এনাম রাজু

  ২০ মে, ২০২২

কবিতার কথকতা

কবিতা কথা বলে জীবনের। কেননা যাপিত জীবনের নানান গল্পের প্রতিফলিত রূপই যে কবিতা। এ কারণেই কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় সুখণ্ডশান্তি, ভালোবাসার ছোঁয়ামাখা চিত্রমুখ। কবিতা যে শুধু সুখণ্ডশান্তি, ভালোবাসার কথা বলে তা কিন্তু নয়। কবির একটু অসতর্কতাও সমাজের শরীরে ফুঁড়ে দিতে পারে বিষদাঁত। ফলে সেই কবি ও তার কবিতা অঘোষিতভাবেই আড়ালে ঢাকা পড়ে। সেই ইতিহাসও কম না। এজন্যই অনেকের প্রশ্ন, কবিতা লেখা কি সহজ সোজা নাকি সত্যি আরাধনা বা ধ্যানের? তবে কবিতায় যে দর্শনের চিহ্ন কবি আঁকেন, সেটা বোধকরি সুচিন্তা করেই আঁকেন। কিন্তু কখনো কখনো সময়ের করাল থাবায় ভিন্ন দৃষ্টির সৃষ্টি করে। সে যাই হোক, কবিতা নিয়ে নানান প্রশ্ন রয়েছে সৃষ্টিকাল থেকেই। হয়তো থাকবেও। তবে সম্প্রতি প্রায় পাঠকই অভিযোগ করেন, আজকাল আধুনিকতার নাম করে লেখা কবিতাগুলো তারা বোঝেন না। অনেক কবিও একই অভিযোগের তীর ছোড়েন।

আসলেই কবিতা নিয়ে অভিযোগটা নতুন নয়। বহু পুরাতন। পঞ্চাশের দশকে কবি বুদ্ধদেব বসুও একই অভিযোগ করেছেন। তিনি তো এ বিষয়ে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে চিঠিও লিখেছেন। নতুন কবিদের কবিতা বুঝতে না পারার কারণে তিনি ‘কবিতা’ পত্রিকা বন্ধ করারও কথা জানিয়েছিলেন। এর কারণ হিসেবে অনেকেই গদ্য কবিতাকে দোষারোপ করে থাকেন। অনেকেই আবার অন্ত্যমিলহীন কবিতাকে কবিতাই মনে করেন না। তবে সাধারণ পাঠকের অনেকেই এখনো জানে না যে, অন্ত্যমিল আর ছন্দ এক বিষয় নয়। এই কারণে অন্ত্যমিলকেও অনেকেই ছন্দ বলে গুলিয়ে ফেলেন। ফলে অন্ত্যমিলহীন কবিতাকে অকবিতা হিসেবে মন্তব্য করে থাকেন।

আসলেই কি গদ্য কবিতার কারণেই কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে? আধুনিকতার নাম করে লেখা গদ্য কবিতাই কি কবিতাকে দুরূহ করছে? এর সহজ অর্থ দাঁড়াবে না। কারণ গদ্য কবিতা মানেই কঠিন শব্দের, কঠিন বাক্যের, গল্পহীন কোনো কবিতা নয়। তাহলে গদ্য কবিতা কী? এর উত্তর খুবই সহজ। গদ্যের মাধ্যমে কবিতার প্রকৃত রস উপস্থাপন করা। এটাও বলা যেতে পারে, কবিতার কৃত্রিম বিন্যাস পদ্ধতিকে বর্জন করা। তাহলে যা দাঁড়াল তা হলো, গদ্য কবিতা কঠিন কোনো কবিতা হওয়ার কথা নয়। বরং কবিতার যে কৃত্রিম কিছু নিয়ম, সেই নিয়মের জাল থেকে সামান্য সরে আসা। আর এ সময়ের কবিদের কবিতাই যে গদ্য কবিতা হওয়ার কারণে পাঠোদ্ধার করা যাচ্ছে না, সেটাও কিছুটা উড়ো কথা। কেননা বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম গদ্য কবিতা লিখেছেন। গীতাঞ্জলি অনুবাদকালেই তার গদ্য কবিতা বিষয়ে ভাবনা আসে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মনে পড়ে একবার শ্রীমান সত্যেন্দ্রকে বলেছিলুম, ‘ছন্দের রাজা তুমি, অ-ছন্দের শক্তিতে কাব্যের স্রোতকে তার বাঁধ ভেঙে প্রবাহিত করো দেখি। সত্যেনের মতো বিচিত্র ছন্দের স্রষ্টা বাংলায় খুব কমই আছে। হয়তো অভ্যাস তার পথে বাধা দিয়েছিল, তাই তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। আমি স্বয়ং এই কাব্য রচনার চেষ্টা করেছিলুম লিপিকার অবশ্য পদ্যের মতো পদ ভেঙে দেখাইনি। লিপিকা লেখার পর বহুদিন আর গদ্যকাব্য লিখিনি। বোধকরি সাহস হয়নি বলেই।’ (সূত্র : ছন্দ/২৩৫ পৃষ্ঠা)। রবীন্দ্রনাথ পরে পুনশ্চ, শ্যামলী, পত্রপুট, শেষ সপ্তক প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থেও গদ্য কবিতা লক্ষ করা যায়। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে সাধারণ পাঠক কেন কবিতার মূল অর্থ বুঝতে পারছে না? এর কারণ সম্ভবত গদ্য কবিতার নামে শব্দের স্তূপ তৈরি করে সাহিত্যের পাতাগুলো ভরাট করা। যে লেখাটি হতে পারত একটা সুন্দর অণুগল্প, যে লেখাটি হতে পারত একটা সুন্দর রংমাখা প্রবন্ধ কিংবা যে লেখাটি হওয়ার কথা চিঠি। কিন্তু সেই লেখা গল্পটি যখন কবিতা হয়ে যায়, তখনই পাঠক অণুগল্প ও কবিতার পার্থক্য নির্ণয় করতে ভুল করেন। যে লেখাটি একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ হওয়ার কথা, যে লেখাটির প্রতিটি বাক্যে আধ্যাত্মিকতার ছাপ স্পষ্ট, তাকে কবিতার কাতারে দাঁড় করিয়ে বলা হয় কবিতা। অন্যদিকে কবিতায় যোগ হচ্ছে না স্মরণীয় লাইন বা বাণী। এর কারণ আপনি একটি গল্পধর্মী লেখায়, একটি প্রবন্ধের সুঘ্রাণ বয়ে যাওয়া লেখায় কাব্যিকতাযুক্ত স্মরণীয় লাইন কীভাবে যোগ করবেন। আর এসব লেখার নাম দেওয়া হচ্ছে গদ্য কবিতা। অন্যদিকে এসব লেখা ধীরে ধীরে যখন তথাকথিত লেখক শ্রেণির দ্বারা খামের বিনিময়ে বা সম্পর্কের খাতিরে কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মনে হয়, তখন থেকেই কবিতার ব্যাকরণ বাক্সবন্দি। ফলে গদ্য কবিতারও যে একটা ছন্দের খেলা থাকে, তাও মনে থাকে না তথাকথিত কবিতাকারদের।

মূলত কবিতার চলমান যে গতি, ছন্দ-যতি, মিল-অমিল তা একশ্রেণির হঠাৎ কবির হাতে পড়ে দলিত-মথিত হয়ে গাঁটের পয়সায় বই আকারে বেরিয়ে মুদ্রিত ডাস্টবিন উপচে ফেলছে। এদের কেউ কেউ আবার তথাকথিত লিটলম্যাগ আন্দোলনের রতি-মহারতি হয়ে ব্রিজ তৈরি করেন দৈনিকের সাহিত্য পাতায় প্রবেশের। তাদের মুখে থাকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আগুন আর জিহ্বায় থাকে প্রতিষ্ঠানের পদধূলি চাটার বিশেষ গুণ। এরা বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন দেশি-বিদেশি তথ্য ভা-ারের নামণ্ডসূত্র মুখস্থ করে। তারা ভুলে যান, বাংলা কবিতা পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে যাদের সোনার মহরের ঝিলিকে তাদের নাম মাথা মোটা এসব নবিশ নবীন-প্রবীণ মাথাজীবীরা স্বর্ণপ্রসূত কবিদের পল্লীকবি বলে অবজ্ঞার ধৃষ্টতা দেখায়। অথচ তারা ভালো করেই জানেন, সার্টিফিকেটমুক্ত লালন-হাসন-রবীন্দ্র-নজরুল এবং আল মাহমুদ বাংলা ভাষার বৈশ্বিক নেতৃত্বদানকারী স্বজন ও সুজন।

কবিতার দুর্বোধ্যতা কি করে বাংলা ভাষার কবিতায় এলো? এজন্য কে বা কারা দায়ী? এক কথায় উত্তর দেওয়া যায়, যখন থেকে কবিতাকে কোঠাওয়ারি-দশকওয়ারি বিভাজকরা কবিতার মুক্তমঞ্চে জেঁকে বসেছে এবং যারা বাংলা ভাষায় ইংরেজি-ফরাসি কবিতার আমদানি করেছেন। আর যারা নিরীশ্বরবাদ দর্শন ঢুকিয়ে দিয়েছেন সবুজ-শ্যামল আস্থাভাজন বাংলাদেশের বাংলা ভাষায়। তাদের পূর্বসূরিদের হাতেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপিত হয়েছে। বঙ্কিমগ্রীবা বাঁকিয়ে তারাই আবার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন মাঠে-মঞ্চে। বিশেষ করে ত্রিশের দশকের দু-একজনকে বাদ দিলে দুর্বোধ্যতা ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না আমার সংক্ষিপ্ত কবিতার দুরবিনে। তবু তারাই মনে করতেন, কবিতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় পাণ্ডিত্যে-মেধায়-বিদেশি থিওরিজারিত চর্চায়।

পরচর্চায় আর যাই হোক, সৌন্দর্য হয় না। থাকে না সত্য প্রেম পবিত্রতাও। যেগুলো বাংলা কবিতার প্রাণ, বিশ্বকবিতারও। পর্তুগিজ দস্যুদের মিথ্যে নয়। কোহিনুর, মুক্তা চোর বুদ্ধিজীবীদের তথ্যে নয়। ধান-নদী-খালের মাছের ঝিলিকের কাছে খুঁজতে হবে বাংলা কবিতার নান্দনিক দিক, যা হবে সহজিয়া নদীর মতো, বাউল কোকিলের মতো, প্রতিবাদী কাকের মতো, সকালবেলার পাখির মতো সুন্দর শাশ্বত। যার ভেতরে থাকবে মিলের মতো টান, থাকবে না ডেমোক্রেসিময় পলিটিকস বরং থাকবে দেশজ ধর্মণ্ডকৃষি ও কৃষ্টিসমাচার। থাকবে প্রজাপতির রং, ফুলের সুবা, শিশির পতাকার গোপন আলোড়ন। অর্থাৎ কবিতাকে গতির কাছে ছন্দময়তার কাছে, রূপক-উপমার কাছে বিশ্বাসের বিভূতির কাছে ফিরে আসতে হবে। সেই সঙ্গে দাঁড়াতে হবে একপায়ে বাংলার তালগাছের মতো। হাঁটতে হবে দোপায়া প্রাণীর মতো, চার পায়া পশুর মতো পাশবিকতার বিরুদ্ধে। দেখতে হবে স্বপ্ন, ভাঙাতে হবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘুম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close