ায় পেয়েছি। ২১ এপ্রিল ২০২১ থেকে তিনি কায়াহীন মায়ার আখ্যান।

উৎসর্গকৃত বইটি প্রণামপূর্বক শঙ্খ ঘোষের হাতে তুলে দিয়েছিলাম ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮-এ। তার সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎও সেদিন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত একটি দোতলা বাড়ির সুপরিসর কক্ষে বইটির পাঠোন্মোচন করেছিলেন সাতটি মহাকবিতা এবং ‘শবযাত্রা’, ‘ইবলিশের আত্মদর্শন’ ও ‘আগুনের বাসিন্দা’র মতো মৌলিকত্বে উজ্জ্বল বইয়ের স্রষ্টা- পবিত্র মুখোপাধ্যায়। ষাট বছরেরও বেশি সময় তিনি ‘কবিপত্র’ নামের একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে বাংলা কবিতার নিবিড় পরিচর্যা করেছেন। যেদিন যেখানে বইটির পাঠোন্মোচন, সেদিন সেখানে শ্রুতি কবিতাণ্ডআন্দোলনের বরপুত্র মৃণাল বসুচৌধুরীর ৭৫তম জন্মবর্ষ উপলক্ষে রিয়া চক্রবর্তী আর ওর কবিবন্ধুরা একটি নির্মল কবিতাসন্ধ্যা আয়োজন করেছিলেন। সেটাই ছিল মূলপর্ব। উল্লিখিত পাঠোন্মোচন তার বর্ধিতাংশ।

যৌবনের কবিবন্ধু শচীন গঙ্গোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণে ‘মৃত বন্ধুর জন্য’ শিরোনামে একটি স্মরণকবিতা লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। নিচের পঙ্ক্তিগুলো সেখান থেকে নেওয়া- ‘এবার আমাদের শান্ত উৎসবে/তোমার নামে কোনো আসন নেই।/এবার অর্জুন কিংবা সেগুনের/পায়ের নিচে শুধু প্রাচীন ধস/...তুমি যে নেই আজ সেটাই স্বাভাবিক/তুমি যে ছিলে সেটা অভাবনীয়।’

থই থই আবেগে বিস্তর করুণরসের কবিতা লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়। কিন্তু, উদ্ধারকৃত পঙ্ক্তিগুলো মতো- বিশেষ করে শেষ দুটি পঙ্ক্তির মতো- আবেগের সংহত প্রকাশ কম কবিই দেখাতে পেরেছেন। আবেগ না থাকলে কবিতা হয় না;- শুধুই আবেগ থাকলে আরো হয় না। ‘মৃত বন্ধুর জন্য’ থেকে উদ্ধারকৃত পঙ্ক্তিগুলো শেলির ‘sïlark’ কবিতার ‘Our sweetest songs are those that tell of saddest thought’-এর নিকটাত্মীয়।

নিজেও আমি মনে করি... কবিতা হচ্ছে, প্রজ্ঞাশাসিত আবেগের ‘অভাবনীয়’ প্রকাশ। শঙ্খ ঘোষের অধিকাংশ কবিতা এই ‘অভাবনীয়’র দৃষ্টান্ত। বাংলা সাহিত্যে শাখা-প্রশাখাময় এক বিপুল অধ্যায়ের নাম শঙ্খ ঘোষ। রবীন্দ্রনাথের পর বুদ্ধদেব বসু ছাড়া এ প্রকার বিপুলতার আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে শঙ্খ ঘোষের ‘ত্রিতাল’ শিরোনামের কবিতাটি পাঠে নেওয়া যেতে পারে এবং দরকার আছে মনে হলে বলাও যেতে পারে কিছু প্রাসঙ্গিকতা- ‘তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু/শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া/তোমার কোনো বর্ম নেই, শুধু/বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া/পাতালমুখ হঠাৎ খুলে গেলে/দু ধারে হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া/তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই/শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।’

কনস্তান্তিনস কাভাফির ‘ইথাকা’র মতো শঙ্খ ঘোষের ‘ত্রিতাল’ও একজন নবীন কবির জন্য উত্তম পথনির্দেশিকা। ফিরে ফিরে পাঠের কবিতা ‘ত্রিতাল’। কবে কিংবা কোন বয়সে প্রথমপাঠ, মনে নেই; শুধু জানি, অনেকবার পড়েছি কবিতাটি এবং প্রতিবারই প্রথমপাঠের আনন্দ পেয়েছি।

‘ত্রয়ী’ যেমন সাহিত্যের, ‘ত্রিতাল’ তেমনি শাস্ত্রীয় সংগীতের ব্যাকরণ কথা। শঙ্খ ঘোষের ‘ত্রিতাল’ পড়ার পর সংগীতের এটা-ওটা বিষয়ে কৌতূহলী হয়েছিলাম বলেই গানের ফাঁকতাল, কবিতার স্পেস আর চারুশিল্পের রিলিফের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম এক দিন। তিনটি তালি (ঝোঁক) ও একটি খালির (ফাঁকতাল) সমবায়ে গঠিত ত্রিতালের ব্যাকরণ না-জানলে সুরের রসাস্বাদন বাধাগ্রস্ত হয় না;- কিন্তু, জানা থাকলে সেই আস্বাদন পরিধিতে বাড়ে।

কথা ছিল, ত্রয়ী স্ট্যাটাসের তৃতীয় পর্ব গ্রন্থে- শোকে ‘ব্যাকরণ মানি না’ হবে; অথচ কবিতার ব্যাকরণ কথার পরিবর্তে আমি সংগীতের ব্যাকরণচর্চা করছি;- মানে কী? কোনো জিজ্ঞাসু পাঠকের মনে যদি এ প্রশ্ন উঁকি দেয়, তাকে আমি যথাস্থানে যথাপ্রশ্ন করার জন্য সাধুবাদ জানিয়ে আত্মপক্ষসমর্থনে দুটি পঙ্ক্তি শোনাব- ১. কোনো যে মানে নেই, সেটাই মানে। ২. ছন্দ উচ্ছেদের আগে ছন্দ জানা অতি-বাঞ্ছনীয়। প্রথম পঙ্ক্তিটি শঙ্খ ঘোষের কবিতা থেকে নেওয়া; দ্বিতীয়টি আমার কবিতায় আছে।

বাংলা ভাষার দুর্ভাগ্য- কবিতা, ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাসে বিশ্বমানের কিছু কাজ হলেও সমালোচনা-সাহিত্য এখনো দাঁড়াতে শেখেনি। এ কারণেই জীবনানন্দ তার কবিতা নিয়ে লেখালিখির চৌদ্দআনা খারিজ করে দিয়ে নিজ নিজ কবিতা নিয়ে লেখালিখি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন কবিদের। শঙ্খ ঘোষের ‘কবিতার মুহূর্ত’ বইটি এবং বিনয় মজুমদারের ‘আমার ছন্দ’ ও ‘ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ’ গদ্য দুটি পূর্বসাধকের পরামর্শকে মান্যতা দেয়। আবার, জীবনানন্দের অভিজ্ঞতাই সব নয়। তার গদ্যে সেই অভিজ্ঞতার ষোলোআনা ব্যক্তও হয়নি। হলে ‘ধূসর পা-ুলিপি’ নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনা প্রবন্ধটির কথাও বিশদে আসত। সমালোচনা-সাহিত্য দাঁড়ায়নি মানে এই নয় যে, হামাগুড়িও দেয়নি। তাই যদি হতো, শামসুর রাহমানের কবিতাবিশদে হুমায়ুন আজাদের ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’ পেতাম না আমরা। সেই ‘শেরপা’কে নিয়ে লেখা ‘আমরা একসঙ্গে হেঁটেছিলাম’ নামে আমারও কোনো বই থাকত না। কফি হাউসে বইয়ের পাঠোন্মোচন দূরে থাক, ফাল্গুনী ঘোষের ‘কালে-কালান্তরে পবিত্র মুখোপাধ্যায়’ নামের কোনো অগ্রন্থিত পা-ুলিপির কথাও শোনা যেত না। প্রাসঙ্গিক আরো কথা- পবিত্র মুখোপাধ্যায় প্রবর্তিত মহাকবিতা মধ্যযুগের মহাকাব্যের আধুনিক বিনির্মাণ এবং সেই বিনির্মাণের ধারাবাহিকতায় ফাল্গুনী ঘোষও একাধিক ‘মহাকবিতা’র জনক। সর্বদা একমত হতে না-পারলেও কবিতা নিয়ে ফাল্গুনীর মৌলিক ভাবনাগুলোকে সম্মান করি। তার সম্পাদিত ‘চিন্তক’ও প্রশংসার দাবি রাখে। লেখালিখিকে যারা নিছক ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ মনে করেন না, ফাল্গুনী তাদের মনোরাজ্যের বাসিন্দা। কায়া-কৃত্যে পরিচয়ের দিন- স্বভাববৈশিষ্ট্যে চৌদ্দআনা মিল আছে বলে- এপার বাংলার এক তরুণ কবিকে মনে পড়েছিল- মাননা মেহেদি। ওই মনোরাজ্যর চিত্তশালী নৃপতি পবিত্র মুখোপাধ্যায়। তার বই নিয়ে লেখালিখি পাঠককে নবীন-প্রবীণ অনেক কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি নিজে। বই ধরে ধরে আমার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ওপর সমালোচনা-গদ্য লিখেছেন তিনি। ছাপা হয়েছে শ্যামলকান্তি দাশ সম্পাদিত ‘কবিসম্মেলন’-এ (শ্যামলকান্তি দাশও এ প্রকার পরার্থপরতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের হাতে আমার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটি তিনিই ধরিয়ে দিয়েছিলেন)। আমার পঞ্চাশ পূর্তিতে অনুজপ্রতিম কবি-সম্পাদক রনজু রাইমের ‘কবিতা সংক্রান্তি’ একটি সংখ্যা করেছিল আমাকে নিয়ে। সেখানে পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের গদ্যটি। সেখান থেকে চুম্বকাংশ তুলে ধরে মৃণাল বসুচৌধুরীও একটি চিঠি লিখেছিলেন আমাকে। সেখান থেকে কিছু উদ্ধার-

* আবু হাসান শাহরিয়ার একজন কবি; ক্ষমতাবান কবি। দুই বাংলার এক মাতৃভাষার ‘বাংলা ভাষা’র অন্যতম বিশিষ্ট কবি। এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তার হাতে সার্থক কবিতা লেখার সব ক্ষমতা ও দক্ষতাই আছে।

* অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্র কলাবৃত্তে শাহরিয়ারের অনায়াস চলাচল। কিন্তু গদ্য, নিছক গদ্যভঙ্গিতেও তার দক্ষতা আমাদের বিস্মিত করে।

* মিশ্র কলাবৃত্তের পঙ্ক্তিগুলো গদ্যের মতো সাজানো হয়েছে। কিন্তু অক্ষরবৃত্তের চোরা

সুরস্রোত রয়েছে এখানেও।

শেষ মূল্যায়নটি আমার ব্যাকরণসম্মত ত্রয়ীগ্রন্থের প্রথম বই ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’-এর পাঠোদ্ধার। সবগুলো বই থেকে এমন চুম্বক কথা তুলে ধরার পর চিঠির শেষাংশে মৃণাল বসুচৌধুরী লিখেছিলেন- ‘অর্থাৎ কবিতায় তোমার সর্বশেষ প্রণোদনাও তার চোখণ্ডকান এড়ায়নি। এর আগে আমরা বিভিন্ন আলোচনায় পুস্তক সমালোচনা নিয়ে অনেক কথা বলেছি। কিন্তু দ্যাখো, পবিত্রদার এই আলোচনা প্রমাণ করে- সৎ কবিরা কোনো না কোনোভাবে পুরস্কৃত হয়ে থাকেন। তোমাকে চেনেন না তিনি, অথচ...’

ভুল বলেননি মৃণাল বসুচৌধুরী। পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ওই গদ্যটিকে আমি জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তিগুলোর একটি মনে করি। কৃত্যে পূর্বপরিচিত পবিত্র মুখোপাধ্যের সঙ্গে আমার কায়াগত অপরিচয় দূর হওয়ার দিন তিনি নিজের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটি অটোগ্রাফসহ উপহার দিয়েছিলেন। ‘সত্যিকারের কবি’ সম্বোধন করে দেওয়া সেই অটোগ্রাফটিকেও আমি পুরস্কারের অধিক পুরস্কার জানি। বাংলা কবিতার চলমান বর্তমান ভাঁড় ও ভিখারিতে সয়লাব। পবিত্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন এর ষোলোআনা ব্যত্যয়। সত্য ও সুন্দরের চিরবর্তমান প্রজ্বালন তার কবিতা। আত্মপ্রতিকৃতিসদৃশ ‘রাজ তখতে নেই বলে’ কবিতাটি সেই প্রজ্বালনের তিমিরনাশা শিখা-

‘রাজ তখতে নেই বলে ভাঁড় ও ভিখারি থেকে দূরে/রয়ে গেছি, স্বাভাবিক জীবন জড়িয়ে/এক কবি।/এরকম কেউ কেউ বেঁচে থাকে যুদ্ধ বা বিপ্লব/বাঁচিয়ে, একান্তে, সামাজিক/ব্যক্তির সংকীর্ণ পরিচয়/বয়ে, খুশি মনে/সারাটা জীবন।/দু পা গিয়ে, তিন পা পিছিয়ে নয়; জীবন যেমন/তাকে ছুঁয়ে ছেনে; তাকে/প্রেমে ও ঘৃণায়/সরে বা বুকে টেনে/এইভাবে বুঝে নিতে নিতে/শেকড় চারিয়ে/বহুদূর আছি।’

শেষ পঙ্ক্তির এই ‘বহুদূর’ ভিন্ন প্রেক্ষিত ও ভিন্ন ব্যঞ্জনায় পবিত্রর অন্য কবিতাতেও পাই-

‘যে যাবে অনেক দূর, তাকে বলি ধীর পায়ে হাঁটো।’ পঙ্ক্তিটি কাভাফির ‘ইথাকা’ এবং শঙ্খর ‘ত্রিতাল’ -এর সমার্থক।

কবিতার পথ কবির নিজস্বতা দাবি করে। স্বরচিত সেই পথের কথা মৃণাল বসুচৌধুরীর কবিতায়ও ‘অভাবনীয়’ভাবে এসেছে- ‘মেতে থাকুন/একটা কিছু করার জন্য/ভেতর ভেতর তেতে থাকুন/যেদিকটাতে যায়নি কেউ/সেদিকটাতেই/যেতে থাকুন।’

তার আরো একটি কবিতায় আরো বেশি ব্যঞ্জনায় সেই পথের কথা আছে- ‘কবিকে উজ্জ্বল হতে বলেছিল কোনো এক উদাসীন নারী/কবিকে চতুর হতে বলেছিল মেধাবী বন্ধুরা/কবিকে লম্পট হতে বলেছিল বাচাল বান্ধবী/কবিকে পি ত হতে বলেছিল কিছু সম্পাদক/কবিকে প্রেমিক হতে বলেছিল কিশোরী পাঠিকা/কবিকে মাতাল হতে বলেছিল দক্ষিণ বাতাস/কবিকে আত্মস্থ হতে বলছিল নিষ্ঠুর প্রকৃতি/কবিকে নিজের কাছে ফিরে যেতে বলেছিল আশ্চর্য কলম/এই কবিতাও একজন নবীন কবির জন্য পথনির্দেশিকা।’

ব্যাকরণবিমুখ ত্রয়ীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বই বিষয়ে এখন পর্যন্ত আলাদা করে কিছু বলা হয়নি। তবে, যা বলার ছিল এরই মধ্যে তার চৌদ্দআনা বলা হয়ে গেছে। সংক্ষেপে অবশিষ্ট দুইআনাও বলি।

‘শরণার্থী ঘর-বারান্দারা’ প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল অমর একুশে বইমেলা ২০২১-এ। সে-বছর প্রকাশিত না হওয়ার জন্য করোনা ও আমি সমান দায়ী। এ বছরও প্রকাশিত না-হওয়ার দায় আমার একার। বইটির উৎসর্গপত্রে মৃণাল বসুচৌধুরীর নাম যাবে জানিয়ে নাগরীর কর্ণধার সুফিকে যেদিন আশ্বস্ত করেছিলাম, সেদিন দীর্ঘ ১১ মাস বিরতির পর ফেসবুকে পোস্টকৃত দ্বিতীয় স্ট্যাটাসে উৎসর্গের কথাসহ ‘শরণার্থী ঘর বারান্দারা’র উল্লেখ ছিল। পরদিন ফোনে ফোনে সুফিকে বইটির শেষ পরিমার্জন বুঝিয়ে দেওয়ার কথানুসারে যখন আমি ‘নাগরী’র ফোনের অপেক্ষায়, তখনই অনুজপ্রতিম কবি হেলাল উদ্দিন হৃদয়ের ফোন। যেভাবে মৃণাল বসুচৌধুরীর ফোনে এক দিন পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের... ঠিক সেভাবে হেলালের ফোনে মৃণাল বসুচৌধুরীর...

ব্যাকরণবিমুখ ত্রয়ীর তৃতীয় বই ‘নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর’ মৃণাল বসু চৌধুরী ও আমার দেড় মাসের পত্রবিনিময়ের ফসল। মাধ্যম ই-মেইল। প্রকাশক ভাষাচিত্র। বইয়ের শুরুতে দুই রচয়িতার আঁতুড়কথন আছে। নিচের পরিচিতিমূলক বাক্য তিনটি মৃণাল বসুচৌধুরীর আঁতুড়কথন থেকে নেওয়া...

‘দেড় মাসের এই ভাবনাভ্রমণে আমরা শ্রদ্ধাবনত থেকেছি সেসব সাধকের প্রতি, যাদের দীর্ঘকালের সাধনায় সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্যের জগৎ। ভালোবাসায় উন্মোচিত করার চেষ্টা করেছি নতুন প্রজন্মের চিন্তা ও ভাষার প্রকরণ। সর্বোপরি, স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি, সৎ ও অসৎ, সত্য ও অসত্যের মধ্যবর্তী অস্পষ্ট রেখাটি।’

ত্রয়ী স্ট্যাটাসের ব্যাকরণবিমুখ পর্বে তিন বাক্যের এই উদ্ধারকে যদি কেউ ত্রয়ীভাষ্য ভাবতে চান, ভাবতেই পারেন; যদিও তা কাকতালীয়। আমার আঁতুড়কথন থেকেও দুটি বাক্য উদ্ধার করি- ‘সবশেষে বলি- শস্যের পরিচর্যা ও হেমন্তের গানই ‘নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর’-এর মৌলকথা। বাকিটুকুু পড়তে পড়তে জেনে নেওয়াই উত্তম।’

‘Self praise is no recommendation’ ইংরেজি প্রবাদটি মনে রেখে বইটি সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন... নিজের লেখা চিঠিগুলো সরিয়ে রেখে শুধু মৃণাল বসুচৌধুরীর চিঠির আলোকে মূল্যায়ন করলেও অচিন্ত্যকুমার সেন গুপ্তের ‘কল্লোল যুগ’ অথবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লেখকের কথা’র পাশের আসনে বসার যোগ্যতা রাখে ‘নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর’। বইটি শঙ্খ ঘোষের ভালো লেগেছিল এবং মৃণাল বসু চৌধুরী ও আমাকে একসঙ্গে দেখলেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এঁকে জানতে চাইতেন, আমাদের মধ্যে ওইরকম চিঠি-চালাচালি আছে কি না। বইটি প্রসঙ্গে আরো একটি কথা না-বললেই নয়- বইয়ের প্রি-প্রেস সংশোধন-পরিমার্জনকালে ভাষাচিত্রর স্বপ্নবান কান্ডারি খন্দকার সোহেল দশটি বইয়ের সমান প্রাক-প্রকাশ নিষ্ঠা ও শ্রম দিয়েছিলেন।

এই পর্বের প্রথম উদ্ধার শঙ্খ ঘোষের ‘মৃত বন্ধুর জন্য’ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি। শেষ করছি, চিঠিতে আসা তার রত্নতুল্য কিছু কথা দিয়ে। একটি নতুন উদ্যোগের কথা জানিয়ে লেখা চিঠির প্রত্যুত্তরে পেয়েছিলাম সেই মহার্ঘ কথা। খন্দকার সোহেল, নাসিমার খান মন্টি ও আত্মজা অথই নীলিমার তিন নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে লেখা এক স্ট্যাটাসে রাখব ভেবে কপি করেও উপযুক্ত স্থানে পেস্ট করা হয়নি ভুলবশত। ওই তিনজনেরও মনোযোগ আকর্ষণ করে রত্নতুল্য মহার্ঘে শেষ করছি গ্রন্থে- শোকে ব্যাকরণ ‘মানি না’ পর্ব। একই সঙ্গে নটে গাছ মুড়াচ্ছি ত্রয়ী স্ট্যাটাসেরও-

‘এই কাজের মধ্য থেকে আপনাকে আরো অনেক ঘূরণির মধ্যে পড়তে হবে। সেটা অনিবার্য জানবেন। অযোগ্যের আস্ফালন, প্রচারলিপ্সুর আক্রমণ, উপকৃতের কৃতঘ্নতা : এই হয়তো প্রাপ্য হবে। এসব সহ্য করে থাকার শক্তি আপনার হোক, আশা করে থাকব এটাও।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close