সোহেল মাজহার

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ধারাবাহিক রচনা । ৩

উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু

শামসুর রাহমানের অদ্ভুত আঁধার এক (১৯৮৫) : মুক্তিযুদ্ধ নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে বড় ক্যানভাস। নদীর বাঁধভাঙা স্রোত জীবন ও সংস্কৃতিকে বহুমাত্রিকভাবে প্রভাবিত করে। তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবন, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আর্থসামাজিক, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক জগৎকে প্রভাবিত করে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা ব্যক্তির মানস জগৎ, তার অন্তর্গত ভাবনা, জীবন-দর্শন, রাজনৈতিক বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বোধ, বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের স্তর, ভীতি ও সাহসের মাত্রাকেও নানাভাবে প্রভাবিত করে।

শামসুর রাহমানের কবিতায় আধুনিকতা ও নগর চেতনা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলেও মুক্তিযুদ্ধ একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। কথাসাহিত্যে বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তির অস্তিত্ব, আত্মগ্লানি ব্যক্তির সংকট, দ্বিধার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকেও প্রাসঙ্গিক করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাসঙ্গিকতায় কবির উপন্যাস ‘অদ্ভুত আঁধার এক’। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নাদিম ইউসুফ একজন কবি। এরই মধ্যে পাঁচটি কবিতার বই প্রকাশ করে তিনি পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছেন। পেশাগত জীবনে তিনি দৈনিক পদাতিকের সহকারী সম্পাদক। পরিবারের অন্য সদস্যরাও স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তার ভাই হাসান জামিল ব্যবসায়ী, জাভেদ কায়সার ব্যারিস্টার ও ফাহিম সাদেক শিক্ষক। সব মিলিয়ে এক ধরনের নিরূপদ্রব জীবন কবি নাদিম ইউসুফ যাপন করেন। আধুনিক কবি হিসেবে ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে তার মনে সংশয় সৃষ্টি হয়। বাবা আলহাজ তমিজ উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে মৃত্যু, ধর্ম ও স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে তার মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। কবিতা ও শিল্পচর্চার মাধ্যমে এক ধরনের যুক্তিবোধ, মানবিক বিশ্ববিক্ষা ও সংশয় তৈরি হয়। অর্থাৎ আধুনিক কবি মানস যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন বোধ লালন করেন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নাদিম ইউসুফ তাই করেন।

মার্চের ২৫ তারিখ পাকিস্তান বাহিনী ঢাকা শহরে যে ভয়াবহ হত্যাকা- সংঘটিত করে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রাসঙ্গিকতায় প্রায় সব লেখক ঢাকার গণহত্যার প্রসঙ্গ ভাষা, ভাষার ইমেজে মূর্ত করার চেষ্টা করেছেন। স্বভাবত কবি হচ্ছেন সংবেদনশীল মানসের অধিকারী। আবার আখ্যানের প্রধান চরিত্র একজন কবি। কাজেই একাত্তরের ভয়াবহতা তার মানস জগৎ ও স্পর্শকাতরতা দারুণভাবে আহত করেছে। একজন কবি এবং একই সঙ্গে একজন সামাজিক মানুষ এবং একজন গৃহী মানুষ হিসেবে ঢাকার নারকীয় হত্যাযজ্ঞ তার অনুভবে একটি লোমহর্ষক প্রভাব ফেলে। নাদিম ইউসুফের ভাবনায়- ‘নানা ধরনের উল্টোপাল্টা চিত্র জেগে উঠছে ওর মনে। কেমন গোলমেলে হিজিবিজি। গুলির শব্দ, চিৎকার, মর্টারের আওয়াজ, আগুন, কারফিউ ও লাশ। লাশ, গুলি, ব্যারিকেড, মর্টার, চিৎকার, আগুন, কারফিউ, রেডিও, ভয়ানক আওয়াজ, ছুটোছুটি কুকুরের ডাক, ট্রাক, জিপ ও চিৎকার। বাস, তারাবো-যাত্রাবাড়ী, জিন্দাবাহার, নয়াবাজারে লেলিহান আগুন, শাঁখারীবাজারে অবিরাম গুলির শব্দ ও পদধ্বনি, এলোমেলো কুকুরের আর্তনাদ। ছাত্রদের হলে হামলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকপাড়ায় হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবলীলা, অধ্যাপক হত্যার খবর, গোবিন্দ দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আরো কেউ কেউ। হঠাৎ রেডিওতে মেজর জিয়ার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। কে এই মেজর জিয়া? যিনিই হোন তিনি বাঙালিদের আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। তাহলে সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনো আশা আছে। আসলে নাদিম মনে মনে বলে, ৭ মার্চেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, যখন তার উদাত্ত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই ধ্বনি আশ্রয় পেয়েছিল এ দেশের আকাশে-বাতাসে, বাংলাদেশের হৃদয়ে।’ (পৃ. ৬৪, অদ্ভুত আঁধার এক, উপন্যাসসমগ্র, শামসুর রাহমান ঢাকা বইমেলা ২০০০, দিব্য প্রকাশ) অর্থাৎ একটি কথা সুস্পষ্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিব এক ও অভিন্ন। প্রাসঙ্গিক যে, বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৬ মার্চ দিনের বেলা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান। ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন।

অন্যদিকে লেখক সামান্য কথায় মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতাকে ভাষায় ব্যক্ত করেন। লেখক তার বাক্যগঠন, ভাষা, ভাষাশৈলীর মাধ্যমে মানুষের কল্পনা ও বিষয়ের সীমারেখা ভেঙে একাকার করে দেন। লেখকের ভাষায়- ‘বাঙালিদের চিরদিনের জন্য পশ্চিমাদের পায়ের তলায় রাখার ষড়যন্ত্র চলছে শেষ পর্যন্ত কী হয় জানি না এত অন্ধকার পথ খুঁজে পাচ্ছি না অন্ধের মতো চলতে হচ্ছে শহরে কি প্লেগ লেগেছে আমি মেজর জিয়া বলছি আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি বাস কটায় আসবে একটু আগে তারাবোতে অপারেশন হয়ে গেছে থই থই পানিতে লাশ ভাসছে তাকান যায় না নাজমাকে এবার উনিশ টাকায় শাড়ি কিনে দেব ওর মন ভেঙে যাবে না তো’ (পৃ. ১০২, উপন্যাসসমগ্র; শামসুর রাহমান, ঢাকা বইমেলা ২০০০, দিব্য প্রকাশ)

এক অর্থে নাদিম ইউসুফের মধ্যে আমরা কবি শামসুর রাহমানের আত্মপ্রতিকৃতি দেখতে পাই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ঝুঁকি স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। উপরন্তু দৈনিক পাকিস্তানে কাজ করেছেন। এটি তার মাঝে গ্লানি সৃষ্টি করে। হয়তো আমৃত্যু তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি। লেখকের জন্য সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ আখ্যানটি ব্যক্তির অস্তিত্ব ও সংশয়তাড়িত আত্মগত ভাষা হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে না পেরে তিনি অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়েছেন। অথচ একজন মানুষ, একজন কবি, একজন সাংবাদিক, একজন রাজনীতিসচেতন মানুষ এবং একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ তার কাছে অপরিহার্য। সারা জীবন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আবার যুক্তিনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে তিনি বারবার উপলব্ধি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অশেষ প্রেরণার উৎস। অস্তিত্বের মতো প্রাসঙ্গিক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close