গোলাম মাওলা

  ৩০ জুলাই, ২০২১

গল্প

প্রশান্তি

১৫ কেজি চালের ওজন ধীরে ধীরে মনে হয় বেড়েই যাচ্ছে। প্রথম যখন হাতে নেয় তখন এত ভারী মনে হয়নি। মনির ফুটপাথ ধরে হাঁটছে। গ্রীষ্মের সূর্যটা মনে হয় আজ বেশ তাপ দিচ্ছে। শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে। পাঞ্জাবিটা পিঠের দিকে ভিজে গেছে।

-ভাই রিকশা লাগবে?

পোশাক দেখে তাকে সামর্থ্যবান মনে করছে রিকশাওয়ালা। কিন্তু ও জানে না মনিরের পকেটে টাকা নেই। সময়টা বড় খারাপ যাচ্ছে। এভাবে আর কত দিন চলবে কে জানে। সবাই বলছে খোদার গজব নেমেছে। মানুষ আর মানুষ নাই। একদল ভুখা মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরছে। চেহারা দেখে বোঝা যায় না কার কী অবস্থা।

গত ২৪ মার্চ শেষ অফিস করেছে মনির। হঠাৎ করে সরকার সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করেছে। একটা প্রকাশনা অফিসে প্রুপ রিডিংয়ের কাজ করত সে। অফিস বন্ধ, প্রিন্ট বন্ধ তাই তার প্রুফ দেখাও বন্ধ। হাতে ছিল হাজার-পাঁচেক টাকা। তা দিয়ে টেনেটুনে এক মাস পার করেছে। প্রকাশনার মালিকের কাছে তার বিল পাওনা আছে। সে এখন আর তার ফোন ধরছে না।

করোনায় সবকিছু বন্ধ হওয়ার পর মেসমালিকের তিন হাজার টাকা দেওয়ার পর হাতে ছিল দুই হাজার টাকা। তা দিয়ে ৪০ টাকা দরে কয়েক কেজি মোটা চাল আর আলু কিনেছিল। প্রথম প্রথম তো মনে করেছিল এই তো ১০-১৫ দিনের ব্যাপার। তাই তখন আলুর সঙ্গে ডিম ভর্তা করে খেত। সরিষার তেল দিয়ে মাখালে ভালোই লাগে। মাঝে মাঝে যদি একটু ডাল হয় তাহলে তো কথাই নেই।

হাতটা কয়েক দফা বদলিয়েও পারা যাচ্ছে না। আচ্ছা যদি মাথায়নি। পরিচিত কেউ দেখলে আর ইজ্জত থাকবে না। ধুর... এ অবস্থায় আবার ইজ্জত। পেটে খাবার নেই, বাঙালির ইজ্জত টনটনে। মনির শেষ পর্যন্ত বোঝাটা মাথায় নিয়ে হাঁটতে থাকে। এতে কষ্টটা একটু লাঘব হয়। অফিস তো আর খোলে না। সরকার এ পর্যন্ত তিন দফা লকডাউনের সময় বৃদ্ধি করেছে। গত সপ্তাহে শেষ কটা ভাত ফুটাতে পেরেছিল।

এ দুর্দিনে ওর মনে পড়ে কবি খোরশেদ বাহারের নাম। বড় ভালো মানুষ। গল্প-উপন্যাস লেখেন, আর একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতা দেখেন। মনিরের কয়েকটি লেখাও উনি ছেপেছেন। এ শহরে চেনাজানা কেউ নেই যে কারো কাছে হাত পাতা যায়। যদি তার কাছে কিছু মেলে তো ভালো হয়। হাত পাতাটা মনিরের একেবারে অপছন্দ। অফিসের কারো কাছে ধার চাওয়ার আগে দশবার ভাবে মনির। যদি না করে দেয়। তখন লজ্জাটা তো সে পাবে। অথচ অন্যরা কি অবলীলায় ধার করছে। মাঝেমধ্যে দেয় আবার মাঝেমধ্যে সময় বাড়িয়ে নেয়। কমপক্ষে তিনজনের কাছে ও হাজার দশেক টাকা পাবে। কেউ এখন আর ফোন ধরছে না।

খোরশেদ ভাইয়ের বাসাটা মগবাজারের চানবেকারীর গলিতে। মনির আজ সকালে ওর ফকিরাপুলের মেস থেকে হাঁটতে হাঁটতে মালিবাগ রেললাইন পার হয়ে চানবেকারীর গলিতে পৌঁছায়। তখন সকাল ১০টা। বাসায় ঢুকতে মনে হলো ওনার ছোট একটা মিষ্টি মেয়ে আছে ওর জন্য ১০ টাকা দামের একটা চিপস আনা দরকার ছিল। বাচ্চাটা চাচ্চু বলে কোলে এসে বসে। কিন্তু ও জানে ওর হাতে আছে মাত্র ১০ টাকা। এটাই সম্বল। না ওসব কেনা যাবে না। মনিরের খারাপ লাগছে। তার পরও বেল বাজায়।

ভাবি দরজা খুলে দেয়। মনির ঘরে ঢুকে দেখে খোরশেদ ভাই বিছানায় শুয়ে আছেন। ভাবি বলল, জ্বর ও কাশি। তাই তিনি আইসোলেশনে আছেন। খোরশেদ ভাই আমাকে দূরে বসতে বললেন। ছোট মেয়েটা এলো না আমার কাছে। করোনা সবই পর করে দিয়েছে। খোরশেদ ভাইয়ের পাতলা গড়নের শরীরটা মনে হয় আরো চিকন হয়ে গেছে। গাল বসে গেছে। চার দিনের জ্বরে একেবারে কাবু হয়ে ফেলেছে।

এমন সময় বাসার বেল বাজে। বাড়িওয়ালা এসেছে ভাড়ার তাগিদ দিতে। মনির শুনতে পারে তার কথা। বেশ উচ্চৈঃস্বরে বলছেন

-শোনেন ভাবিসাব, এ ভাড়ার টাকায় আমার ঘরের বাজার সদাই হয়। আমি বড় লোক না, যে ভাড়া মাফ কইরা দিমু। অহনই ভাড়া লাগবে।

-আপনার ভাই তো জ্বরে কয়দিন যাবৎ পড়ে আছে। সে কোথাও যাইতে পারে নাই।

-জ্বর... করোনা টরোনা তো! দেখেন, আমি সাফ কইতাছি। যদি করোনা হয় তো আপনারা এখনই বাসা ছাড়েন। আমিও এখানে থাকি পরিবার লইয়া। কি গজবি কথা। আপনারা সাংবাদিক মানুষ সারা দিন ঘোরাঘুরি করেন। এই বিল্ডিংয়ে আপনাগো রাখা যাইব না। ভাড়া লাগব না। এখনই বাসা ছাড়েন।

-কী বলেন আপনি! বললাম তো মানুষটার জ্বর। করোনা হয়নি।

-তার বিশ্বাস কী। দোহাই লাগে। আপনারা এ এলাকা ছাড়েন।

-কী যে বলেন এসব। আপনার ভাড়া লাগবে ভাড়া নেন।

-দেখেন ভাবি, করোনা হইলে কিন্তু আপনাগো রাখতে পারব না। টেস্ট করান ওনারে। আর ভাড়া দেন।

ভাবি ভেতরে আসে।

-সবই তো শুনলে। ভাড়া না দিলে বাড়িওয়ালা আমাদের নামায়ে দেবে। তোমার পকেটের টাকা তো কবেই শেষ হয়েছে।

-কী করব, তিন মাসের বেতন এখনো বাকি, কবির ভাই বলল বেতন হবে, কিন্তু হলো না, অফিসের কর্মচারী ছাঁটাই চলছে। এ লকডাউনের মধ্যে ২০ শতাংশ ছাঁটাই হয়েছে। সবাই আতঙ্কে আছে। কে ছাঁটাইয়ে পড়বে। তাই জোর দিয়ে বেতনের কথা বলতে পারি নাই।

মনির বাকরুদ্ধ বসে আছে। ভাবছে কী করা যায়। এখন তো খোরশেদ ভাইয়েরই সাহায্য দরকার। সে এসেছিল কোনো সাহায্য পাওয়া যায় কি না। ভেবে পায় না মনির কী করবে। ভাবি অতিকষ্টে বাড়িওয়ালাকে বিদায় দিয়েছে। ভেতরে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

মনির বেরিয়ে আসে বাসা থেকে। রাস্তায় এসে পকেটে হাত দেয়। দশ টাকার নোটটা বের করে। সেটা ঘুরিয়ে দেখে। এটাই তার শেষ সম্বল। পৃথিবীটা তার কাছে বড় নির্দয় মনে হচ্ছে। প্রভু, কেন এমন হলো। খোরশেদ ভাই একজন গুণী মানুষ। ভালো একজন লেখকও। জীবনে আপস করেননি কারো সঙ্গে। এজন্য কতবার তাকে পত্রিকা বদল করতে হয়েছে। এমন মানুষের কপালে এমন দুর্ভোগ কেন।

মনির দোকান থেকে ১০ টাকার মুড়ি কেনে। তারপর আবার খোরশেদ ভাইয়ের বাসায় যায়। ভাবির হাতে মুড়িটা দিয়ে আর দাঁড়ায় না। হনহন করে রাস্তায় হাঁটতে থাকে। কী করবে, কোথায় যাবে জানে না। তবু হাঁটতে থাকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close