সোহেল মাজহার

  ০৮ অক্টোবর, ২০২১

ধারাবাহিক রচনা । ৫

উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু

রাবেয়া খাতুনের ফেরারি সূর্য : শব্দ, বাক্য, চিত্রকলা বুনন করে রাবেয়া খাতুন তার গদ্য ভাষা নির্মাণ করেন। মানুষের বহির্জগৎ ও অন্তর্জগতের বাস্তবকে তিনি বাঙময় করে তোলেন। প্রধানত মধ্যবিত্ত জীবনে, সমাজ, তাদের বিভিন্নমুখী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তার গল্পের অন্যতম অনুষঙ্গ। মানুষের বিচিত্র জীবন ও অনুভূতিকে তিনি ভাষায় প্রতীকায়িত করেছেন। মধুমতী আখ্যানে তাঁতশিল্পীদের মতো সমাজের একটি বিশেষ ক্ষেত্রকে শব্দ ও বাক্যে ব্যক্ত করেছেন। সর্বজনীন সময়, সমাজ, জীবন, রাজনৈতিক ও সমাজের অনিবার্য বাস্তবতাকেও তেমনি তিনি এড়িয়ে যাননি। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ যে অনিবার্য বাস্তবতা নিয়ে মূর্ত হয়। বিশেষ করে ঢাকা নগরের জীবনে ভয়াবহ সাহস সঞ্চার হয়েছিল। একজন ব্যক্তি মানুষ ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে রাবেয়া খাতুন তার প্রত্যক্ষদর্শী। তার সেই বোধের জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ফেরারি সূর্য।

উপন্যাসে ধারণাগত অর্থে কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। করিম সাহেবের ও অধ্যাপক সাহেবের পরিবারের মধ্য দিয়ে একাত্তরের ভয়াবহ সময়, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা, অস্থিরতা ও উদ্বেগাকুল নাগরিক জীবনকে চিত্রায়িত করেন। নায়ক প্রধান না হলেও আশেক ও রাসা বিশেষভাবে মনোযোগের দাবিদার। উপন্যাসের সূচনা হয়েছে উত্তাল মার্চ ও একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। ১ মার্চ হঠাৎ করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে ঢাকা শহরে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কিংবা কীভাবে বাঙালির মানস জগতে স্বাধিকারের দাবিটি স্বাধীনতা দাবি হিসেবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটে ওঠে? লেখক সেই সময় ও কণ্ঠকে চিহ্নিত করেছেন এভাবে- ‘পয়লা মার্চের দুর্দান্ত সেই দিনটা। উত্তপ্ত, রৌদ্রোজ্জ্বল। দুপুরের খবর নয়, বিস্ফোরিত বোমা। জ্বলে উঠল গোটা শহর। জাতীয় পরিষদের তিন তারিখের বৈঠক পিছিয়ে গেছে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। প্রতিবাদ, মিছিল, স্লোগান।

হোটেল পূর্বাণীর জরুরি আলোচনা উদ্বেল বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ প্রত্যাশী দারুণ দুপুর। খেলার মাঠের শেষ দিনের রেডিও কমেন্টি, আচমকা স্তব্ধ। এমএ পরীক্ষার্থী ভাইভার ছাত্ররা মাঝপথে ছত্রভঙ্গ, আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট অন্ধকার পোস্টারে ছাওয়া দেয়ালকে দেয়াল। দৈনিকের বিশেষ টেলিগ্রাম সংখ্যা পরদিন স্ট্রাইক। জলে, স্থ’লে, অন্তরিক্ষে। অচল কারখানার কলকব্জা। ধূমায়িত রাজধানী ঢাকা।

সরকারি প্রতিবাদ প্রজ্বালিত গুলিতে। ক্ষুব্ধ জনতা ক্ষিপ্ত রুখে দাঁড়াল। ভাঙল কারফিউ, ভাঙল কানুন, মশাল মিছিলের দাবি গগনস্পর্শী- জুলুম মানব না।

শহর ঢাকা ক্ষুব্ধতার, মিছিলের, বিদ্রোহের, প্রতিবাদের। তারই ধাক্কায় গভর্নরের শপথ নিতে গিয়ে জাঁদরেল জেনারেল টিক্কার নাকাল মুখে ফিরে আসা। আক্রান্ত উল্লেখযোগ্য সরকারি ভবন। ঘরে-বাইরে কালো নিশান। বেতার টেলিভিশনে গণসংগীত সাহিত্য সংবাদ গলিতে লাভা।

থমথমে অনেকগুলো দিনের আজ কি কোনো বিশেষ অর্থ কিংবা যোগফল? প্রেসিডেন্ট হাউসের মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠকের বিলম্বিত আলোচনা উত্তেজিত মার্চের তৃতীয় হপ্তাঅন্তের পঁচিশের দুপুুরে সবার মধ্যে এক দুরূহ চেতনা চোখে চোখে প্রতিফলিত সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর চরম হুশিয়ারি-সমঝোতার আশা নয়, আর কিছু।’ (পৃ. ৮৪, নির্বাচিত উপন্যাস রাবেয়া খাতুন, একুশে বইমেলা-২০০৮ কমিউনিকেটিভ পাবলিকেশন, ঢাকা)

উপরিউক্ত দীর্ঘ উদ্ধৃতির মধ্যে একদিকে মার্চের অসহযোগ আন্দোলন। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের ষড়যন্ত্র। জনগণের প্রতিবাদমুখের ভঙ্গি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর দূরদর্শী নেতৃত্ব। সংকট নিরশনের ঐকান্তিক ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি চরম হঠকারিতা ব্যাপক গণহত্যা বাঙালিকে মৃত্যু বিভীষিকার মুখে ঠেলে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করে। রাতের আঁধারে নিশ্চিত ঘুমের ভেতর নিরূপদ্রব শান্তিকে খান খান করে নেমে আসে সর্বগ্রাসী মৃত্যু।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close