নাদিম মাহমুদ
গদ্য
আমাদের শৈশব
শৈশবে কখনো ডানা মেলে উড়তে পারিনি, ছেঁড়া প্যান্ট, ছেঁড়া গেঞ্জি পরে কত দূরে যাওয়া যায়। তবে স্বাধীন ছিল খেলার মাঠ, পুকুর, নদীর ঘাট, ফসলের মাঠ, ধানখেতের আইল ও ছোটবেলার বন্ধুরা। সীমাবদ্ধ সংকীর্ণ জীবন ছিল আমাদের শৈশব, তবে প্রকৃতির বিশাল ক্যানভাসে সহজেই বিচরণ করতাম। নতুন কাপড় বলতে দুই ঈদ, কোনো কোনো বছর শুধু একবারই নতুন জামা পেতাম। কোনো ব্র্যান্ডের কিংবা বড় শপিং মলের নয়। ফুটপাত অথবা গ্রামের হাট থেকে কেনা হতো, এসব নিম্নমানের পরিধান বস্ত্র যা পেয়ে সারা বছরের অপ্রাপ্তি ভুলে যেতাম খুশিতে চিৎকার, চেঁচামেচি ও লাফালাফি করতাম। বাবার স্বল্প আয়ের মাঝে নিত্যনতুন বাহারি রঙের কাপড়চোপড়, পাদুকা এসবের বাড়াবাড়ি ছিল না। পছন্দ-অপছন্দের কোনো সুযোগ ছিল না, যা পেতাম তাই গায়ে দিয়ে ছুটতাম সবুজ দিগন্তের দিকে। মাঘ মাসের মেলায় বা দশমীর দিন পাঁচ-দশ টাকার জন্য কত কেঁদেছি একটি প্লাস্টিকের গাড়ি কেনার জন্য, কান্না করতে করতে কতবার মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছি তার হিসাব নেই। কোনো কোনো বছর মার মন গলাতে পেরেছি, সময় খারাপ হলে মার দাবড়ানি খেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছি।
তবে এখনকার বাস্তবতা ভিন্ন, আমার সন্তানের জন্য মাস শেষে যখন তিন-চার হাজার টাকার ডায়াপার কিনি খুব কষ্ট হয়, আমার বাবার মাসিক বেতন ছিল দুই হাজার টাকা, এর মধ্যে চলতে হতো পাঁচজনের সংসার খরচ, লেখাপড়া, আরো অন্য খরচ বহন করতে হতো সামান্য আয় থেকে। যদি বাবা-মা অক্লান্ত পরিশ্রম না করতেন কৃষিকাজের জন্য, তিনবেলা আহার জুটানো কষ্ট হয়ে যেত। বাবা সপ্তাহে এক দিন ছুটি পেতেন, বাড়িতে এসেই সবাইকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন ফসলের খেতে। নানান রকম সবজি চাষ করতেন। অনেক সময় বাবা-মার পুরাতন কাপড় লুঙ্গি হিসেবে ব্যবহার করতেন। এ নিয়ে অনেকেই হাসি-ঠাট্টা করতেন। বছরে একটা বা দুটোর বেশি লুঙ্গি কেনার সামর্থ্য ছিল না। তার পরেও সবকিছুতে সুখ বিষয়টা ছিল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সুখের দিনগুলো হারিয়ে গেছে। এখন হাজার টাকার কাপড় গায়ে দিয়েও সেই সুখ মেলে না। শৈশবে হাফপ্যান্টের নিচে সব সময় জোড়াতালি লেগেই থাকত, স্কুলের সাদা শার্টের পকেটের ছেঁড়া, তিলা পড়ে যেত, গায়ে দেওয়ার অবস্থা ছিল না। আমার সন্তানরা স্কুলের ড্রেস একটু কালার ফেইড হলেই ছুড়ে ফেলে দেয়। কোনো উপলক্ষের বাহানা পেলেই নতুন জামা চাই, এখন আমার স্মৃতিতে জেগে উঠে আমার শৈশব।
‘মা ওমা স্কুলে যামু না আইজকা, প্রত্যেকদিন ছেঁড়া গেঞ্জি পিনদা স্কুলে যাইতে মন চায় না’। ‘হের খালি অজুহাত প্রতিদিন বেনবেলা স্কুলে যাওনের আগে একটা না একটা অজুহাত দেওন লাগবো কইষা দুডা দেওনের আগে স্কুলে যা কইতাছি ছোটন।’ ‘দেহোতো গেঞ্জিডা ছিঁড়া কি হইছে, গেঞ্জির কালার তো উঠছেই আবার কলারডা ছিঁড়া ভোগলা উঠছে, এই হাটে গেঞ্জি কিন্না না দিলে স্কুলে যামু না।’ ‘বাজান না ভালো স্কুলে যা, এই হাটে চাইল, কেরোসিন, বাজার সদাই কিনতে হইবো, তুই না টেহা জমাইছোস তোর ট্যাকা মিলাইয়া আরো কিছু জুইড়া খোকনরে কমুনে তোরে একটা গেঞ্জি কিন্না দিতে।’ ‘আমার টেহা দিয়া ঈদের জামা কিনমু এই টেহার দিকে নজর দিও না।’ ‘এককাম করো খোকনের লগে একপাতি কপি হাটে লইয়া যা তাইলে তোর গেঞ্জি কেনার টেহা হইয়া যাইবো।’ ‘এত্তো দূরে পাতির বোঝা লইয়া যাইতে পারমু?’ ‘তোর ভাই তো প্রত্যেক হাটে কিছু না কিছু মাথায় নিয়ে হাটে যায় তুই পারবি না কে?’ ‘মাকে কেমনে বুঝাই! আমার মাথায় বোঝা নিতে লজ্জা লাগে, এক ধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হয়। যদি স্কুলের বন্ধুরা দেখে বিশেষ করে মেয়ে সহপাঠীরা মার কথা শুনে চুপচাপ খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে চেঁচিয়ে উঠলাম।’ ‘আমি পারতাম না, তোমার কামলা খাটতে।’ ‘এহন স্কুলে যা বেডিগো লাহান চোপা করা লাগবো না, হাটবার আসুক দেখমুনে কি করা যায়।’ ‘হো ছিঁড়া গেঞ্জি গুনাদিয়া জোড়ানো ছিঁড়া সেন্ডেল জোড়াতালি দিয়া আর কয়দিন?’ ‘তুই গেলিনি কুত্তার বাচ্চা স্কুলে যাওনের আগে হের খালি টালটিপালটি।’ ‘দূর মায়ের খাওয়ানের আগে স্কুলে যাইগা, এই বলে স্কুলের দিকে এক দৌড় দিলাম।’
‘স্কুলে গিয়া দেখি আইসক্রিমওয়ালা টুক্কা মিয়া এখনো আসে নাই। খুব আইসক্রিম খাইতে মন চায়, আট আনার আইসক্রিমের সেই অমৃত স্বাদ এখনো অনুভব করি।’ বেনবেলা মার গলার আওয়াজ- ‘কিরে খোকন, ছোটন জমিদারের বাচ্চা হইলি কবে থাইক্যা, ওঠ আইজকে হাটবার মনে নাই?’
জানুয়ারি মাস শীত আর কুয়াশা জেঁকে বসে গ্রামগুলোতে। সকালবেলা লেপের নিচ থেকে উঠতে মন চায় না। কপিখেতে আরো যেতে মন চায় না। কপিগাছে শিশির জমাট বাঁধা পানি হাতে-পায়ে পড়লে ঠান্ডায় হাত-পা বরফখ-ের মতো জমে যায়। কিন্তু আমাদের আর সেই কপাল কই? বিছানায় আরাম-আয়েশ করে দশটা-বারোটা পর্যন্ত ঘুমাব! হয় সকাল সকাল মক্তবে, নয়তো ফসলের খেতে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। তাই দুই ভাই মিলে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে খেতের দিকে পা বাড়ালাম। কৃষি জমিতে চাষাবাদ প্রায় বন্ধ বলা চলে। একটা কপিগাছের পেছনে কত যে পরিশ্রম, তা শুধু চাষিরাই বুঝেন। শক্ত শুকনো মাটি পিটাইতে পিটাইতে পাউডার করা লাগে, তারপর আলতো চাপে নিড়ানি কাঁচির দেড় দুই ইঞ্চি গর্তে চারাগুলো রোপণ করতে হয়। সময়মতো পানি-সার দিতে হয়, একটু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে মাঠে মারা। যখন গারো সবুজ গাছগুলোতে ফুটফুটে তখন কি যে আনন্দ লাগে বুক ভরে যায়!
‘হাত চালা খোকন হাত চালা, সূর্য ওঠার আগেই কাজ শেষ করতে হইবো।’ ‘হো এই ছোটলোকের কাম করতে করতে জীবন শেষ।’ ‘কামচোরা কোনহানকার তোর মতো আইলসা আমি জীবনেও দেখি নাই, তাড়াতাড়ি কর বিকালে মাঠে খেলতে যামু।’ ‘আইজকা বাবাই আইবো, খেলা পিঠের ওপরে দিয়া দিব নে। ‘মারে কইয়া রাখমু, আছরের আগে আগে আইতে পারলে প্রাইভেট পড়তে যামু।’ ‘হে হে ধরা খাইলে মাইর দ্বিগুণ।’ ‘আচ্ছা দেখা যাক এখন কপিগুলা মাথায় তোল।’ কপি লইয়া দুই ভাই বাড়িতে কলতলায় রাখলাম। পাতা ছাঁটাইয়া পরিষ্কার করে পাটিতে মাজরা রেখে খেতে গেলাম।
এক পাতি কপি আমার দ্বারা এক মাইল দূরের হাটে নেওয়া সম্ভব না। তাই বুদ্ধি আঁটলাম কোনোরকম কষ্ট করে বাজার পর্যন্ত যাই। তারপরে যে করে হোক রিকশা করে যাওয়া লাগব কিন্তু ভাই যে হারে মাকে ভয় পায় আর কিপটা তার সাথে কোনোভাবেই পারা যাবে না। ‘ভাই চলো রিকশা দিয়া যাই আজকে।’ ‘ওরে আমার জমিদার, হাট! রিকশা ভাড়া দিব কেডা? মায় পাই টু পাই হিসাব লইবো, আর হিসাব না মিললে মাইর খাইবো ব্যাডা শুনি।’ ‘ভাই চলো একটা কাজ করি, তোমার বড় পাতির কপিগুলা পাইকারি আমারটা খুচরা বেঁচি তাইলেই তো টাকা আইয়া পড়বো।’ ‘খুচরা বেচলে সময় বেশি লাগবো। পাইকারি দিয়া আইয়া পড়ব। বিকালে মাঠে খেলা আছে।’ ‘একদিন না খেললে কি হয় ভাই? ঠিক আছে আমারে রিকশা দিয়া না লইয়া গেলে আমিও আব্বার কাছে কইয়া দিমু পড়ার না দিয়া মাঠে খেলতে গেছো।’ ‘ওরে ইবলিশ যা তোর কথায় সই।’ ‘তয় আগে চল ব্রিজ পার হই তাইলে দুই টেকা ভাড়া কম্বো।’ হাটের এই রাস্তাটা এখনো আমার ভীষণ প্রিয়। রাস্তাটার লাগোয়া একটা বড় খাল। এই খাল দিয়ে বর্ষার সময় ট্রলার আসতো দূরদূরান্ত থেকে, হাটের দিন ট্রলারে বোঝায় থাকতো নানান রকম পণ্য। গরু-ছাগল, এখন আর এইখানে সাধারণ নৌকাও চলে না। এই এক মাইল রাস্তাজুড়ে কোনো বাড়িঘর নেই। দুই পাশে ছিল ধানখেত, শীতে সরিষা খেত, মৌসুমি ফসলের বাহার। আধুনিকতার দুপাশে শিল্প-কারখানা, ইটের ভাটা পরিবেশ দূষণের সব যন্ত্র বসানো হয়েছে এখন।
ভাই চলো আগে গেঞ্জিটা কিন্না আনি তারপর না হয় ঘরের বাজার সদাই করমু। ‘চল আগে বাজার যাবি তারপর না হয় তোর গেঞ্জি।’ ‘দূর, বাজারের বোঝা নিয়ে হাটে ঘুরতে ফকিন্নি ফকিন্নি লাগে!’ ‘তোর তো দেহি গেঞ্জির লাইগ্যা বিয়ায় ফাল উঠছে, আগে বাজার শেষ করি ঠিকঠাকমতো। বাজার না পাইলে মায়ে গারাইবোনে।’ চাইলের বোঝাটা আমার মাথায় দিয়া কইলো- আমগো হইলো কামলার জীবন। নতুন গেঞ্জি কিনার লোভে চালের বস্তা মাথায় নিতে কোনো দ্বিধা নাই, আমিও ছুটলাম ভাইয়ের পিছে পিছে। যখন গেঞ্জির দোকানের সামনে বস্তাটা নামাইলাম, মনে হইলো পৃথিবীর ওজন শূন্য।
যেই গেঞ্জি পছন্দ করি ওডার দাম একশো পঞ্চাশ টেহা। ভাই চাইতেছে নব্বই, একশো টাকার মধ্যে শেষ করতে। তখন ভাই বলল ‘দেখ এইডা কেমন লাগে, নেভি ব্লু কালারটা আমার খুব প্রিয় শেষমেশ একশ দশ টাকায় রফাদফা হইলো।
গেঞ্জি কিনে আবার বায়না করলাম ভাই ‘চলো রিকশায় যাই’। এই বেডা তুই এত্তো আইলসা কে? মার কাছে তুই হিসাব দিস আমি ঝাড়ুর বাড়ি খাইতে পারবো না। ‘কেন আইজকা যে খুচরা বেশি বেঁচলা ঐখান থেকে দাও।’ কালকে মাঠে খেলা আছে চান্দা দিতে হইবো পাঁচ টেহা, চাইলের বস্তা মাথায় ল। সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দে, একটু পর হাইনজার আজান দিব। না আমি এই বস্তা লইয়া এত্তো দূর যাইতে পারবো না। সবকিছুতে তোর ত্যাড়ামি না করলে হয় না। এককাম কর, মার কাছে গিয়া কবি গেঞ্জির দাম একশো বিশ তাইলে রিকশা দিয়ে লইয়া যামু।
‘চলো যাই’
বাড়ি পৌঁছাতেই মায় ডাক দিলো ‘খোকন’ ও খোকন এই দিকে আয়, আজকে কত বেচলি কপি?’ ‘মা, সব খরচ করে বিশ টেহা ফিরছে। মাত্র বিশ টেহা কেন আর টেহা কই? ‘তোমার পোলার গেঞ্জি কিনছি একশো বিশ টেহা দিয়া। আবার আসার সময় রিকশা দিয়া আইছি। এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মা জিবে কামড় দিয়া চিল্লায় উঠলো। ‘ওরে শকুনের দল, তোগরে হাটে পাঠাইছি আর তোরা ফুটানি মারায়তে গেছো; খাড়া বলেই ঝড়ু দিয়া দিলো এক দৌড়ানি।’ দুই ভাই অন্ধকারে রাস্তার দিকে ছুটলাম।
"