reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২০ মে, ২০২২

বিবর্ণ শতাব্দীপ্রাচীন পাঠাগার

এই লাইব্রেরির সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম জড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। লাইব্রেরির বিভিন্ন অধিবেশন থেকে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা- সবকিছুতেই সক্রিয় থাকতেন তিনি

ঋগ্বেদ সংহিতা থেকে ব্রিটেনের ইতিহাস- সবই ঢেকেছে মাকড়সার জাল ও ধুলোর আস্তরণে। হলদে হয়ে যাওয়া ‘পথের দাবি’ এখন উইয়ের ঘরবাড়ি। ১০০ বছরেরও আগে ছাপা বইয়ের পাতায় পাতায় পোকায় কাটা নকশা। দশকের পর দশক হাত পড়েনি শেকসপিয়ারের বইয়ের গায়ে। অবস্থা এমনই যে, বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য বই ও পত্রিকার পাতা উল্টোতে গেলে ঝুরঝুরে হয়ে খসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে!

১৩৩ বছরের পুরোনো, রবীন্দ্র-স্মৃতিবিজড়িত চৈতন্য লাইব্রেরির বিপুল সম্ভারের বর্তমানে এমনই হতশ্রী দশা। ধুলো, উইয়ের আক্রমণ ছাড়াও কড়িকাঠ চুঁইয়ে পড়া জলে ক্রমশ নষ্ট হচ্ছে গ্রন্থাগারের লক্ষাধিক বাংলা বই, প্রায় ২০ হাজার ইংরেজি বই, ৩০ হাজার পুরোনো পত্রপত্রিকা। কোভিড পরিস্থিতি অবস্থাকে আরো কঠিন করেছে। অথচ আজও পাঠাগারটির সদস্য হতে খরচ মাত্র পাঁচ টাকা! তাই বই বাঁচাতে এবার বইপ্রেমীদের কাছে অর্থ সাহায্যের আর্জি জানিয়েছে ভারতের বিডন স্ট্রিটের চৈতন্য লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ।

১৮৮৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, সরস্বতী পূজার দিনে গৌরহরি সেন, কুঞ্জবিহারী দত্তের উদ্যোগে এবং গঙ্গানারায়ণ দত্তের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়েছিল এই গ্রন্থাগার। তখন দু’আনায় সদস্যপদ ও ১০ টাকায় আজীবন সদস্যপদ মিলত। শহরের প্রথম কয়েকটি গ্রন্থাগারের মধ্যে অন্যতম এই চৈতন্য লাইব্রেরির সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম জড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। লাইব্রেরির বিভিন্ন অধিবেশন থেকে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা- সবকিছুতেই সক্রিয় থাকতেন তিনি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পাদরি রেভারেন্ড অ্যালেক্স টমরি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, সি ভি রমন- বিভিন্ন সময়ে বহু মনীষীর ছোঁয়ায় ঋদ্ধ হয়েছে এই পাঠাগার।

২৮৪ জন সদস্যকে (৬ জন নারী) নিয়ে যার পথচলা শুরু, আজ সেই গ্রন্থাগারের সদস্য সংখ্যা খাতায়-কলমে ৫০০ হলেও সক্রিয় সদস্য ৫০-৫৫ জন। আজও লাইব্রেরিতে থরে থরে সাজানো উপন্যাস, সাহিত্য, শিশুসাহিত্য, ইতিহাস, ধর্মীয়, ভ্রমণ-সংক্রান্ত বই ও প্রাচীন পত্রপত্রিকা। অথচ সংরক্ষণের অভাব ও পাঠকশূন্য হওয়ায় তিলে তিলে নষ্ট হচ্ছে পুরোনো বইয়ের বিপুল সম্ভার।

লাইব্রেরির সম্পাদক প্রবীর মণ্ডল, বিশ্বনাথ গঙ্গোপাধ্যায়েরা বলেন, ‘কোভিডে ২০২০ থেকে লাইব্রেরি বন্ধ। সদস্যদের যাতায়াতও কমেছে। গবেষকরা যোগাযোগ করলেও সেই সময়ে লাইব্রেরি খুলে দিতে পারিনি। নতুন প্রজন্মের কাছে বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা এবং বই পড়ার সময়ও কমেছে। এর ফলে ক্রমশ আকর্ষণ হারাচ্ছে লাইব্রেরি।’

সেই সঙ্গে রয়েছে ভবনটির সংস্কারের অভাব। ষাটের দশকে মিনার্ভা থিয়েটারের পাশের বিশাল এই বাড়িতে উঠে এসেছিল পাঠাগারটি। কিন্তু সংস্কারের অভাবে সেই বাড়ির দেয়াল ফাটিয়ে ঘরে ঢুকছে বটের শিকড়, আমপানে ভেঙে পড়েছে তেতলার বারান্দা। ছাদ ফেটে জল চুঁইয়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে প্রাচীন বই। বছর কয়েক আগে ভবনের একাংশ মেরামতের সময়ে মিস্ত্রিদের অনভিজ্ঞতার খেসারত দিয়েছে বহু বই। ষাটের দশক থেকে এই লাইব্রেরির পাঠক, বর্তমানে সহসভাপতি অনিমেষ বসাক মনেই করতে পারছেন না, পোকা মারতে লাইব্রেরিতে শেষ কবে ‘পেস্ট কন্ট্রোল’কে ডাকা হয়েছিল।

অপর সহসভাপতি শঙ্কর সরকার জানান, বই বা আসবাব কিনতে সরকারি অনুদান আগে মিলেছে বটে, তবে ভবন সংস্কার বা বই সংরক্ষণের বিপুল খরচ আটকে রয়েছে অর্থাভাবের বেড়াজালেই। তিনি বলেন, ‘বই-আসবাব, পড়ার জায়গা সবই আছে। আছে কম্পিউটারও, কিন্তু সেটা চালাবে কে? বইয়ের ডিজিটাইজেশন করার প্রচেষ্টাও আটকে। লাইব্রেরির দৈনিক খরচের টাকা জোগাড় করাটাই এখন দায়।’

লাইব্রেরির একতলায় ফুটপাতবাসী শিশু ও যৌনকর্মীদের সন্তানদের ক্লাস নেয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। বাকি ফাঁকা অংশে গ্যালারি করে আয়ের পথ তৈরির প্রস্তাব এসেছে কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু তা এখনো ভাবনার স্তরেই। প্রবীর বাবু তাই বলেন, ‘যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইনফরমেশন সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলা গেলে তবেই লাইব্রেরিকে বাঁচানো সম্ভব। সেই সঙ্গে প্রয়োজন বইয়ের ডিজিটাইজেশন। দেশি-বিদেশি অনেক প্রাচীন বই এখানে আছে, যা আর ছাপা হয় না, অন্য লাইব্রেরিতেও মেলে না। প্রকাশকের কাছেও সেই বই আর নেই। রত্নগর্ভা, অথচ ধুঁকতে থাকা এই গ্রন্থাগারকে বাঁচাতে তাই বইপ্রেমীদের পাশে চাই।’

তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close