সাদিক আল আমিন

  ০৬ মে, ২০২২

ফ্রিদা কাহলো

আত্মপ্রতিকৃতির বিষন্ন শিল্পী

বিংশ শতাব্দীর শুরুকালে পোস্টকলোনিজমের যুগে এবং প্রবল রেসিজমের সময়ে সদ্যউদিত মেক্সিকোতে যে কজন চিত্রশিল্পী সাহস দেখিয়ে সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে তুলি দিয়ে প্রতিবাদ করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে ফ্রিদা কাহলো অন্যতম। ফ্রিদার পুরো নাম মাগদালেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ই ক্যালদেরোন। ১৯২৯ সালে নিজের বয়সের প্রায় দ্বিগুণ বয়সি দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফ্রিদা। যদিও বিবাহ-পরবর্তী দুজনেরই কিছু অনৈতিক সম্পর্কের কারণে ১০ বছরের বেশি তাদের সংসার জীবন টেকেনি, তবু তাদের জুটি ছিল সে-সময়ের সেরা। দিয়েগো ছিলেন তৎকালীন মেক্সিকোর নামকরা পেইন্টার। অন্যদিকে ফ্রিদা নতুন চিত্রশিল্পের পাইওনিয়ার। ফ্রিদা মূলত তার নিজস্ব প্রতিকৃতিগুলোর জন্য বিখ্যাত। তার মতো করে হয়তো কোনো শিল্পী এত নিখুঁতভাবে নিজেকে আঁকতে পারেননি। 

ফ্রিদার বাবার নাম ছিল গুইলেরমো কাহলো এবং তিনি একজন জার্মান-মেক্সিকান ফটোগ্রাফার ছিলেন। তার দুই মেয়ের আরেকজনের নাম ক্রিস্টিনা কাহলো, যার ছবিও পরে ফ্রিদা এঁকেছিলেন এবং নাম দিয়েছিলেন ‘পোরট্রেইট অফ ক্রিস্টিনা, মাই সিস্টার’। দিয়েগো রিভেরাও অবশ্য ক্রিস্টিনার ছবি এঁকেছিলেন। দিয়েগোর সঙ্গে ক্রিস্টিনার একটি অনৈতিক সম্পর্কও ছিল, যা দিয়েগোকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসা ফ্রিদা কখনো মেনে দিতে পারেননি। দুঃখ, অভিমান, ক্ষোভ তিনি তুলি আর ক্যানভাসে এনে রাঙান। ‘মেমোরি, দ্য হার্ট’ চিত্রটি ফ্রিদার তখনই আঁকা।

১৮ বছর বয়সের আশপাশে ফ্রিদা একটি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। দীর্ঘ সময়ের জন্য তার শরীরের নিচের অংশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। শুয়ে শুয়েই বুকের ওপর একটি ছোট টেবিল রেখে ফ্রিদা আঁকতেন। সে সময়ে ফ্রিদা প্রচণ্ড অমানুষিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার মেরুরজ্জুতে একটা বড় ধরনের সার্জারি হয়, যার প্রতিবিম্বস্বরূপ ফ্রিদা ‘দ্য ব্রোকেন কলাম’ চিত্রটি এঁকেছিলেন।

বলে রাখা ভালো, ফ্রিদা নিজের যে সেল্ফ পোরট্রেইটগুলো এঁকে গেছেন, সেগুলোর মানের দিক থেকে খুব কম চিত্রশিল্পীই এগোতে পেরেছেন। তার সব কাজে একটা চাপা বিষাদ লুকিয়ে থাকে। ফ্রিদা তার চিত্রে নিজে যেমন, তার অধিক রঞ্জিত করে কিংবা ঈষৎ মলিন করেও কখনো নিজেকে উপস্থাপন করেননি নিজের প্রকৃত প্রতিকৃতি ছাড়া। এ সম্পর্কে বিখ্যাত অ্যাকাডেমিক স্কলার নাতাশা স্টিড বলেন, ‘ফ্রিদার পেইন্টিংগুলো ছিল দারুণভাবে সৎ এবং ফ্রিদা কখনো নিজের থেকে অধিক রঞ্জিত করে কিছু আঁকেননি, যেটা তিনি আদতে ছিলেন।’

ফ্রিদা কাহলো তার ব্যক্তিজীবনে অনেক চিত্রের রূপরেখা টানলেও, অনেক সমৃদ্ধ শিল্প পৃথিবীকে উপহার দিলেও, তার একটি কাজকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করা হয়। তা হলো, ‘হোয়াট দ্য ওয়াটার গেভ মি’। এই চিত্রের মাধ্যমে ফ্রিদা তার সমগ্র জীবন ও স্মৃতিকে ক্যানভাসবন্দি করেছেন।

ফ্রিদা কাহলোর কাজে মেক্সিকোর সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বেশ গুরুত্ব পেয়েছে, যার কারণে তার চিত্রকর্ম কখনো কখনো অর্বাচীন শিল্প বা লোকশিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার কাজকে পরাবাস্তববাদের অন্তর্গতও করা হয়েছে এবং ১৯৩৮ সালে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের প্রধান আঁদ্রে ব্রেটন, ফ্রিদার কাজকে ‘রিবন অ্যারাউন্ড এ বোম্ব’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ফ্রিদা ব্রেটনের দেওয়া পরাবাস্তববাদী আখ্যা অস্বীকার করেন। কেননা, তার মতে, তার চিত্রকর্মে পরাবাস্তবের চেয়ে তার বাস্তব অবস্থার প্রতিফলনই প্রবল। 

কাহলো তার জীবদ্দশায় কতটি চিত্রকর্ম করেছিলেন, তার সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যার পরিসংখ্যান ১৫০ থেকে ২০০-এর মধ্যে রয়েছে। তার প্রথম দিকের চিত্রকর্মগুলো, যা তিনি ১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৈরি করেছিলেন, সেগুলো রেনেসাঁ মাস্টার্স এবং ইউরোপীয় অ্যাভান্ট-গার্ড শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত। ফ্রিদা তার ছবির ধরনগুলো পরাবাস্তববাদ, সেখান থেকে উপাদানগুলোকে বাস্তবতার সঙ্গে মিশিয়ে ছবির মাধ্যমে বিকশিত করেছিলেন এবং প্রায়ই ব্যথা এবং মৃত্যুকে চিত্রিত করেছিলেন। 

১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই আনুমানিক ৬টায় ব্যক্তিগত নার্স ফ্রিদাকে বিছানায় মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করেন। কাহলোর ওষুধের ব্যবহার নিরীক্ষণ করে নার্স বলেছিলেন, কাহলো মারা যাওয়ার রাতে মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ গ্রহণ করেছিলেন।

সুনাম, খ্যাতির মধ্য দিয়েও ফ্রিদা কাহলো নিঃসঙ্গ একাকী পাখিটার মতো চলে যান, বেছে নেন আত্মহননের পথ। তবে তার চিত্রকর্মগুলো পরে ব্যাপক বিশ্লেষণ ও গবেষণার দাবি সৃষ্টি করে, এমনকি করে চলেছে এখনো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close