সোহেল মাজহার

  ২১ জানুয়ারি, ২০২২

ধারাবাহিক রচনা- ১৭

উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু

আহমদ ছফার ওঙ্কার : হিন্দু পুরাণ মতে ওঙ্কার হচ্ছে সকল ধ্বনির আদি ধ্বনি। ধ্বনির উৎস বা মূল হচ্ছে ওঙ্কার ধ্বনি। মানুষের সৃষ্টিলগ্নে এই ওঙ্কার ধ্বনি মানুষকে অব্যক্ত অবস্থা থেকে প্রকাশযোগ্য করে। আহমদ ছফা ষাটের দশকের পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থার যে দমবন্ধ গুমোট অবস্থা লক্ষ করেন, তার মুক্তিমন্ত্রের সঙ্গে ওঙ্কার ধ্বনির রূপক ব্যঞ্জনা খুঁজে পান। বৃহত্তর গণমানুষের সামগ্রিক মুক্তির তীব্র আকাক্সক্ষার সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের মুক্তির যে অদম্য প্রচেষ্টা, লেখক তা একই সমান্তরালে দাঁড় করিয়ে দেন।

উপন্যাসটি মূলত উত্তম পুরুষে রচিত। গল্প কত্থকের ভঙ্গিতে উপন্যাসের প্রধান কত্থক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার তালুকদার পরিবারের রূপান্তরের গল্প বলেন। পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে এসে অধিকাংশ সামন্ত পরিবার যে পরিণতি ভোগ করে, নায়কের পরিবার তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। পাশাপাশি একজন বোবা নারী তার বোবত্বের বিরুদ্ধে, মুক অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তার শৈল্পিক ভাষা নির্মিত হয়েছে। একই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির প্রাসঙ্গিকতা ব্যক্ত করেন।

দীর্ঘ সামরিক জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ ধীরে ধীরে তাদের সহ্যসীমা অতিক্রম করতে থাকে। ৬৬-এর পর থেকে ছয় দফা, ছাত্রদের ১১ দফা দাবি আদায় ও সামরিক শাসনের ভ্রুত্রুটি অগ্রাহ্য করে গণ-আন্দোলনের সূচনা হলেও ৬৮ সালের শেষ দিকে তা প্রবল আকার ধারণ করে। ৬৯-এ এসে তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। নিঃসন্দেহে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর কেন্দ্রে ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং তার ঘোষিত ছয় দফা। লেখক আহমদ ছফা গল্প কত্থকের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিষয়টি যেভাবে উপস্থাপন করেন- ‘দেশের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। যেখানে দেশের গভীর ব্যথা মার্শাল সাহেবের গোমড়ামুখো সৈন্যরা সেখানেই কাঁটা বসানো বুট জুতোর লাথি মারে। প্রথম প্রথম গোটা দেশ আঘাতের বেদনায় গুঙ্গিয়ে উঠত। ক্ষত থেকে রক্ত বের হতো। আওয়াজে যন্ত্রণা ফুটে থাকত। প্রায় এক যুগ ধরে লাথি খেয়ে ব্যথা জর্জর অংশ ডাঁটো হয়ে উঠেছে। এখন প্রতিবাদ করার জন্য মুখিয়ে উঠেছে। যন্ত্রণা, বেদনা এবং দুঃখের কারখানা থেকেই প্রতিরোধের শাসানো আওয়াজ ফেটে ফেটে পড়ছে। তার ধার যেমন তীক্ষè, ভারও তেমনি প্রচণ্ড। সারা দেশে স্লোগানের ঢল নেমেছে। পথে-ঘাটে মানুষ শুধু মানুষ। চন্দ্র কোটালের জোয়ারের জলের মতো বইছে মানুষ। বাংলাদেশের রাস্তাগুলো নদী হয়ে গেছে। তাদের চোখে আগুন, বুকে জ্বালা, কণ্ঠে আওয়াজ, হাতে লাঠি। রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে স্লোগানের ধ্বনি বাংলাদেশের আকাশ মণ্ডলের কোটি কোটি বর্শাফলার মতো ঝিকিমিকি খেলা করে।

শেখ মুজিব জেলে। আগরতলা মামলার বিচার চলছে। এখানে-ওখানে বোমা ফুটছে, মিটিং চলছে। ঝাঁকে-ঝাঁকে মিছিল বেরিয়ে আসে। গুলি চলে। লাল তাজা খুনে শহরের রাজপথ রঞ্জিত হয়। সরকারি পত্রিকার অফিসগুলোতে হুতাশনের মতো প্রলয়ংকরী অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। প্রতিটি সকালেই খবরের কাগজের পাতা উল্টালেই টের পাওয়া যায় ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। (পৃষ্ঠা ৩১, ওঙ্কার : আহমদ ছফা, অক্টোবর ২০১৮, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা)

উনসত্তর মানুষকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, একজন বোবা মেয়েও ঘরে স্থির বসে থাকতে পারেনি। গল্প কত্থকের স্ত্রী সমস্ত শরীরী বাধা, ভয়, লজ্জা, দ্বিধা সংস্কার অতিক্রম করে মিছিলের অমোঘ আকর্ষণে ঘরের জানালায় এসে দাঁড়ায়। এর মধ্য দিয়ে একটি বদ্ধ সমাজের মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষার তীব্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ব্যক্তির অপূর্ণতা আর কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। একসময় বোবা স্ত্রী গলার স্বরযন্ত্র চিড়ে চিড়ে জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারিত হয়, বের হয়ে আসে রক্তপ্রবাহ। জয় বাংলা ও প্রতিবাদণ্ডপ্রতিরোধের রক্তপ্রবাহ এক স্রোতে মিশে যায়। ওঙ্কার উপন্যাসের মহত্ত্ব হলো, একজন বোবা নারীর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান একটি মোহনায় সমান্তরাল অবস্থান নেয়। গল্প কত্থকের বর্ণনায়- ‘আমি না ভেবে পারিনে, গোঁ গোঁ শব্দে এই যে গুণগত পরিবর্তন এর কারণ কী? হঠাৎ উদ্ভাবনের পুলকে চমকে উঠি। সেও মিছিলের মুখে উচ্চারিত ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ভেতর থেকে উগরে দিতে চাইছে। অক্ষম অবাধ্য কণ্ঠনালি দিয়ে উচ্চারণ করতে পারছে না। সমস্ত শক্তি জড়ো করে বাগ্যন্ত্রের ওপর হুকুম জারি করছে উচ্চারণ কর ‘উচ্চারণ কর’। বহুদিন পর একটানা গোঁ গোঁ শব্দের একটা বুদ্ধিগ্রাহ্য অর্থ পেয়ে গেলাম।

বস্তুপুঞ্জকে আমরা যেসব নামে ডাকি, আনন্দের, বেদনার, ক্ষোভের, আশ্চর্যের যেসব অনুভূতি বাক্যে প্রকাশ করি, ডাইনামোর মতো একটানা গোঁ গোঁ শব্দের মধ্য দিতে সেসব প্রকাশ করে এসেছে। প্রকাশ, হায়রে প্রকাশের ব্যথা। মিছিলটা একেবারে আমাদের বাড়ির সামনে এসে পড়েছে। গোটা বাংলাদেশের শিরা-উপশিরায় এক প্রসব বেদনা ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের বুক ফাটা চিৎকারে ধ্বনিত হচ্ছে নবজন্মের আকুতি। আমার বুকেও তরঙ্গ ভাঙছে। কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি। চারপাশের সবকিছু প্রবল প্রাণাবেগে থর থর কাঁপছে। বাংলাদেশের আকাশ কাঁপছে, বাতাস কাঁপছে, নদী-সমুদ্র-পর্বত কাঁপছে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। আচানক বোবা বউ জানলা সমান লাফিয়ে ‘বাঙলা’ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করল। তার মুখ দিয়ে গলগল রক্ত বেরিয়ে আসে।’ (পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮, ওঙ্কার)

উনসত্তরের ২০ জানুয়ারি আইয়ুববিরোধী গণ-অভ্যুত্থান একটি সংগ্রামী মাইলফলক স্পর্শ করে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ঘোষণা দিয়ে ১৪৪ ধারা অমান্য করে। ভীত-সন্ত্রস্ত পুলিশ বাহিনী মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হয়। আসাদ হত্যার প্রতিবাদে ২১-২২ ও ২৩ তারিখ সমগ্র ঢাকা শহরসহ ছোট-বড় শহরগুলো মিছিলে সয়লাব হয়ে যায়। ২৪ জানুয়ারি মিছিল রূপান্তরিত হয় গণ-অভ্যুত্থানে। অজস্র জলতরঙ্গের মতো সমগ্র শহরের মানুষ মিছিলের স্রোত হয়ে এক মোহনায় মিলিত হতে থাকে। শহীদ হয় মতিউর রহমান, শেখ রুস্তম আলী ও মকবুল। উপন্যাসে আসাদ প্রসঙ্গ উল্লেখ থাকলেও ২৪ জানুয়ারির ঘটনাবলি উল্লেখ নেই। কিন্তু উনসত্তরের আহ্বানে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বোবা মেয়ে যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, নিজের সমস্ত অন্তর-আত্মা দিয়ে, সমস্ত নিবেদন সমর্পণ করে বাংলাদেশ ও জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করে, তাই মূলত গণ-অভ্যুত্থানকে প্রতীকায়িত করে। তার মধ্য দিয়ে যে ধ্বনি সে উচ্চারণ করে, সেটি তার জন্য আদি ধ্বনি জয় বাংলা ধ্বনি, তার ‘ওঙ্কার’ উচ্চারণ। আখ্যানের বোবা মেয়ে হয়তো জানে না, তার ওঙ্কার উচ্চারণের উৎস কোথায়? কিন্তু বাঙালি মাত্র জানে, ছয় দফা ঘোষণা করে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধিকার, স্বাধীনতা তথা মুক্তি-সংগ্রামের সূচনা করেন। সেই ছয় দফার মধ্য দিয়ে মুক্তির ব্যঞ্জনা প্রকাশধ্বনি রূপে জয় বাংলা ধ্বনির জন্ম। শেখ মুজিবুর রহমানসহ সমগ্র জাতি তাকে মুক্তিমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে। এ পর্যায়ে এসে উপন্যাসের কাহিনি আর কাহিনির ভেতর আবদ্ধ থাকেনি। কাহিনির আর গুরুত্বপূর্ণ থাকেনি, কাহিনি ছাড়িয়ে মানুষের অন্তর্গত মুক্তির নামান্তর হয়ে ওঠে। এই ‘ওঙ্কার’ ধ্বনির মাঝে বাংলার মুক্তি ও স্বাধীনতাযুদ্ধের বীজমন্ত্র নিহিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close