সোহেল মাজহার

  ১৪ জানুয়ারি, ২০২২

ধারাবাহিক রচনা- ১৬

উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই : ১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন স্বাধিকার, ছয় দফা, শেখ মুজিবের মুক্তি আইয়ুব খানের পতনের দাবিতে একই সঙ্গে রাজধানী শহর, বন্দর, গঞ্জ ও নিভৃত গ্রাম উত্তাল হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলে অন্তত ভারতবর্ষ কিংবা বাংলাদেশে এটি একটি অনন্য ঘটনা। ৬৯-এর আগে কিংবা পরে এই ইতিহাসের কোনো পূর্ব নজির, কোনো পুনরাবৃত্তি নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমাজ, পর্যবেক্ষক, ইতিহাস, প্রতিষ্ঠান ও বৃহৎ গণমানুষ বাঙালির মহাজাগরণকে গণ-অভ্যুত্থান নামে চিহ্নিত করে। বাঙালির মহান মুক্তি ও স্বাধীনতার ভীত যদি ধরা হয় ৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে, তাহলে উনসত্তর তার সর্বোচ্চ সোপান।

একজন কথাসাহিত্যিক উনসত্তরকে কীভাবে অনুভব করেন? পরিপাশর্^কে উপলব্ধি করেন? বস্তুত ৬৯-এর যেমন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভূ-রাজনীতিগত তাৎপর্য, প্রভাব ও মাত্রা আছে, তেমনি ব্যক্তি মানুষের মাঝেও নানা রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উনসত্তরের ওপর আলোকপাত করেন, জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, প্রক্রিয়াশীল-সুবিধাবাদী রাজনীতি, বাম রাজনীতি, মধ্যবিত্ত, উঠতি মধ্যবিত্ত, সামন্ত দৃষ্টিভঙ্গি, জোতদার-প্রান্তিক কৃষক, কৃষক সংগ্রাম ও শ্রেণিহীন মানুষের শ্রেণিগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তার বাইরেও লেখক এই ঘরানা পুরোপুরি ভেঙে একজন ব্যক্তি কীভাবে সম্পূর্ণ ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত-বিযুক্ত থাকে, তার মনোবিশ্লেষণ করেছেন। চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসটি এক অর্থে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ধারণাকে অতিক্রম করে ব্যক্তির নিজস্ব বলয়ের আবর্তে বৃত্ত বন্দি হওয়ার স্বপ্ন কাক্সক্ষা।

উপন্যাসের পটভূমি ছয় দফা দাবি আদায়, শেখ মুজিবের মুক্তি, ছাত্রদের ১১ দফা ও আইয়ুব খানের পদত্যাগের দাবিতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন। ক্রমে শেখ মুজিবের মুক্তি গণ-দাবির মূল আকর্ষণ হয়ে ওঠে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমির সমান্তরালে রাজনীতিবিদ, মধ্যবিত্ত, ছাত্র সংগঠন, কৃষক-শ্রমিক, শ্রেণিহীন মানুষের ভাবনা ও মনোজগৎকে স্পর্শ করেন এবং তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওসমান গণি ওরফে রঞ্জু সামান্য চাকরিজীবী। পুরান ঢাকার এক ঘিঞ্জি গলির বাড়িতে চিলেকোঠায় তার বসবাস। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের তীব্রতা সে প্রত্যক্ষ করে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাম রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন। তিনি লেখায় মধ্যবিত্ত মানসিকতা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিকে আঘাত করেছেন। ফলে কৃষক বিদ্রোহ ও সর্বহারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু তার অগোচরেই শহর-বন্দর, গ্রাম ও গঞ্জে ছয় দফার সর্বগ্রাসী প্রভাব ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ছয় দফায় যে এক দিন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে কিংবা বৃহত্তর গণমুক্তি ও সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করবে, তিনি সেই সত্য স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ তিনি বলেছেন, ছয় দফার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন হবে। অবস্থা তখন এমনই দাঁড়িয়ে ছিল যে, ছয় দফা বিরোধিতাকারী ও সরকারের সুবিধাভোগীও নিজেকে বাঁচাতে ছয় দফা সমর্থক হয়ে উঠতে হয়। রাজধানী ঢাকা মিছিলের নগরী হয়ে ওঠে। শহর, মফস্বল শহর মানুষের সম্মিলিত রুদ্ররোষে থেমে থেমে কেঁপে ওঠে। গ্রামের অবস্থা তখন কী রকম? শান্ত-নিরুদ্বেগ, তা কিন্তু নয়। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান চিরায়ত গ্রামণ্ডবাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ভীতে বড়-সর অভিঘাত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। আনোয়ারের পর্যবেক্ষণ- ‘দ্যাখো না মানুষ কত এগিয়ে গেছে। গ্রামে গভমেন্ট ফেল করছে, লোকে ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করবে। যেসব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোকদের ওপর ভরসা করে গভমেন্ট চলে পিপল তাদের পাত্তা দিচ্ছে না। ...মানুষ কী রকম কনশাস আর মিলিট্যান্ট হয়ে উঠেছে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গ্রামের যারা মাথা, কয়েক জেনারেশন ধরে যারা ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে আসছে, কর্নার্ড হতে হতে তাদের অবস্থা এ রকম দাঁড়িয়েছে যে, ঘোরতর মুসলিম লীগাররা পর্যন্ত শেখ মুজিবের রিলিজ চায়। না হলে ওদের সেভ করবে কে?’ (পৃষ্ঠা ২৯-৩০, চিলেকোঠার সেপাই : আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ২০০৬, ইউপিএল, ঢাকা)

লেখক উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সমান্তরালে কৃষক নির্যাতনের প্রেক্ষিত তুলে ধরেন। আবার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বপ্ন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার দিকে ধাবিত সেই ইঙ্গিত দেন। আনোয়ারের ভাষায়- ‘ওসমানের দিকে একবার খুশি খুশি চোখ করে তাকিয়ে নিয়ে আনোয়ার তার কথা অব্যাহত রাখে, এর আগে পিপল যেসব মুভমেন্টে অ্যাকটিভলি পার্টিসিপেন্ট করেছে, সেগুলো হয়েছে এক একটি এলাকা জুড়ে। ধরো তেভাগা, ধরো হাজং কিংবা সাঁওতালদের বিদ্রোহ- এগুলো বিশেষ বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল, তাই না? কিন্তু এ রকম সমস্ত প্রতিভন্স জুড়ে।’

প্রভিন্স কেন? এবার কান্ট্রিওয়াইড মুভমেন্ট চলছে, ওয়েস্ট পাকিস্তানি পিপল আর অলসো পার্টিসিপেটিং ভেরি স্পনটেনিয়াসলি!’ ইফতেখারের এই মন্তব্য আনোয়ার ঘাড় নেড়ে অনুমোদন করতে করতে বলে, ‘এই ব্যাপক আন্দোলন কি কেবল অ্যাডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ আর পার্লামেন্টারি ফর্ম আর অটোনমির জন্য? আর কিছু না?’ (পৃষ্ঠা ২২, চিলেকোঠার সেপাই)

লেখক আখ্যানের ভাষা ব্যবহারে বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করেছেন। পুরান ঢাকার প্রেক্ষাপটে হাড্ডি খিজির তার বউ, জুম্মান, মাহাজন প্রমুখ ক্যারেক্টারের মুখে ঢাকার স্থানীয় উপভাষায় কথা বলিয়েছেন, বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষা আলি বক্স, খয়বার গাজী, আফসার গাজী, চেংটু, জালাল মাস্টার কথা বলেন, কিন্তু বগুড়ার সন্তান আনোয়ারের ঢাকায় বসবাস, তার শিক্ষা ও রুচির কারণে সে এবং তার বন্ধুমহল চলতি ভাষায় কথা বলে। অর্থাৎ লেখক ভাষা ও ডায়ালেক্টের ক্ষেত্রে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আবার বৈরাগীর ভিটার প্রসঙ্গে ফকির মজনু শাহ, ভবানী পাঠক, সিপাহি বিদ্রোহের পরাজিত সৈনিকদের পলায়নপর সৈনিকদের আর্তনাদকে মিথ হিসেবে ব্যবহার করেন অনুপম দক্ষতায়। বিশেষ করে যমুনা নদীর স্রোত ধ্বনি, ধারা বর্ষার বাঁকের ধ্বনিকে যেভাবে বাঙময় করেন, তাতে একাধারে মিথ ও কবিতার অনবদ্য ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়। উপন্যাসের ওসমান হাড্ডি খিজির কিংবা জালাল মাস্টার কথা বলতে বলতে তাদের অনুভবের জগতে যে রং ধরে, তাকে কাব্যময়তা বললে বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। ভাষা, অনুভূতি যে কত তীক্ষè শক্তিশালী হয়ে ওঠে কিংবা বাস্তব অতিক্রম করে মানুষ ও জনগোষ্ঠীর জীবনে অতিবাস্তব থেকে বড় বাস্তব হয়ে ওঠে, চিলেকোঠার সেপাই তার উদাহরণ। বাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতা সবই পর্যুদস্ত। শেষ পর্যন্ত চিলেকোঠার সেপাই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সামষ্টিক মানব মিথ, ব্যক্তির সম্পৃক্তি-নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গির আখ্যান এবং একজন শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রতীকায়িত করে সেই মানবমিথ রচনা করেছেন, ইতিহাসে তিনি বঙ্গবন্ধু নামে অভিহিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close