শাহমুব জুয়েল

  ১৫ অক্টোবর, ২০২১

জীবনবোধের মরমি শিল্পী গুরনাহ

উদ্বাস্তু মানুষের গল্পকার আবদুলরাজাক গুরনাহ। নিজভূমি হারানোর ক্ষতচিহ্ন বুকে এঁটে কলম ধরেন তিনি। লেখক হিসেবে যা মগজে বয়ন হতে থাকে। পায়ের নিচে মাটি সরে গেলে জীবনে দুর্মর মেঘ জমে। ঘিরে ধরে অন্ধকার। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও মনোবল তৈরি না হলে জীবনও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। কেন অনিশ্চয়তা? ভেতরে ঘাত-প্রতিঘাতের তীব্র ধকল। বয়সের উদ্যমতা। তবে উদ্দীপনা ও বিদ্রোহভাব ছিল জীবন গঠনে। ফলে তিনি শিক্ষাজীবনে সাফল্য পেয়েছেন। উপনিবেশবাদ, অনুপ্রবেশ, উদ্বাস্তু মানুষের জীবন-সংগ্রাম, আরব বংশোদ্ভূতদের গণহত্যা ও পরিবারের ত্যাগ মননজগতে প্রবল আঘাত হানে। শরণার্থী ট্রমা উত্তেজিত করে, লেখনী ও বোধে তা পরিমিশ্রিত। তার লেখনীতে অনুষঙ্গ হিসেবে তা লিপিবদ্ধ। এ কথা সুস্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ ফল। বাস্তুচ্যুত মানুষের হাহাকার, যাতনা তিনি মেনে নিতে পারেননি। মানার কথাও নয়- ক্ষরণ হৃদয়ের গহিনে তাই ঔপন্যাসিক হিসেবে কাহিনিবিস্তারে চৌকস শিল্প সৌন্দর্য প্রকাশ করেছেন। কেননা, মানবজীবনের বেদনা উপন্যাসে তুলে ধরা সার্থক ঔপন্যাসিকের কর্মকৌশল। তার লেখনী ও তথ্যচিত্রে জীবন বাস্তবতার দৃশ্যপট সুচারুরূপে অঙ্কিত।

শরণার্থী জীবনবোধের শিল্পী তিনি। যুক্তরাজ্যে শরণার্থী হিসেবে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ভূমি ছাড়ার বিন্ধ্যাচল ডিঙিয়ে আলো দেখাতে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন। জন্ম কি আজন্ম পাপ? মহাকালব্যাপী এ প্রশ্ন- পৃথিবীজুড়ে শত শত প্রাণের বসবাস। প্রাণে প্রাণে মাটি ও হাওয়ার গতিবেগ বাড়ছে। মানুষের আধিপত্য ও সহিংসতা প্রবল। স্বয়ং জীবন কত নির্মম ও নিষ্ঠুর তা রয়েছে উপন্যাসের চরিত্র বাস্তবতায়। পায়ের নিচে মাটি নেই। অনুর্বর জীবনে সংঘাত, অনিশ্চিত জীবন। আলো অধ্যায় কোথায়? যাবে কোথায়? তার মনে প্রচুর মনোপীড়ন ছিল। উঠতি বয়সে জন্মভূমি ত্যাগ করে, আলো অন্বেষণ করেন। মগজে-ধ্যানে প্রতিবাদ ও দাহযন্ত্রণা প্রবল। ভূ-রাজনীতি ও ঔপনিবেশিক শাসন কুরে খেয়েছে জীবনের আলো ও বেঁচে থাকার অঙ্কুরোদগম। তবু স্বপ্নচারী তিনি।

অস্ত্র ও পেশির সঙ্গে আপসহীন কলমযোদ্ধা ও কথাকার তিনি। নিজ জীবন ও কিশোর বালকের গল্প খুবই নান্দনিক শিল্পকর্ম। জাঞ্জিবার তার মাতৃভূমি কিন্তু সেখানে বেড়ে উঠতে পারেননি। উপনিবেশবাদ ছুড়ে দিয়েছে নির্মমতার আগ্রাসনে। বিশ্বময় আগ্রাসন ও ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অনমনীয় ও সম্পূর্ণ আপসহীন। দেখা যাচ্ছে, ১৯৬৩ সালে জাঞ্জিবার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আবেইদ কারুমের শাসনামলে আরবীয় বংশোদ্ভূতদের ওপর অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন ছিল ধারাবাহিক রূপ। দুর্ভাগ্য যে, কিশোর বয়সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। ১৯৬০ সালে শরণার্থী হয়ে ইংল্যান্ড যান। অপরিচিত ভূমিতে বহু সন্তানের সঙ্গে প্রবেশ করেন তিনি। ধীরে ধীরে সম্ভাবনাময় জীবন তৈরি হয়েছে। পরিবেশ পরিস্থিতিকে ভেদ করে আলোকিত করেছেন নিজেকে। ইচ্ছাই তার সাফল্যের প্রধান চালিকাশক্তি। অহেতুক মোহ ছিল না; ক্লান্তও ছিলেন না। নতুন আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে তৈরি হয়েছেন। যদিও ভেতরে ছিল গভীর ও অতৃপ্ত দুঃখবোধ। জীবন ও কলম থেমে থাকেনি। ভূ-রাজনীতিও দমাতে সক্ষম হয়নি। শিল্পচাতুর্য দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত জীবনের গল্প, বাস্তব স্কেচ উপন্যাসে লিপিবদ্ধ করেন।

স্বল্পপ্রজ লেখকের বৃহৎ প্রাপ্তি। দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী বহু লেখক অনেক লিখেও প্রতিষ্ঠিত হননি। কিন্তু অল্পসংখ্যক গ্রন্থ লিখেও সমাদৃত হয়েছেন অনেকে। আবদুলরাজাক গুরনাহের লৈখিক চাতুর্যশক্তি ছিল। কেননা, লেখকের কাজ হলো- শৈল্পিক নৈপুণ্যতা। কতগুলো বিষয়ের সুবিবেচনা শক্তি থাকা আবশ্যক। যদি বলি, অনুষঙ্গ নির্বাচন, ভাষা কুশলতা, কাহিনিবিন্যাস ও পরিবেশনশৈলী। তিনি সমাজ বাস্তবতার গভীরে আঘাত করে, কাব্যিক শক্তি দিয়ে সহজ ভাষায় ভাষাসৌন্দর্য ও কাহিনিসংলাপ সৃষ্টি করেন। তার সৃষ্টি- মেমরি অব ডিপার্চার, (১৯৮৭), প্যারাডাইস ( ১৯৯৪) বাই দ্য সি ( ২০০১) জেডারসন ( ২০০৫) প্রভৃতি। ‘প্যারাডাইস’ ভিন্ন আঙ্গিকের উপন্যাস। সময় বাস্তবতার সঙ্গে সংগ্রামশীল জীবন, শ্রেণিবৈষম্য, বর্ণবাদ, বংশপরিচিতি এসব বিষয়কে মুখ্য ও সহজ ভাষায় তুলে ধরার মহত্ত্বগুণ অনেক। লেখকের হৃদয়ে আত্মপ্রেম থাকতে হয়, বিবেকের সঙ্গে চুক্তি করে আত্মম-ল তৈরি করতে হয়। তিনি তা করতে সমর্থ হয়েছেন।

ডায়াসপোরা লেখক তিনি। যখন বিশ^ময় আর্ট শিল্পীর চেয়ে কালচার্ড শিল্পীর কদর তখন তিনি সময়োপযোগী চিন্তক। বিশ্বজুড়ে ডায়াসপোরা লেখকের জয়জয়কার। মাতৃভাষা সোয়াহিলি হলেও ইংরেজি সাহিত্যে লেখেন তিনি। তার লেখার মান ও শিল্পসুষমা নান্দনিক ও মুক্তিবিদারী। আহত জীবনের শিল্পী, শেকড়হীন মানুষের কথাকার। মনে করা যেতে পারে- পৃথিবী একটা দেশ, এখানে মানুষের বসবাস। বোধসম্পন্ন প্রাণী মানুষ। কিন্তু কষ্টকর কথা হলো, কাঁটাতার ও ক্ষমতার রহস্যে মানুষ পরাধীন। কে জানে, কোথায় কার জন্মভূমি। ভূমিষ্ঠ হলে মাটির মমতা আঁকড়ে ধরে। সে কী জানে বংশোদ্ভূত সমস্যা তাকে বাস্তুচ্যুত করবে। সময় ও ইতিহাস আপন গতিতে প্রবাহিত হয়। মহৎ চিন্তা প্রান্তভাগ উপেক্ষা করে নিজমেধা আত্মগর্জন দিয়ে ওঠে। তিনি একজন কালচার্ড শিল্পী। চিটকে গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন- আত্ম মনোবল তাকে শিল্পের জগতে নিয়ে গেল। কারণ তিনি গণমানুষের শিল্পী। তার মহৎচিন্তা ও বৃহৎ মানসিকতা সৃষ্টিসুন্দর।

‘প্যারাডাইস’ আফ্রিকান প্যাটার্নে লেখা কল্পকাহিনি। যাতে আফ্রিকান কিশোরদের উঠতি বয়সের চিত্র সন্নিবেশিত হয়েছে। ঔপন্যাসিকের চিন্তা ও উপস্থাপনে আফ্রিকানদের কথা ও জীবন বাস্তবতা প্রকাশ ক্ষমতা নান্দনিক। কারণ জন্মমায়া। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক কাহিনি, হৃদয়বিদারক প্রেমকাহিনি, ইতিহাস ঐতিহ্যও সুলিখিত।

‘প্যারাডাইস’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইউসুফ। চরিত্রের মাধ্যমে আফ্রিকান শরণার্থীদের জীবনযাপন ও সংগ্রামের চিত্র অবর্ণনীয়। যখন নিজেকে গঠন করার কথা। সেই বয়সে ইউসুফের মতো ছেলেরা নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। বাবা যখন সন্তানকে বিক্রি করে ঋণ থেকে মুক্তির পথ দেখেছেন। তখন বলার কী থাকে? বারো বছর বয়সে তাকে বিক্রি করা ও আশ্রয়ের সন্ধান খুব ভাবায়। সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই, খ্রিস্টান মিশনারি, আফ্রিকান মুসলিম কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয় বিধ্বস্ততা সূক্ষ্ম ও সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে লড়ে জীবন পথ আবিষ্কার করেছেন। ইউসুফ নতুন স্থানে নতুনভাবে নিজেকে ধরে রাখা ও পুষ্ট জীবনের আশায় উন্মুখ। ঔপন্যাসিক ইউসুফ চরিত্রের মাধ্যমে আফ্রিকানদের জীবনবাস্তবতা ও সংগ্রামীচেতনা তুলে ধরেন। আফ্রিকার গ্রামীণ সহজ জীবন ও জটিল নগরভাবনার তীক্ষèভাবে অন্তর্গত হয়েছে উপন্যাসে। তিনি সূক্ষ্ম সামাজিক বোধসম্পন্ন লেখক। সুরচয়িতা ও বিদ্রোহী। নিক্ষিপ্ত ও অনিশ্চিত জীবন-সংগ্রামী হিসেবে দেখা যায়- ইউসুফ তার রূপক ও নিয়ন্ত্রণাধীন নায়কচরিত্র। জীবন অভিজ্ঞতা ও আপাত অজ্ঞাত পরিচয় রয়েছে। ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি ইউসুফ উজ্জ্বল চরিত্র। ক্ষয় হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে জীবন। সরাসরি ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ।

আপসহীন ও সহানুভূতিশীল লেখক তিনি। তার লেখার অনুষঙ্গ হলো- ভাগ্য বিড়ম্বিত ও সংস্কৃতি বিপর্যস্ত শরণার্থী, আফ্রিকান অঞ্চলের রাজনীতি। মনে করা হয়, এক ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির দার্শনিকচিন্তা। সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার আত্মচেতনাবোধ। কারণ দর্শন সমস্যা ও সংকট সমাধানের পথ দেখায়। জনজীবন মুক্তকরণেও সঠিক পথনির্দেশনা দেয়। আবদুলরাজাক গুরনাহ আত্মজীবনের পূর্বস্মৃতি ধারণ করে- বাস্তবিক ও বাস্তুহারাশ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন। এ কথা নিতান্ত প্রাসঙ্গিক যে, তিনি স্মৃতিবিবেচনা, সরলভাষ্য এবং বুদ্ধিবিবেচনায় শরণার্থী জীবন জিজ্ঞাসার কথাশিল্পী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close