বাবুল আনোয়ার

  ১৯ নভেম্বর, ২০২১

হাসান আজিজুল হক

স্বতন্ত্র ভুবনের স্রষ্টা

হাসান আজিজুল হক বাংলা সাহিত্যের এক স্বতন্ত্র ভুবনের নির্মাতা। যে নির্মাণ কৌশলের অনন্যতায় পরিণত হয়েছেন রবীন্দ্র-উত্তর কথাসাহিত্যের অন্যতম মহিরুহ। তার সাহিত্য ভুবন তার মেধা, পরীক্ষণ ও পরিভ্রমণের স্বশাসিত এক উজ্জ্বল ভূখণ্ড। প্রজ্ঞার দীপ্তিতে প্রসারিত, সৃজনের আবাহনে গভীর। তার মেধাচর্চিত সৃষ্টির আলোকচ্ছটায় দিগন্তের উদ্ভাসে অসীম, অপরূপ।

হাসান আজিজুল হক জীবনের দীর্ঘযাত্রায় মেধা ও সৃষ্টির ফাল্গুনে দীর্ঘপথ ভ্রমণ করেছেন। এ ভ্রমণ অন্যকিছু নয়। মূলত জ্ঞান, মেধা ও প্রত্যয়ের এক আলোছায়ার ভুবন ঘিরে। শিক্ষকতায় কাটিয়েছেন জীবনের অনেক দিন। আর বাকি সময়টা ব্যয় করেছেন সৃষ্টিশীল কাজে। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে। তবে সাহিত্যের নিগড়ে তার জীবন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল অবিচ্ছেদ্য। হাসান আজিজুল হকের রচনাক্ষেত্র মূলত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। কথাসাহিত্যে তার যে নিবেদন, সৃষ্টি তার একটা ভিন্নতর অবয়ব তিনি সৃষ্টি করতে সফল হয়েছেন। এর মধ্য দিয়েই তার মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচন ঘটেছে সতত সন্তরণে। একজন কথাশিল্পী হিসেবে প্রচলিত ধারা থেকে তিনি অনেকটাই আলাদা। তা যেমন তার বিষয়বস্তুর দিক থেকে, তেমনি তার তার লেখার স্টাইল, মর্মস্পর্শী উপস্থাপনা ও অন্তর্হিত বোধ থেকে। তার শিল্পীসত্তা জুড়ে প্রখর জীবন দৃষ্টি ও সজ্ঞানের আলো সব সময় বহমান ছিল। তিনি উন্মোচিত চোখে সবকিছু গভীর মননশীলতায় পর্যবেক্ষণ করেন। মানবিক বোধ ও জাগ্রত বিবেচনায় সৃষ্টির মগ্নতায় মেতে উঠেছেন। বিষয়বস্তুর নির্বাচনের কাজটি তার স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হতো। সামাজিক বিবর্তন, শোষণ, নৈরাজ্য, সামাজিক দাঙ্গা, মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমুখী টানাপড়েন, নিগ্রহকে তিনি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পরিভাষায় ও কৌশলে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। মানুষ মানবিক মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হোক, মানবিক হিল্লোলে দূর হোক কুসংস্কার, কূটাভাস। এক অপ্রতিরোধ্য অগ্রসরমানতায় তিনি তার সাহিত্যে সে চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। বাস্তবতা ও জীবনের নানা দিক শিল্পের সম্ভারে উঠে এসেছে তার সৃষ্টিতে। তার প্রতিটি লেখা পরীক্ষা, নিরীক্ষায় প্রসারিত হয়েছে। প্রতিটি লেখার পেছনে রয়েছে তার দীর্ঘ শ্রম ও মনোযোগ। অব্যাহত গ্রহণ ও বর্জনের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যের সিঁড়ি ডিঙিয়েছেন। বাংলা কথাসাহিত্যে এনেছেন নবতর সমৃদ্ধি। গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে তার গভীর হৃদয়িক সম্পর্ক তার লেখায় হীরকখণ্ডের প্রভায় দ্যুতিময় হয়ে আছে।

রচনার ক্ষেত্রে তিনি সমকাল থেকে মহাকালের পথ ধরে হেঁটেছেন। তার দেখা ঘটনা, সময়, দুঃসময়, মানব প্রগতির ধারা, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধকে তিনি নিজস্ব বোধ ও বিবেচনায় তুলে ধরেন। সেখানে শব্দ ও ভাষা ব্যবহারে তার পরিমিতিবোধ, নতুন ধরনের প্রয়োগ কুশলতা তাকে কথাশিল্পী হিসেবে অনন্য করে তুলেছে। তিনি যা দেখেছেন, যা অনুভব করেছেন, সেই উপলব্ধির সারবত্তাই তার লেখনীতে তুলে ধরেছেন। হাজার বছরের এ সমাজব্যবস্থায় যারা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে মানবকল্যাণ ও প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তিনি তাদের স্বরূপ উন্মোচনে সচেষ্ট থেকেছেন। আজীবন সাহিত্যকে তার বাহন ও মুখপত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তার এ দায়বোধকে সৃষ্টির নৈতিক মানদণ্ড হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। মানবিক মর্যাদায় বেঁচে থাকার নিয়ত সংগ্রামকে জীবনবাদী শিল্পী হিসেবে তিনি অস্তিত্ব রক্ষার অভিন্ন উৎস ও ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তার গল্প, উপন্যাস সেই শুভবোধের অত্যুজ্জ্বল আলোক-আঁধারে পরিণত হয়েছে।

তার কয়েকটি গ্রন্থ হলো : সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবীগাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, রাঢ়বঙ্গের গল্প, অতলের আধি, কথাসাহিত্যের কথকতা, চালচিত্রের খুঁটিনাটি, একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা, বাচনিক আত্মজৈবনিক, রবীন্দ্রনাথ ও ভাষাভাবনা, আগুনপাখি, ফিরে যাই ফিরে আসি, লন্ডনের ডায়েরি ইত্যাদি। সাহিত্যে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।

হাসান আজিজুল হক সাহিত্যকর্মে উজ্জ্বল সম্ভারের স্রষ্টা। সৃষ্টি ও শিল্প ভুবনে তিনি অসীম দিগন্তের আগুনপাখি। সময়ের পথ ধরে তার সৃষ্টি শিল্পময়তায় অন্তহীন আলোকসম্ভার হয়ে থাকবে। কাল-মহাকালের পথ ধরে বাংলাসাহিত্যে তিনি পরিব্যাপ্ত স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল বিচ্ছুরণে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close