ইলিয়াস ফারুকী

  ২১ জানুয়ারি, ২০২২

বন্ধু

‘ধান নদী খাল এই তিনে বরিশাল’- বরিশালের সর্বত্র কথাটার প্রমাণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তবে এর শতভাগ সত্যতা পাওয়া যায় আফালকাঠিতে। গ্রামটি বাকেরগঞ্জ উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নের অধীনে, ছোট সুন্দর ছিমছাম এবং সবুজে সাজানো। উপজেলা সদর থেকে এর দূরত্ব মাত্র সাত কিলোমিটার এবং উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সড়ক এবং নদীপথে। ওপরের ছোট বচনের যথার্থতা যেন এই গ্রাম। এর চারদিকে নদী, মাঝে গ্রামটি যেন সবুজের সোনা দ্বীপ। কবাই, কারখানা, লোহালিয়া এবং আমতলী নদী গ্রামটির চারদিকে সুরক্ষাবূহ্য তৈরি করে রেখেছে। যেহেতু গ্রামটির চারদিক নদীবেষ্টিত, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হয় মৎস্যজীবী না-হয় চাষাবাদের কাজ করেন। তবে এর মধ্যেও বেশ কটি পরিবার আছে, যারা সরকারি/বেসরকারি চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। কেননা এ গ্রামে শিক্ষিতের পরিমাণ অনেক। সম্ভবত জনসংখ্যার চল্লিশ শতাংশ লোক শিক্ষিত এবং এই শিক্ষিত পরিবারগুলোর মধ্যে একটি পরিবার বরকতুল্লাহ হাসান ও মন্নুজান সাদিয়ার পরিবার। স্বামী, স্ত্রী, এক মেয়ে ও যমজ দুই ছেলে নিয়ে পরিবার। মেয়ে সবার বড়, ছেলে দুটোর সঙ্গে মেয়ের বয়সের অনেক ব্যবধান। বরকতুল্লাহ সাহেব উপজেলা সদরের কৃষি সম্প্রসারণ অফিসে সহকারী হিসেবে কর্মরত। প্রতিদিন নিজের সাইকেল নিয়ে অফিসে যান এবং বিকালে ফেরত আসেন। বড় মেয়ে গ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে কলসকাঠি বেসরকারি ডিগ্রি কলেজের বিএ শেষ পর্বের ছাত্রী এবং তাদের যমজ দুই ছেলে গ্রামেরই আফালকাঠি জেএ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। বরকতুল্লাহর সংসারে মূল আয় যদিও চাকরি থেকেই আসে, তথাপি বাড়িতে দুটো গরু, হাঁস-মুরগি থাকায় নিজেদের বেশ কিছু আমিষের ঘাটতি তা থেকে পূরণ হয়। এ ছাড়া কোনো প্রকার চাষাবাদের জমি না থাকায় আর কোনো আয় তাদের ছিল না। বেশ গোছানো এবং পরিপাটি সংসার। মৃদু সমস্যা থাকলেও খুব বড় আর্থিক সমস্যা তাদের ছিল না। মেয়েকে নিয়ে বরকতুল্লাহর স্বপ্ন অনেক বড়। মেয়ে গ্র্যাজুয়েশন করলে পরে তিনি তাকে আইন পড়াবেন এবং একজন গোছানো উকিল বানাবেন, যা তিনি নিজে হতে চেয়েও পারেননি।

বরকতুল্লাহর অফিসে আসা-যাওয়ার পদ্ধতিটা খুবই অদ্ভুত। তিনি প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় খুব দ্রুতই সাইকেলে প্যাডেল মেরে সাত কিলোমিটার রাস্তা পার করেন, কিন্তু ফেরার পথে ধীরে-সুস্থে রওনা হয়ে বিভিন্ন বাজারে এবং ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করতে করতে বাসায় ফেরেন রাতের দিকে। তার ফেরার পদ্ধতি তাকে এ সাত কিলোমিটারের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। এই পরিচিতি এবং বিভিন্ন বাজারে, স্থানে তার আদর-সমাদর তিনি বেশ উপভোগ করেন। মাঝে মাঝে তার নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ভাবতেও ভালো লাগে; তাই তার চাকরি জীবনের বিগত চব্বিশ বছর তিনি নিয়মিতভাবেই এ কাজ করে যাচ্ছেন। এই আসা-যাওয়ার পথে কয়েকটি হাটবাজার পড়ে, যেখানে তিনি নির্দিষ্ট দোকানে বসে আড্ডা দেন এবং অদ্ভুত যে কাজটা করেন তা হলো, ওই নির্দিষ্ট হাটগুলোর নির্দিষ্ট দোকানে বসেই তিনি হাঁক দেন- ‘আয়, তোরা কই’। মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে আবার ডাকেন- ‘আয়, জলদি আয়’। আশ্চর্যভাবে দেখা যায়, এ সময় বাজারের কুকুরগুলো লেজ নাড়াতে নাড়াতে তার সামনে এসে হাজির হয়। কেউ হয়তো আদুরে গলায় শব্দ করে, কেউ হয়তো তার গা-ঘেঁষে দাঁড়ায়। কেউ মাথা উঁচু করে আদুরে স্বরে আওয়াজ তুলবে। তিনি তখন তাদের মুখে শব্দ করে এবং অনেককে মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে দেন। একই সঙ্গে তার কাছে থাকা ব্যাগ থেকে পাউরুটি বের করে তাদের খাওয়ান। এই কাজ তিনি অনেক বছর থেকেই নিয়মিত করে আসছেন। কলসকাঠি, সিমুলতলা ও আফালকাঠি পরপর তিনটি হাটবাজারের সবগুলো কুকুর তার অতি আপন।

কুকুরের প্রতি তার দুর্বলতা অনেক আগে থেকেই। একসময় তিনি নিজেও কুকুর পোষতেন। স্ত্রী পছন্দ করেন না বলে বিয়ের পর থেকে বাড়িতে কুকুর পোষা বন্ধ করলেও কুকুরের প্রতি তার ভালোবাসা সামান্যতম কমেনি। এই প্রাণীর অছিলায় কয়েকবার তার জীবন রক্ষা পেয়েছে। একাত্তরে যখন তিনি মাত্র উনিশ বছরের যুবক, থাকতেন বাবার সঙ্গে বরিশাল সদরের বিবির পুকুরের পূর্ব পাড়ে। এপ্রিলের শেষের দিকের কথা, তখন সারা বাংলাদেশে দিন-রাত অধিকাংশ সময় কারফিউ জারি থাকত। এমনি এক দিন সকালে রেডিওতে ঘোষণা হলো, জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করার জন্য কর্তৃপক্ষ সকাল দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করেছে। ঘোষণাটা ছিল মূলত শুধু ঢাকার জন্য, মফস্বল শহরগুলোতে তা কার্যকর ছিল না। কিন্তু রেডিওর ঘোষণা শুনে সারা দেশের লোকজন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। দলে দলে লোকজন বাইরে বেরিয়ে এলো। কারফিউ ভঙ্গকারীকে দেখামাত্র গুলির হুকুম থাকায় সারা দেশে ধোঁকায় পড়ে অনেক লোক গুলিতে মারা পড়ল। এমনি এক দিনের ঘটনা, বরকতুল্লাহ বিবির পুকুরে গোসলের জন্য বের হলেন, সঙ্গে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী টাইগার (পোষা কুকুর)। সবেমাত্র তিনি পুকুরে নেমেছেন, হঠাৎ টাইগারের বিকট শব্দে চিৎকার শুনে কি হয়েছে তা দেখার জন্য ঘাটলায় উঠতেই দেখলেন, পুকুরের পশ্চিম পাড়ে প্রধান সড়কে টাইগার দৌড়ে একবার দক্ষিণ দিকে, আর একবার বিপরীত দিকে যাচ্ছে, আবার হঠাৎ হঠাৎ থেমে গিয়ে পুকুরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে বরকতুল্লাহর দিকে তাকিয়ে অস্থিরভাবে ক্রমাগত চেঁচিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ই হঠাৎ তিনি গুলির আওয়াজ শুনলেন এবং দেখলেন তার প্রিয় কুকুরটা একটা ছোট লাফ দিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল। বরকতুল্লাহর পুরো বিষয়টা বুঝতে আর কিছুই বাকি থাকল না। কোনো রকমে তিনি নিজেকে রক্ষা করলেন কিন্তু চিরতরে হারালেন তার সর্বক্ষণের সঙ্গীকে। সেই ঘটনার পর থেকে কুকুরের প্রতি তার মমত্ব যেন মায়েরই মতো।

কুকুরদের খাওয়ানোর এই কাজ তিনি বেশ আমুদে ভঙ্গিতেই করেন। কুকুরগুলো যখন খাওয়ায় ব্যস্ত থাকে, তখন তার চোখণ্ডমুখ থেকে যেন তৃপ্তির আভা বের হতে থাকে। যদিও হাটবাজারের লোকজন তার এই স্বভাবের সঙ্গে বেশ পরিচিত, তবু তারা বিস্ময়ভরে দৃশ্যটি নিয়মিত উপভোগ করেন। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাদের খাওয়া শেষ হলে পরে বরকতুল্লাহ যখনই আবার সাইকেলে চড়ে বসেন, কুকুরগুলো তার সঙ্গে সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত এগিয়ে যায় এবং তাদের নির্দিষ্ট সীমানায় থেমে গিয়ে তার দিকে দৃষ্টি রেখে অপেক্ষা করতে থাকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বরকতুল্লাহকে দেখা যায় তারা বিচিত্র সব আওয়াজে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকে। তিনি চোখের আড়াল হলে পরেই তারা তাদের জায়গায় ফিরে আসে।

সারা দেশে স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। মিটিং, মিছিল, মাইকিং কিংবা ব্যক্তিগতভাবে প্রভাব আছে এমন ব্যক্তিকেও প্রার্থীরা যথেষ্ট খাতির তোয়াজ করছে। তাদের যথাসম্ভব পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে নিজের প্রচার-প্রচারণার অংশ বানাচ্ছে। যেহেতু বরকতুল্লাহ এ অঞ্চলে বেশ পরিচিত, তাই তিনিও প্রার্থীদের খাতির, তোয়াজ এবং নিজের সঙ্গে ভেড়ানোর চেষ্টা থেকে বাদ যাননি। তিনি যদিও চেষ্টা করেছিলেন এসব থেকে দূরে থাকতে কিন্তু তিনি তা এড়াতে পারেননি। অবশেষে এক প্রার্থীর কাছে হার মানতে হলো, কারণ প্রার্থী যে তারই নিজের গ্রাম আফালকাঠির। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, তিনি ওই প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণায় যোগ দেওয়া শুরু করলেন, কিন্তু বিষয়টি অন্য প্রার্থীরা মোটেই ভালো চোখে দেখল না। তারা ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকল। বরকতুল্লাহ যেহেতু এলাকায় যথেষ্ট সম্মানিত, বিধায় কেউ ঘাঁটাতেও সাহস পেল না।

নির্বাচনের হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছে, এই মনে হচ্ছে একজনের অবস্থা ভালো তো পরক্ষণেই মনে হচ্ছে আরেকজনের অবস্থান খুবই শক্ত। খুব জোর করে কেউ বলতে পারছে না কার অবস্থান বেশ শক্ত, কিন্তু যেদিন থেকে বরকতুল্লাহ আফালকাঠির প্রার্থীর পক্ষে কাজ শুরু করেছেন, মনে হচ্ছে তার অবস্থা ক্রমেই শক্ত অবস্থানের দিকে যাচ্ছে।

প্রতিদিনের মতো আজও বরকতুল্লাহ সময়মতো অফিস শেষ করে তার সাইকেল নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। আজ একটু তাড়াহুড়ো থাকলেও তিনি তার নিয়মিত অভ্যাস থেকে একটুও পিছপা হলেন না। তার নিয়মিত কাজ তিনি ঠিক রেখেই তার বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন। শেষ বাজারটা পেরিয়ে তিনি যখন তার গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিয়ে বাজারের মোড় ঘুরে যেই না বাজারের গাছ-গাছালিঘেরা জায়গা পেরিয়ে খোলা মাঠের অদূরে সামান্য আড়ালে এসেছেন, ঠিক তক্ষুণি অন্য পাশের গাছ-গাছালির আড়াল থেকে মুখে কালো কাপড় বাঁধা তিনজন লোক বেরিয়ে এলো। প্রত্যেকের হাতেই রামদা। তারা বরকতুল্লাহকে ঘিরে ধরল এবং সেই সঙ্গে চলল অশ্রাব্য গালাগাল। একজন লাথি দিয়ে তাকে সাইকেল থেকে নিচে ফেলে দিল, অন্যজন যেই মাত্র তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র মাথার ওপর তুলল, ঠিক তখনই ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। প্রায় বিশ থেকে পঁচিশটা কুকুর যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে লাফিয়ে পড়ল ওদের তিনজনের ওপর এবং বাকি চার-পাঁচটা কুকুর বরকতুল্লাহকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন কেউ তার ধারে-কাছেও ঘেঁষতে না পারে। ওদিকে মুখোশধারীদের অবস্থা খারাপ। এতগুলো কুকুরকে সামলানো তাদের দ্বারা অসম্ভব। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা রণেভঙ্গ দিয়ে যে যেদিকে পারল পালাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আক্রমণকারী কুকুরগুলো বরকতুল্লাহর কাছে এসে দাঁড়াল। বিভিন্ন সুরে ও স্বরের ডাকে সান্ত¡না দিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে তারাই তাকে তার বাড়ির উঠোন পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেল। প্রত্যেকের চোখে-মুখে আনন্দ আর বরকতুল্লাহর চোখে অবিরত অশ্রু ঝরে যাচ্ছিল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close