সাদিক আল আমিন

  ০৬ আগস্ট, ২০২১

রবীন্দ্রনাথ এবং তার সংগীত

সংগীত জগতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্বতন্ত্র ও আত্মগত। বাহ্যগতও ছিলেন। যেহেতু জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই একতারা, হারমোনিয়াম, তবলার ঝংকারে মেতে উঠত পুরো রাজবাড়ি; তার প্রভাব পড়েছিল কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনেও। বাঁশির করুণ সুরে ভিজে আসত তখন দুরন্ত মন। কল্পনাজুড়ে থাকত গহিন বনে একটি হরিণীর আত্মরোদন। সেই থেকেই হয়তো রচনা করেছিলেন অমূল্য সংগীত ‘মায়াবন বিহারিণী’। সংগীত রচনার পর নিজেই সুর দেওয়ার চেষ্টা করতেন। সেই সুরগুলোও হয়ে উঠত অসাধারণ।

রবীন্দ্রনাথের মোট গানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজারেরও বেশি। প্রতিটি গানেই অদ্ভুত করুণতা, রস, মাধুর্য, সাবলীলতা রয়েছে। রয়েছে নস্টালজিয়ার প্রকোপ। ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ এসব গানে হারিয়ে যাওয়া যায় পুরোনো দিনে। আবার ‘বড় আশা করে’, ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’ শুনে গভীর আবেগে বেদনার নদীতে সাঁতার কাটা যায়। বাংলাদেশ, ভারত এবং শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘আমার সোনার বাংলা’য় মাতৃত্বের প্রতি গভীরতম আবেগ অনুভব করে না এমন কেউ নেই। ভারতের জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’-তে ভারতমাতার প্রতি ভালোবাসা এবং ভারতের সব অঙ্গরাজ্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কার গানেও সেখানকার মাতৃভূমির বর্ণনা আছে। গানগুলো হয়ে উঠেছে অসাধারণ এবং এর মাহাত্ম্য বিশ্লেষণ করা অনেক কষ্টসাধ্য।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে প্রণয় ছিল। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা-মনচাহিদা বিরাট সেই রাজপরিবারে বোঝার মতো কেউ ছিল না। একমাত্র কাদম্বরী দেবী সেই স্থানটি দখন করতে পেরেছিল বলে দুজনার মধ্যে সখ্য গড়ে উঠেছিল। ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই/চিরদিন কেন পাই না’ গানটিতে ফুটে উঠেছে অপ্রাপ্তির গভীরতম আক্ষেপ। সেটি কোন অপ্রাপ্তি, তার রহস্য কেবল রচয়িতারই জানা।

রবিঠাকুরের ‘গীতবিতান’ বাংলা সাহিত্যের এমন এক অমূল্য সম্পদ, যা কখনো অন্য কোনো কিছু থেকে ছোট হওয়ার নয়। প্রায় সত্তর বছর ধরে একাধারে গান লিখে যাওয়া রবির প্রথম গান হলো ‘গগনের থলে রবী চন্দ্র দীপক জ্বলে’। এগারো বছর বয়সে এ গানটি তিনি রচনা করেছিলেন। তার লেখা শেষ গান হলো ‘হে নূতন দেখা দিক আর-বার’। নিজের গান ছাড়াও অন্য লেখকদের কিছু গানেও তিনি সুরারোপ করেছেন। তাদের মধ্যে বিশেষ একটি হলো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বন্দে মাতরম’। রবির গানে উপনিষদ, সংস্কৃত সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য ও বাউল দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। বাংলার লোকসংগীত, কীর্তন, রামপ্রসাদী, পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত ও পাশ্চাত্য লোকগীতির প্রভাব তার গানে লক্ষ করা যায়। সংগীতবিষয়ক কিছু প্রবন্ধও তার রয়েছে।

চলচ্চিত্রে রবিঠাকুরের সংগীতের ব্যবহার শুরু হয় প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘মুক্তি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এরপর সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, গৌতম ঘোষসহ প্রমুখ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালকরা তাদের ছবিতে সার্থকভাবে রবীন্দ্রসংগীত প্রয়োগ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ কেবল সংগীত রচয়িতা কিংবা সুরকারই নন, তিনি সংগীতস্রষ্টা। সংগীতের বাদশাহ বললেও মনে হয় ভুল বলা হবে না। শান্তিনিকেতনের সৌহার্দে যে সংগীতমন তার মধ্যে গড়ে উঠেছিল তা বর্ণনাতীত। প্রকৃতির সঙ্গে জীবনকে মিলিয়ে গড়ে তুলেছিলেন অনন্য রূপময়ী। কবিতার মতো তার লেখা গানগুলোও এত যুগ পরেও মানবমনে গেঁথে আছে। প্রতিদিনই বেজে উঠছে অপরূপ সুন্দর ঝংকারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close