জুয়েল আশরাফ

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২২

গল্প

নক্ষত্রের মতো দূরে

আজকাল মিলহানের কী হয়েছে, সারা রাত জেগে ওপরে আকাশে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চুপি চুপি রাস্তায় বেরিয়ে যায় নিশুতি অন্ধকারে। শূন্য মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টি শুরু হয়, বাজ পড়ে, তার ভ্রুক্ষেপ হয় না। বোধ নষ্ট হয়ে গেছে, মগজটা বেবাক ফাঁকা। গোসল করে না, জামা-প্যান্ট বদলায় না, চুলে জট, সারা মুখে কুটকুটে দাড়ি, গায়ে চিট ময়লা। সারা দিন ঘুরে জঙ্গলে-মঙ্গলে, ঘাটে-অঘাটে। শুধু যখন প্রচণ্ড খিদেয় শরীর গুলায়, বাড়ি ফিরে সুন্দরীকে বলে, সুন্দরী! পেটে খিদে এত লাগে ক্যান? মনে হয় মাটি কামড়ে খাই।

সুন্দরী যেন তার বুকে মাথা কুটে কুটে কাঁদে, বলে, মিলহান, তোমার কী কষ্ট আমাকে বলো!

মিলহান নিরুত্তাপ গলায় বলে, কষ্ট নেই তো!

তবে হঠাৎ কী হলো, এত ভালো মাথা তোমার...! এমন করছো কেন?

মিলহান বিড়বিড় করে বলে, সুন্দরী, আমার কোনো কষ্ট নেই- এটাই আমার কষ্ট, জানো? আমি খুব তীব্রভাবে কষ্ট পেতে চাই, এফোঁড়-ওফোঁড় কষ্ট... কিন্তু পাচ্ছি না কিছুতেই, বুঝলে?

সুন্দরী কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে। এক পেট খেয়ে মিলহান সন্ধ্যার মাঠে এসে দেখে কেউ কোথাও নেই। মিলহানের বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে এলো। মনটা বিষাদে ভরে গেল। খোলা মাঠ থেকে সোজা বাড়ি ফেরার পথ ধরল। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে ফিরে তাকাল। দেখল তার সুন্দরী, খেতের আল ধরে তারস্বরে ডাকতে ডাকতে ছুটে পালাচ্ছে।

বিড়ালটা সারাটা দিন প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। সে যখন বাড়ি থেকে বেরোয়, তখন সেই বিড়ালটাও তার সঙ্গে হেঁটে চলে। সে খোলা আকাশের নিচে এলে সেও ঘাসমাটিতে শুয়ে থাকে। যখন সে অধিক রাতে বেরিয়ে যায়, বিড়ালটা তার পেছন পেছন অনেকটা দূর চলে আসে। মিলহান তার গলায় হাত বুলিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি ফিরে আসব, এবার বাড়ি যাও।

বিড়ালটা খুব বাধ্য সন্তানের মতো বাড়ি ফিরে আসে। এই বিড়াল নিয়েই মিলহানের সংসার। বিড়াল নাহলে তার এক মুহূর্ত চলে না। এই বিড়ালটা তার সংসারে একমাত্র জীবিত প্রাণী। অবসরে এই বিড়ালটার সঙ্গেই কথা বলে সময় কাটে মিলহানের।

এই বিড়ালটা আসলে ছিল সাবেরার। খুব ছোট একটা ছানাকে বড় করে তুলেছিল সাবেরা। নাম দিয়েছিল সুন্দরী। বাড়ি থেকে সঙ্গে করে সুন্দরীকে এনেছিল। তারপর এক দিন সাবেরা চলে গেল। শুধু সুন্দরীই তার পাশে রয়ে গেল।

রাতে সমস্ত জগৎ যখন নিস্তব্ধ হয়ে আসে, আকাশের নক্ষত্রগুলো জ্বলজ্বল করে, তখন সাবেরার কথা খুব মনে পড়ে মিলহানের। আর ঠিক তখনই সুন্দরী মিলহানের খুব কাছে সরে আসে, ওর শরীর থেকে ওম নেওয়ার চেষ্টা করে। বাইরে বাতাসে মাঝরাতে হিম ধরে গায়ে।

মিলহানের বিছানার ঠিক পাশে, একটা চটের বস্তার ওপর শুয়ে থাকে সুন্দরী। সাবেরার কথা ভাবতে ভাবতে বিড়ালটার গায়ে হাত বুলায় মিলহান। আর মনে মনে ভাবে এক দিন সাবেরা বিড়ালটাকে এ রকমভাবেই আদর করত। এর গায়ে সাবেরার হাতের ছোঁয়া আছে। সাবেরা তাকে ছেড়ে চলে গেছে বহুকাল, কিন্তু সুন্দরী সাবেরাকে মিলহানের অন্তরে বাঁচিয়ে রেখেছে।

একটা শেয়াল সুন্দরীকে শিকার করার জন্য ছুটছে। দেখে মিলহানের বুক শুকিয়ে গেল। সর্বনাশ!

কিছুদিন ধরে শিয়ালের উৎপাত মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। গত কয়েক মাসে অনেক প্রাণী খেয়েছে। এলাকার কিছু ছেলেপুলে আছে, প্রতিশোধ নিতে শিয়াল ধরে জবেহ করে খেয়ে ফেলে। শোনা মাত্রই বমি করেছিল মিলহান। খাবারের এমন রুচির মানুষও এই গ্রামে থাকে! তবে শিয়াল উৎপাত কিছু কমে এসেছিল এরপর থেকে।

মিলহান দেখল, শিয়ালটা সুন্দরীর খুব কাছে এসে গেছে। সে একটা ইট নিয়ে শিয়ালটার দিকে তাক করে সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়ে মারল। খেতে না পেয়ে এলাকার শিয়ালগুলো হিংস্র হয়ে উঠছে। ইটটা তার গায়ে না লাগলেও ঠিক তার পাশে গাছের গায়ে সশব্দে আঘাত করল। শিয়ালটা ওর ওপর হামলা হচ্ছে বুঝতে পেরে শিকার ছেড়ে পালিয়ে গেল।

মিলহান চিৎকার করে ডাকল, সুন্দরী!

সুন্দরী মনিবের গলা শুনে মিঁয়াও-মিঁয়াও করতে করতে তার দিকে ছুটে চলে এলো। সুন্দরীর জন্য কিছু খাবার আনা ছিল। মিলহান খাবারগুলো সুন্দরীর চোখের সামনে দৃশ্যমান করে বাড়ির পথে রওনা দিল। পেছন পেছন সুন্দরীও আসতে লাগল ছুটতে ছুটতে।

রাত প্রায় দেড়টা। নতুন পাকাবাড়ি বানানোর পর থেকেই দরজায় তালা দিয়ে উঠানে চাটাই পেতে শুয়ে পড়ে মিলহান। নতুন ঘরটি শুধু সাবেরার জন্য। সাবেরা যেদিন আসবে সেদিনই ঘরের ভেতরে ঘুমাবে মিলহান। পাশে সুন্দরী চোখ বুজে রেখেছে। ওপরে আকাশ, কাছাকাছি নক্ষত্রের বাগান। হাত বাড়ালেই যেন স্পর্শ করতে পারবে, নক্ষত্রের এত কাছে থাকে সে! সুন্দরী বোধহয় একবার জিজ্ঞেস করেছিল, সারাদিন কী ভাবো? আকাশে তাকিয়ে? এত কী ভাবার থাকতে পারে একটা লোকের!

মিলহান উত্তর দেয় না, শুধু হেসেছিল। বোঝো! সুন্দরী বলে কি না, এত কী ভাবার! এরা সব বোবা প্রাণী। এদের বোঝানো যাবে না। ভাবার জিনিসের কি শেষ আছে? শুধু সাবেরাকে ভেবেই তো গোটা দিন কাটিয়ে দিতে পারে মিলহান।

সাবেরা, তার বউ। যে ছেড়ে গেছে তাকে। ‘গেছে’ শব্দটা অবশ্য মিলহান ভাবতে পছন্দ করে না। ‘আসবে’ এ কথাটাই বেশি জরুরি। কাল নয় পরশু, নয়তো তরশু- সাবেরা ফিরে আসবে আবার তার কাছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে সে।

ফিরে এসে প্রতি মাসে চুল কাটতে পাঠাবে তাকে সাবেরা, দুদিনের বেশি তিন দিন হলেই দাড়ি কাটানোর জন্য ঝোলাঝুলি করবে। তার জামাকাপড় ধবধবে করে ধুয়ে দেবে, ইস্ত্রি করে দেবে। ফিটফাট করে খেতের কাজে পাঠাবে। স্টিলের টিফিন বক্সে ভরে দেবে গরম ভাত আর আলুভর্তা, সঙ্গে তরকারি। সাবেরার মতো করে রান্না আর কাউকে করতে দেখেনি। খুব স্বাদ, সেই রকম তার পছন্দ। এক দিন সে একটা ধানিজমিতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করছিল, সাবেরা তার জন্য টিফিন গুছিয়ে ভরে এনেছিল। ধানখেতের আইলে বসে খেয়েছিল। সেই একবারই, সেই স্মৃতি অক্ষয় হয়ে আছে।

এখন সে খেতের কামকাজে ৩০ টাকার মুড়ি-ছোলা কিনে খায়। সাবেরা ফিরে এসে আবার সব সাজিয়ে-গুছিয়ে দেবে, বলে গেছে। ওর মতো কেউ জানে না, তার পছন্দ-অপছন্দ। তার সঙ্গে চার দিন সংসার করেছিল সাবেরা। হ্যাঁ, মাত্র চার দিন। সেও কত বছর আগে! তাতেই সে টের পেয়েছে, কী লক্ষ্মী একটা মেয়ে আর গোছানো বউ সাবেরা।

সাবেরা ফিরলেই সব বদলে যাবে। শুধু একবার সাবেরাকে খবরটুকু দেওয়া যে, সে নতুন ঘর বানিয়েছে! তা হলেই, ব্যস!

কিন্তু, সাবেরাকে খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই। এই গ্রাম ছেড়ে তার পরিবার তো সেই কবে চলে গেছে। তখন সে অন্যের জমিতে চাষবাস করে খায়, সারাদিনের খেটে ক্লান্তি শরীরে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরে। টিনের তৈরি একটি ঘরে থাকে। সাবেরার বাবা যখন অটো রিকশা ডেকে ব্যাগ তুলছিল, সে ধানখেতের ওপাশে হিজলগাছের আড়াল থেকে দেখছিল। খুব ইচ্ছে করছিল একবার জিজ্ঞেস করে, চাচা, নতুন বাসার ঠিকানাটা অন্তত...।

না, জিজ্ঞেস করতে সাহস হয়নি। কয়েক মাস আগেই তো পাড়ার মাস্তান ছেলেদের দিয়ে সালিসি ডাকিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বারের সামনে ফায়সালা হয়েছিল- ভবিষ্যতে কখনো সাবেরাকে বা তার পরিবারের সঙ্গে সামান্যতম যোগাযোগের চেষ্টাও করতে পারবে না সে! করলেই পাড়াছাড়া হতে হবে, সুন্দরী বিড়ালসমেত! সাবেরাকে তার বউ বলে মানেইনি তারা কেউ। সেসব নাকি নিছক ছেলেমানুষির ঝোঁক...।

সালিসি সভার পেছনে অনেক টাকা ঢেলেছিল সাবেরার বাবা, জানত। তবু সে সেখানে একেবারে চুপ করে থাকেনি। মরিয়া হয়ে বলেছিল, কিন্তু সাবেরা তো স্বেচ্ছায় চলে এসেছিল আমার কাছে...। চার চারটা রাত...।

মাস্তান ছোকরাদের লাল-চোখ মাতব্বররা হুংকার দিয়ে থামিয়েছিল তাকে। ঘোষণা করেছিল, নিছক বন্ধু হিসেবেই তার বাসায় গিয়েছিল সাবেরা, থেকে ছিল দিনকয়েক, সমবয়সি বন্ধু যেমন বেড়াতে যায়! তার বেশি কিচ্ছু ঘটেনি। সে নিজেই নাকি বলেছে তেমনটা। কোনো সইসাবুদ হয়নি। সে জানিয়েছে, চার দিন সে ঘুমিয়েছে আলাদা বিছানা পেতে! এর বেশি কিছু রটালে বা দাবি করলে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হবে তার।

মিলহান ভয়ে চুপ করে গিয়েছিল। সইসাবুদের মাধ্যমেই তাদের বিয়ে হয়েছে। সাবেরা যে নিজের মুখে তাকে বলেছিল, সে তার বউ! তার চেয়ে বড় কথা দুনিয়ায় কী থাকতে পারে! কলেজপড়–য়া সাবেরা যে নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে এসে সেই চার চারটা দিন যেচে তার বউ হয়েছিল, তার প্রমাণ হবে শোওয়া-শুয়ির বিচারে? ছি ছি!

কিন্তু, মিলহান বলতে পারেনি কিচ্ছু। সেই চারটি রাত যে তার ভাঙা ঘরে জোছনা ছড়িয়ে গিয়েছিল সেই মেয়ে- সঙ্গে সাক্ষী ছিল সুন্দরী বিড়াল। সাবেরা রীতিমতো রান্নাবাড়া করে ঝাঁটপাট দিয়ে তার গরিব সংসারে বধূজীবন-যাপন করেছিল সেই চার দিন। এসব যুক্তি আর পেশ করতেই পারেনি। এমনকি, চার দিনের মাথায় সাবেরার বাবা যখন গাড়ি করে তাকে তার কাছ থেকে এক রকম জবরদস্তি উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তখনো সাবেরা তাকে বলেছিল, সে ফিরে আসবে! সে একটা ভালো ঘর করলেই... যেখানেই সে থাকুক, কেউ তাকে আটকে রাখতে পারবে না।

সেই শেষ দেখা। আর তাকে বেরোতে দেয়নি তার পরিবার। সালিসি বসিয়ে মিলহানকে শাসিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তার অগোচরেই তাকে পাঠিয়ে দেয় নতুন জায়গায়, তারপর নিজেরাও এ গ্রাম ছেড়ে চলে যায় কোথায়। ঠিকানা পাওয়া যায়নি আর।

গাড়িটাকে মিলহান দৌড়ে ফলো করেছিল অনেক দূর পর্যন্ত। কিন্তু তারা বড় রাস্তায় উঠে পড়ার পর সাঁ-সাঁ করে চলে গেল, নাগাল পেল না। তারপর থেকে কেবলই সাবেরাকে খুঁজে চলেছে মিলহান, চাকরি খোঁজার মতোই হন্যে হয়ে। উন্মাদের মতো খেটে, বছরের পর বছর ঝড়-বৃষ্টি-রোদে পুড়ে... টাকা জমিয়ে একটি সুন্দর পাকাবাড়ি তৈরি করেছে অবশেষে। সাবেরার জন্যই তো এই নতুন ঘরটি। এ ঘরে সাবেরা প্রবেশ না করা পর্যন্ত কোনো দিন মিলহান এই ঘরে ঘুমাবে না। এখন শুধু সেই খবরটা সাবেরাকে পাঠানো ভীষণ দরকার। ভীষণ!

জানতে পারলেই সাবেরা ফিরবে। সাবেরা ফিরলেই মিলহান আবার ভালো হয়ে যাবে। সুস্থ, স্বাভাবিক। অন্য সবার মতো। কাঁধে লাঙল ঝুলিয়ে, এক হাতে কাস্তে তারপর সাবেরাকে ডেকে মায়া মাখানো গলা নিয়ে বলবে, আমার খাবারটা দুপুরে খেতে গিয়ে দিয়ে এসো।

আহ্?, শুধু কবে যে...।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close