বই আলোচনা
প্রাঞ্জল ভাষায় জীবনের অনুষঙ্গ
বাংলা কবিতার নব্বই দশক পর্বের অন্যতম কবি আমিনুল ইসলাম। সময়ের পরিক্রমা ভেঙে ভেঙে নিজস্ব কাব্যবোধকে জাগ্রত রেখে বিনির্মাণ করে চলেছেন নিজের কবিসত্তাকে। সাম্প্রতিক সময়ে কবি আমিনুল ইসলাম ব্র্যান্ডিংয়ের মতো একটি সুপ্রতিষ্ঠিত কবিসত্তার পরিচায়ক হয়ে উঠেছেন। এরূপ একটি ব্র্যান্ডিংয়ের সঙ্গে পরিচয় বা তার কবিতা নামক উৎপাদিত গুণগত পণ্যের সঙ্গে পরিচয় থাকা যেকোনো পাঠকের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যের কিংবা আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে এমনটা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
বৈশ্বিক করোনাকালীন পরিস্থিতি সৃজনশীল মানুষকে ঘরবন্দি রাখলেও তার সৃজনকর্মকে দূরে সরাতে পারেনি। কবি আমিনুল ইসলামও পারেননি। বিরূপ পরিস্থিতিতেও তিনি রচনা করেছেন হিজলের সার্কিট হাউস কবিতাগ্রন্থ। গ্রন্থটিতে দুটি দীর্ঘ কবিতাসহ আটাশটি কবিতা মলাটবদ্ধ হয়েছে। গ্রন্থটি পাঠের মধ্য দিয়ে বিবেচনা করা যায়, কবি আমিনুল ইসলাম করোনাকালীন সাম্প্রতিক সময়কালকে শ্রেণি চরিত্রের মধ্য দিয়ে চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক অবস্থান, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্যে অনুসন্ধান, বাংলার সংস্কৃতির চিরায়ত লোকজ ভাবধারা-বাউলধারা, আঞ্চলিক ভাষা এবং ব্যক্তিগত জীবনবোধের নানামাত্রিক বিষয় কবিতার উপজীব্য হিসেবে নিয়েছেন। এসব অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে তিনি তার কবিতার ভাষা নির্মাণ করেছেন প্রাঞ্জল এবং গতিময়। প্রাঞ্জল-ভাষার ভেতর দিয়ে পাঠক সহজেই প্রবেশ করতে পারবেন আমিনুল ইসলামের কবিতায়। কটি পঙক্তি তুলে ধরা যেতে পারে-
১. আমি হাওর, সমুদ্রের বংশধর;/বঙ্গোপসাগরের দূরসম্পর্কের নাতনি;/বংশলতিকা দেখতে চাও? দেখতে পারো।/তবে আগাম বলে রাখি, কূল পাবে না!/তোমরাও জানো, সমুদ্রের কাহিনি অশেষ; (হিজলের সার্কিট হাউসে বসে শোনা)। ২. হে ব্রহ্মপুত্র, আমি ভাঙনের শব্দ শুনে/ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানুষ,/সিকস্তি ও পয়স্তি স্বভাবে এই আমারও/তাই আমি সমুদ্রের কাছ থেকে/ভুল করেও কোনোদিন/চারিত্রিক সনদপত্র আনতে যাইনি; (একদিন সারাদিন ব্রহ্মপুত্র)
কবিতার ঐতিহ্য-পরম্পরার অনুসন্ধানী অভিব্যক্তির প্রয়াস থেকেও অনুমান করা যায় কবির অন্তরের সাবলীলতা। আমিনুল ইসলামের কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক ধরনের সচেতনতাবোধ পরিলক্ষিত হয়। কবিতায় শব্দব্যবহার কোনো ধরনের জটিলতা নেই, আছে সহজতর শব্দ প্রয়োগের সাবলীল বহিঃপ্রকাশ। যদিও তার কয়েকটি কবিতায় ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ লক্ষণীয়। হিন্দি ভাষাও লক্ষণীয়। বাংলা কবিতায় ঐতিহ্যের অংশীদারত্বে ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ যথাযথ নয় মোটেই তবে জীবনাচারণে এসব ইংরেজি শব্দ বা হিন্দি ভাষা আমাদের যেমন গ্রাস করেছে, তেমনি কবিতায় আশ্রয় করে নিচ্ছে। অনেকেই এরূপ ইংরেজি শব্দ বা হিন্দি ভাষা বাংলা কবিতায় প্রয়োগ করেছেন সচরাচর চোখেও পড়ে! অর্জিত বাংলা ভাষার জন্য কোনো অশনিসংকেত যেন না হয় এরূপ ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ বা হিন্দি ভাষা সেদিকটি আমাদের লক্ষণীয় হতে পারে এ সময়ে দাঁড়িয়ে। কেননা কবি নিজেই তার স্ব-ভাষার একজন শব্দ বা ভাষা নির্মাণকারী। অন্য ভাষা জানাও কবির প্রাজ্ঞতার পরিচায়ক হতে পারে কিন্তু কবিতার স্ব-ভাষার প্রতি নির্মোহ হবেন এটা আশা করা নিরর্থক নয় নিশ্চয়। তার বেশ কিছু কবিতায় বিশেষ কিছু চরিত্র উঠে এসেছে যে চরিত্রগুলো মিথের আশ্রয় হিসেবে কবিতায় স্থান করে নিয়েছে যথাযথভাবে। তার ‘নক্ষত্র পর্ষদ’ কবিতাটি একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ মিথনির্ভর কবিতার। পাশাপাশি মিথনির্ভর অন্য কবিতার চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে- ‘তুমি তো জানো, আমি কোনো দেবতা পুত্র নই;/ইন্দ্রের আশীর্বাদে বেড়ে ওঠা/পুঁড়ি ক্ষেতের পাশ ঘেঁষে/শিমুলের তুলা কুড়োতে কুড়োতে/অনঙ্গ পার হাত ধরে বেড়ে ওঠা/এক বরেন্দ্র সন্তান (দেবযানীর প্রতিশোধ)। আমিনুল ইসলামের কবিতায় এদিকে যেমন উপমা, উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়, অন্যদিকে তার কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহার নিপুণভাবে শিল্পিত হয়ে উঠেছে এমন কবিতার লাইনের সংখ্যা কম নয়। এরূপ কিছু চিত্রকল্পের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে- ১. কুয়াশার কামিজ পরা গোলাপের বাগান (উদ্বোধন)। ২. আমার চোখে চেয়ে হাসে কিশোরী সকালের ঠোঁট; (রিফুয়েলিং)। ৩. কুয়াশার আড়াল হয়ে আছে উত্তাপের স্রোত/যেভাবে আড়ালে থাকে ব্রা-ঢাকা স্তনের/উপচনো অবাধ্যতা/এবং দূরে আছে উত্তাপের উৎস/যেভাবে দূরে থাকে নিবিড়তম উত্তেজনা/কৈশোরমুখী কোমর থেকে; (জমে আছে নদী)।
গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা যেমন- প্যারাডক্স, নক্ষত্র পর্ষদ, মৃত্যুগন্ধা সময়ের ভালোবাসা, বিভক্তির পাঠশালা, রিফুয়েলিং, জমে আছে নদী, গার্লস কলেজের মেয়ে গায়, দেবযানীর প্রতিশোধ, পদাধিকার বলে এবং প্রদীপ শিখা কবিতাগুলো পাঠে মনে হয়েছে কবিতাগুলো বারবার পাঠযোগ্য। এ ছাড়া, ‘যদি আমি মরে যাই’ এবং ‘হিজলের সার্কিট হাউসে বসে শোনা’ দুটি দীর্ঘ কবিতা সময়ের প্রেক্ষিত বিবেচনায় যে ভাব-ভাষা, আঙ্গিক এবং সমকালীন ঘটনা ও অবস্থান নির্ণিত হয়ে কবিতারূপে ধরা দিয়েছে, তা বাংলা কবিতার ইতিহাসে মাইলফলক বললেও অত্যুক্তি হয় না।
আমিনুল ইসলামের কবিতার শক্তি এটাই যে, তিনি কবিতায় এক ধরনের আশ্রয় খুঁজে নেন, যেখানে পাঠক একাত্ম হতে পারেন অনায়াসে। তার কবিতা পাঠে এক ধরনের প্রাণের আরাম বিস্তার করে, যা কবি-কবিতাণ্ডপাঠকের মধ্যকার ত্রিবেণির সংযোগ স্থাপন সহজতর লাগে। আমিনুল ইসলামের কবিতা বাংলা কবিতার নিবিষ্ট পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়–ক- এমনটি প্রত্যাশা।
* অনু ইসলাম
"